রাহুল গান্ধীর তীব্র অভিযোগ: ভোটে কারচুপি, গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কি অন্ধকারে?

ভূমিকা

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা মূলত নির্ভর করে ভোটার তালিকার সততা, অখণ্ডতা এবং স্বচ্ছতার উপর। ভোটার তালিকার পদ্ধতিগত কারচুপি, প্রভাবিতকরণ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ কেবল নির্বাচন প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ করে না, বরং রাষ্ট্রের মৌলিক গণতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি নাগরিক আস্থা এবং অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকেও গভীরভাবে নাড়া দেয়। সম্প্রতি, ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)-এর প্রতি তীব্র সমালোচনা উত্থাপন করে অভিযোগ করেছেন যে, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP)-র সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কমিশন একটি “প্রাতিষ্ঠানিক চুরি” (Institutionalised Theft) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটার তালিকা প্রভাবিত করছে এবং কার্যত ভোট হরণের কাজে লিপ্ত রয়েছে। আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বিহারের ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা (Special Intensive Revision বা SIR) প্রক্রিয়া এবং কর্ণাটকের মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্রের কথিত ভোটার তালিকা কারচুপি। এই প্রেক্ষাপট নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, ন্যায়নিষ্ঠতা এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ওপর এক গভীরতর বিতর্ক উত্থাপন করেছে, যা ভারতের সমকালীন নির্বাচনী রাজনীতির নৈতিক সংকটকেও প্রতিফলিত করে।

রাহুল গান্ধীর অভিযোগ ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিতর্ক

সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী “বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা” (SIR) প্রক্রিয়াটিকে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এক পরিকল্পিত ও কাঠামোগত হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, কংগ্রেস দলের ছয় মাসব্যাপী অনুসন্ধানমূলক পর্যবেক্ষণে কর্ণাটকের মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্র—যা বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা আসনের অন্তর্ভুক্ত—থেকে বিপুল সংখ্যক ভুয়া সংযোজন শনাক্ত হয়েছে। রাহুল গান্ধীর মতে, SIR প্রক্রিয়াটি কেবলমাত্র ভুল বা জাল ভোটার অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি পরিকল্পিতভাবে বৈধ ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বিয়োজন করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সৃষ্টি করে, যা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মৌলিক অধিকারে সরাসরি আঘাত হানে। ফলত, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটার বঞ্চনার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ন্যায়নিষ্ঠতা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

গান্ধীর অভিযোগ অনুযায়ী, ভারতের নির্বাচন কমিশন “প্রকাশ্য যোগসাজশে” ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র সঙ্গে মিলিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে দরিদ্র ও প্রান্তিক ভোটারদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে এবং কার্যত “ভোট চুরি” সংঘটিত করছে। তিনি পাঁচটি প্রধান কৌশল চিহ্নিত করেছেন, যেগুলির মাধ্যমে এই কারচুপি সংঘটিত হচ্ছে— 

১. যমজ ভোটার

২. ভুয়া ও অবৈধ ঠিকানা

৩. একক ঠিকানায় বিপুলসংখ্যক ভোটার

৪. অবৈধ আলোকচিত্র

৫. ফর্ম ৬-এর অপব্যবহার, যা নতুন ভোটার নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত।

তাঁর উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, কেবলমাত্র কর্ণাটকের মহাদেবপুরা কেন্দ্রেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এক লক্ষ দুই শত পঞ্চাশটি “ভুয়া” ভোট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—যে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জয়লাভ করেছে। গান্ধীর মূল্যায়ন অনুসারে, এ ধরনের প্রক্রিয়া সারা দেশের একশোরও অধিক সংসদীয় আসনে সংঘটিত হয়েছে। তাঁর দাবি, যদি এই কারচুপি না ঘটত, তবে নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসতে পারতেন না; বরং ‘ইন্ডিয়া’ জোট কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করত। 

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংকট: নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা

গান্ধীর সমালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত স্বচ্ছতাবিরোধী মনোভাব। তিনি অভিযোগ করেন, কমিশন ভোটার তথ্য মেশিন-পঠনযোগ্য (Machine-readable) এবং ডিজিটাল আকারে প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করছে, যা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র যাচাই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি আরও বলেন যে, ভোটকেন্দ্রগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ (CCTV Footage) মাত্র পঁইতাল্লিশ দিনের মধ্যে ধ্বংস করা হয়, যা ভোট কারচুপির প্রমাণ সংরক্ষণ থেকে বিরত থাকার সচেতন প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাহুল গান্ধী নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা প্রদান করেন যে, এ ধরনের কার্যকলাপ “দেশবিরোধী” এবং এক সময় অবশ্যই আইনগত দায়িত্বের আওতায় আসবে।

কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক কে.সি. বেণুগোপাল জানান, রাহুল গান্ধীর ভিডিও উপস্থাপনাটি দেশব্যাপী প্রদর্শিত হবে এবং আগামী সোমবার দলের দায়িত্বশীল নেতাদের এক সভায় এই ইস্যুতে কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। এই ঘোষণার মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে কংগ্রেস দল এই বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন অনিয়ম বা একক ঘটনা হিসেবে নয়, বরং একটি পদ্ধতিগত গণতান্ত্রিক সংকট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানিক বিশ্বাসহীনতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া

প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই অভিযোগসমূহ ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান কাঠামোর গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। সংবিধান-প্রদত্ত স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা কেবলমাত্র কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর নয়, বরং দৃশ্যমান পক্ষপাতহীনতার ওপরও নির্ভরশীল। যদি বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা (SIR) প্রক্রিয়া মতো ভোটার তালিকা সংশোধন ব্যবস্থা সহজেই অপব্যবহারযোগ্য হয়, তাহলে তার প্রভাব কেবল দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বৈধতা ও স্বচ্ছতাকেও গভীরভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।

সমালোচকদের মতে, ভোটার তালিকায় ভুল সংযোজন অযোগ্য ও অবৈধ ভোটারের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জাল ভোটের প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে। অপরদিকে, ভুল বিয়োজন প্রক্রিয়া প্রান্তিক, দরিদ্র এবং সংবিধানগতভাবে সংরক্ষিত জনগোষ্ঠীদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চনার মাত্রা অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি করে। ভারতের মতো বহুপ্রজাতান্ত্রিক ও বৈচিত্র্যময় সমাজে, যেখানে ভোটার পরিচয়পত্রের গ্রহণযোগ্যতা ও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশাধিকার এখনও সমানভাবে বিতরণ হয়নি, সেক্ষেত্রে এই ধরনের অব্যবস্থাপনা নির্বাচনী অংশগ্রহণের ভিত্তিকে দুর্বল করে এবং প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে। ফলস্বরূপ, গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রকৃতিপ্রকরণ ও জনসাধারণের আস্থা ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়, যা একটি সুস্থ ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।

রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সংকটের জটিলতা

গান্ধীর অভিযোগ সত্য হলে, তা ক্ষমতাসীন দল তথা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনী ন্যায্যতার গঠনমূলক অবক্ষয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করবে। “প্রাতিষ্ঠানিক চুরি” শব্দবন্ধের মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল নির্মাণ করছেন না, বরং নাগরিক সচেতনতা ও জনমত সক্রিয়করণের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, একশোরও অধিক সংসদীয় আসনে একই ধরনের ভোট কারচুপি ও ভোটার তালিকা সংশোধনের অপব্যবহার ঘটেছে, যা ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় জনতাবাদী জোট (NDA) ও বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে নতুন মাত্রা প্রদান করেছে। এই প্রসঙ্গে, ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের সূচনা হয়েছে।

তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা এই গণতান্ত্রিক সংকটের সমাধানকে জটিলতর করে তুলছে। যদিও বিরোধী দলগুলো এই ইস্যুকে ক্ষমতাসীন দলের শাসন বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, নির্বাচন কমিশনের আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বচ্ছতার অভাব থাকলে তা পক্ষপাতের ধারণাকে অধিকতর শক্তিশালী করতে পারে। ফলস্বরূপ, নির্বাচন সংক্রান্ত বিতর্ক ও অবিশ্বাস বৃদ্ধিপেতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্থায়িত্ব ও শুদ্ধতা হুমকির মুখে ফেলে।

উপসংহার

বিহারের বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা (SIR) প্রক্রিয়া এবং কর্ণাটকের ভোটার তালিকা কারচুপি বিতর্ক দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক আস্থার সূক্ষ্ম এবং ভঙ্গুর ভারসাম্যকে গভীরভাবে প্রমাণ করে। রাহুল গান্ধীর অভিযোগ এবং কংগ্রেস দল কর্তৃক সংগঠিত সমন্বিত প্রচারণা শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী ত্রুটির বিষয় নয়, বরং ভোটার তালিকার সততা ও স্বচ্ছতার বিষয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই ধরনের অভিযোগসমূহ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি তোলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মঞ্চে একটি জটিল শক্তি সংগ্রামের রূপ নিতে পারে। ভবিষ্যতে এই বিতর্ক কি ইলেকশন কমিশন ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত এবং প্রয়াসের মাধ্যমে একটি গঠনমূলক সংস্কারে রূপ নেবে, নাকি এটি কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে হারিয়ে যাবে, তা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ়তার ওপর নির্ভর করবে। এই প্রশ্নটি কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করে না; বরং এটি ভারতের সংবিধানিক গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক নীতির—যে প্রতিটি যোগ্য নাগরিকের ভোট সমান মর্যাদা এবং গুরুত্ব পাবে—সুরক্ষার প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতি জনসাধারণের আস্থা বজায় রাখা এবং উন্নত করার জন্য এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অত্যন্ত জরুরি।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter