নবী (সঃ) –এর ওয়াফাত-উত্তর কালে মুসলিম উম্মাহ –এর পরিস্থিতি সামলাতে প্রথম খলিফা হযরত আবু বাকার (রাঃ) –এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
ষষ্ঠ হিজ্রিতে মুসলমানরা মদিনা থেকে পুনরায় মক্কায় আসেন এবং কোন রকম সহিংসতা ছাড়াই কাবা প্রদক্ষিণ করেন। দুই বছর পরে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করে নেন। মক্কা জয় করেই প্রিয় নবী (সঃ) কাবার ভেতরে রাখা সকল মূর্তি ধ্বংস করেন এবং কাবাকে বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপরও কুরাইশদের কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা কেউ হালে পানি পায়নি। ক্রমান্বয়ে সকল আরব উপজাতি নবী (সঃ) –এর নেতৃত্বে একীভূত হয় এবং ইতিহাসে প্রথম বারের মতো গোটা আরব অঞ্চল শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১০ম হিজ্রিতে (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে) আল্লাহর রাসূল (সঃ) আরেকবার মক্কার পথে বের হয়ে এক সমাবেশে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। সেই ভাষণে তিনি প্রত্যেক মুসলমানদের জীবন ও সম্পত্তিকে অপরের জন্য আমানত ও পবিত্র সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি প্রতিটি মানুষ এমনকি দাসদাসীকেও মানুষ হিসেবে পূর্ণ অধিকার প্রদান করেন। তিনি বলেন পুরুষের যেমন নারীদের ওপর অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি পুরুষের ওপরও নারীদের অধিকার রয়েছে। তিনি আরও ঘোষণা করেন মুসলমানদের মধ্যে সবাই সমান, কেউ ছোট বা বড় নয়। বড় যদি কাউকে হতেই হয়, তাহলে তিনি হবেন তার আখলাক বা উত্তম চরিত্রের কারণে। তিনি আরও বলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবতার জন্য তিনি সর্বশেষ রাসুল আর তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবে না এবং কারও মাধ্যমে ঐশী ওহিও আর অবতীর্ণ হবে না।
এরপর তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। মদিনায় ফিরে আসার অল্প কিছুদিন পরই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় তিনি তাঁর সকল স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সকলের কাছ থেকেই বিদায় নেন। সবশেষে তিনি আসেন তাঁর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ) –এর কাছে, যিনি আবার নবীজির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত আবু বকর (রাঃ) –এর মেয়ে। বিবি আয়েশা (রাঃ) –এর ঘরে থাকা অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
কেউ একজন প্রিয় নবী (সঃ) –এর ইন্তেকালের খবরটি পেয়েই তা উদ্বিগ্ন হয়ে থাকা জনগণকে জানিয়ে দেয়। এই খবরটি লোকমুখে শুনেই রাসুল (সঃ) –এর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সাহাবী হযরত উমর (রাঃ) প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ব্যাক্তিগতভাবে হযরত উমর (রাঃ) ছিলেন মেজাজি একজন মানুষ। তিনি ঘোষণা করে দেন, যে তাঁর কাছে এসে বলবে নবী (সঃ) ইন্তেকাল করেছেন তিনি তাকে তখনই আক্রমণ করে বসবেন।
তারপর নবীজি (সঃ) –এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ সহচর হযরত আবু বকর (রাঃ) বিষয়টা সত্য কিনা জানার চেষ্টা করেন। এক মুহূর্ত পরেই তিনি তাঁর মেয়ে বিবি আয়েশা (রাঃ) –এর ঘর থেকে বেরিয়ে সকলকে জানান, “হে মুসলমানরা তোমরা যারা নবী (সঃ) এর উপাসনা কর, তারা জেনে রাখো মুহাম্মাদ (সঃ) ইন্তেকাল করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত কর, তারা জেনে রাখো আল্লাহ অমর ও চিরস্থায়ী।“
আবু বকর (রাঃ) –এর এই তেজদীপ্ত ঘোষণা হযরত উমর (রাঃ) –এর উত্তেজনা অনেকটাই প্রশমিত করে দেয়। তাঁর মনে হচ্ছিল, তাঁর পায়ের নিচ থেকে মাটি ক্রমশই সরে যাচ্ছে। তিনি প্রচণ্ড লজ্জিতও হন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারণ, তিনি বুঝতে পারেন খবরটা সত্য, আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সত্যি সত্যিই ইন্তেকাল করেছেন। এর সাথে সাথেই মুসলিম উম্মাহ এর উদ্বিগ্নতাও আবু বকর (রাঃ) –এর উপদেশে কমে আসে।
আবু বকর (রাঃ) ছিলেন অত্যান্ত সুমধুর চরিত্রবান ও নরম প্রকৃতির মানুষ। সেই কারণে সমাজে সকলে তাকে অধিক শ্রদ্ধা করে চলত। আর সেই কারণেই রাসুল (সঃ) –এর ওয়াফাতের পরপরই তখনকার উঁচু মর্যাদার ও সম্মানিত সাহাবাগন শীঘ্রই একটি মজলিস গঠন করেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) কে মুসলিম উম্মাহর প্রথম খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করেন। যদিও আবু বকর (রাঃ) প্রথমে এই মজলিসের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করেন এই বলে যে তিনি এই অবস্থানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নন এবং তিনি সেখানে দুই সাহাবীর নাম উল্লেখ করেন এবং তাদের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করার জন্য বলেন তারা হলেন হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এবং হযরত আবু উবাইদাহ (রাঃ) তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবা তাকে অনুরোধ করাতে তিনি মুসলিম সমাজের খলিফা হতে রাজি হন এবং তিনি পরবর্তীকালে নিজেকে একজন সফল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হন।