উত্তরাখণ্ডে মুসলিম উৎখাতনের প্রচারণা
গত বছর উত্তরাখণ্ডের হরিদুয়ার ধর্ম সংসদ প্রচারিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এখনও প্রশমিত হয়নি। ধর্ম সংসদ - নাম শুনে মনে হচ্ছে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি, দেশীয় ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মাধুর্য্য তুলে ধরার মঞ্চ। বিপরীতে, ধর্মের রঙে এটি ছিল রাজ্য থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা; তাদের বিশ্বাসের মাননিন্দা এবং ঘৃণামূলক বক্তব্য ও উস্কানি ছিল মূল সূচিপত্র। অবশ্যই, সাংবিধানিক পদক্ষে সেই উদ্দেশ্যে রুখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিদ্বেষ যখন ফুটে উঠেছে বিষ তখন ছড়াবেই - এবার আরও বৃহৎ আকারে দেবভূমি থেকে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উৎখাতনের প্রচারণা জোর নিয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনা দুটি ছেলেকে অনুসরণ করে শুরু হয় যারা স্থানীয়দের হাতে নবম শ্রেণির একটি মেয়ের সঙ্গে ধরা পড়েছিল বলে অভিযোগ। এই অবসরে পুরোলা অঞ্চলে লাভ জিহাদের অগ্নি ইন্ধন পায় যা ইতিপূর্বেই উত্তরকাশির বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাছাড়া, সরকার কর্তৃক মাজার দখল বিরোধী অভিযানে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ দূষিত হয়।
পোষ্টার প্রচারণা
পরিস্থিতি এবার গুরুতর হয়ে উঠে যখন মুসলমানদের দোকানে দেবভূমি রক্ষ্যা অভিযান কর্তৃক প্যাঁচানো পোস্টারে লেখা হয়, "লাভ জিহাদিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে তারিখ ১৫ জুন ২০২৩-এ মহাপঞ্চায়াত হওয়ার, তোমরা দোকান খালি করে নিবে, নচেৎ তোমাদের এত দ্বারা এটি করা না হলে, (পরিণীতি) সময়ের ওপর নির্ভর করবে।" অনেক মুসলিম পরিবার প্রাণ বাঁচাবার নিমিত্তে গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় প্রত্যাগমন করে।
এখানেই শেষ নয় - মুসলমানদের মালিকানাধীন দোকানগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করে কালো রং দিয়ে ক্রস চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়। ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে দেবভূমিতে সংখ্যালঘুর কোন অধিকার নেই। মুসলমানদের অবস্থান কঠিন হয়ে পড়ে - এক অস্তিত্বগত সংকট। অবশ্যই আইনগত আবেদনের পর রাজ্যের হাইকোর্ট পরিবেশ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয় এবং মহা পঞ্চায়েতের ডাক নিষিদ্ধ করে।
প্রশাসনের অসচেতনতা
একতরফা দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ব্যবস্থার এই প্রতিকূলতা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য কোন ভালো সূচক নয়। দেশের অন্যান্য রাজ্যেও সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে অনুরূপ বিদ্বেষ প্রচারণা দেখা গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় না কেন্দ্র সরকার না রাজ্য সরকার সঠিক কড়া এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছে। বরং অনেক অবসরে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অবহেলা এরকম পরিস্থিতি তৈরিতে উস্কানি হয়ে দাঁড়ায়। দেবভূমি তার ব্যবহারিক অর্থ হারিয়ে ফেলতে চলেছে তবুও প্রশান্তি নিয়ে প্রশাসনের অসচেতনতা ভাঙ্গেনা। আরএসএস এবং বজরং ডালের মধ্যে মুসলিম বিরোধী চরমপন্থী উপাদান দেশের ঐতিহ্যগত ধার্মিক সংহতিকে বার বার বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে। ধর্মনিরপেক্ষতা সামনে রেখে সরকার যে দলেরই হোক না কেন তাকে এই সুন্দর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে হবে।
উত্তরাখণ্ড কেন?
প্রাচীন ইতিহাস থেকে উত্তরাখণ্ড এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে পরিচয় দিয়েছে। ভক্তিভিত্তিক আন্তর্জাতিক পর্যটন স্পট এই রাজ্যের বিশেষ আকর্ষণ। বৌদ্ধ-হিন্দু সংস্কৃতি এবং পরে ইসলামের সুফি পন্থা দেভভূমির এই ছবিকে আরও সুন্দরভাবে রঞ্জিত করেছে। চামোলির বদ্রিনাথ এবং হরিদুয়ারের পিরান কালিয়ার শরীফ কারই বা জানা নয়? পাহাড় স্টেশন মুসৌরিতে দেশের সার্বজনিক নীতি ও লোক প্রশাসনের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (LBSNAA) বা প্রথম জাতীয় উদ্যান জিম করবাট ন্যাশনাল পার্ক একবার ঘুরে আসার স্বপ্ন কেই বা দেখেনা? সাম্প্রতিক আবার দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল ডুবন্ত যোশীমঠের খবর। বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন এক পীড়াদায়ক আতঙ্ক।
কেন্দ্র এবং রাজ্যে দুই সরকারের দড়ি একের হাতে। চাইলে উত্তরাখান্ডকে দেবভূমির আরও সুন্দর ও আকর্ষক রূপ দিতে পারে। গড়ে তুলতে পারে বিশ্বসংস্কৃতির অনন্য এক কেন্দ্র। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সবার মিলে নির্মাণ হবে অভিনব উদাহরণ। কিন্তু তার আগে এই উদ্যেগে ধর্মীয় সম্প্রীতি, পারস্পরিক বোঝাপড়া, বহুসাংস্কৃতিক সংলাপ এবং সকলের প্রতি ভালোবাসা উত্তরাখণ্ডের প্রতীক হওয়া উচিত।