ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবনতি: ২০২৪ সালের USCIRF প্রতিবেদন ও সাম্প্রতিক সহিংসতার বিশ্লেষণ

সম্প্রতি কালে ভারতবর্ষে ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বৃহস্পতিবারই অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (USCIRF) এর সর্বশেষ প্রতিবেদন জারি করেছে যেখানে ভারতকে ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এবং উদ্বেগজনক বলে আখ্যায়িত করেছে। যদিও ভারত সরকার এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে যে তথ্য প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছে খুবই সংবেদনশীল এবং ২০২৩ এর শুরু থেকে আজ অবধি ভারতবর্ষে ঘটতে দেখা যায়। চলুন আজকের এই প্রবন্ধে সেই রিপোর্টের তথ্যগুলি যাচায় করে দেখি। 

USCIRF সংস্থা 

ইউনাইটেড স্টেট কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজেস ফ্রিডম বা USCIRF হচ্ছে অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি সংস্থা যা ১৯৯৮ এর আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার এক্ট (ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিওস ফ্রিডম অ্যাক্ট অফ 1998) এর আওতায় স্থাপন করা হয়েছিল। ইউএসসি আইআরএস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং প্রতিনিধি সভা দ্বারা ১৪ জন নির্বাচিত মেম্বারের একটি সংগঠন, যাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে; আন্তর্জাতিকভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনা ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা এবং রাষ্ট্রপতি, সেক্রেটারি অফ স্টেট এবং কংগ্রেসের কাছে নীতিগত সুপারিশ করা, যাতে তারা সেই সমস্যার সমাধানের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই সংস্থার বর্তমান সভাপতি যিনি ২০২৬ সালে অবসর নেবেন তিনি হলেন স্টিফেন এফ স্নেক।

এই সংস্থা সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ, ২০২৩-২৪ এর ধর্মীয় স্বাধীনতা উলঙ্ঘনের রিপোর্ট পেশ করেছে যে প্রতিবেদনটি ভারত, চাইনা, বর্মা, আফগানিস্তানের  পাশাপাশি অন্যান্য অনেক দেশের মিডিয়াতেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।  




USCIRF ২০২৪ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ

 

এই প্রতিবেদনে ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকার অনেক দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয় লক্ষ্য করে  বিভিন্ন দেশকে দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে; বিশেষ উদ্বেগের দেশ বা কন্ট্রিস অফ পার্টিকুলার কন্সার্ন Countries of Particular Concern এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল ওয়াচ লিস্ট।  প্রথম ক্যাটাগেরির মধ্যে সেই দেশগুলির নাম রয়েছে যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং একটি গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বা সেসব দেশ, যেখানে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় অন্য ধর্মকে নির্মূল করার চেষ্টা চলছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রচেষ্টার মাধ্যমে এক ধর্ম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা হচ্ছে। 

এই ক্যাটাগেরিতে আফগানিস্তান, আজারবাইজান, বার্মা, কিউবা, চীন ও ইরিত্রিয়ার পর ভারতের নাম সাত নম্বরে রয়েছে, যা ইরান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, তাজিকিস্তান, রাশিয়া, সৌদি আরবের চেয়েও পূর্বে এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে।     

দ্বিতীয় ক্যাটাগেরিতে সেই দেশগুলো রয়েছে যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা উলঙ্ঘন তো হয়েছে কিন্তু এমন চরম অবস্থায় নয়, আর সেই দেশের সরকার গুলো এই ধরনের সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত। আলজেরিয়া, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, তুরস্ক, মালাসিয়া সহ বিভিন্ন দেশের নাম এই ক্যাটাগেরিতে রয়েছে।

USCIRF ২০২৪ এ প্রকাশিত প্রতিবেদন

২০২৩ সালে, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিন প্রতিদিন হ্রাস পেয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে সরকার, বৈষম্যমূলক জাতীয়তাবাদী নীতিকে শক্তিশালী করার ইচ্ছায় অন্যান্য ধর্মকে ছেঁদো করে ফেলেছে, চিরস্থায়ী ঘৃণাপূর্ণ বক্তৃতা, এবং মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, দলিত, ইহুদি আর আদিবাসীদের অসমনুপাতিকভাবে প্রভাবিত করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে।     

বেআইনি অব্যাহত প্রয়োগ কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন বা Unlawful Activities Prevention Act  (UAPA), বিদেশী অবদান প্রবিধান আইন বা  Foreign Contribution Regulation Act (FCRA), নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা Citizenship Amendment Act  (CAA), ধর্মান্তর বিরোধী এবং গোহত্যা আইনের ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্বিচারে আটক, নজরদারি এবং টার্গেট করা হয়েছে।  

Foreign Contribution (Regulation) Act বা FCRA হলো ভারতের একটি আইন, যা ব্যক্তিদের, কোম্পানির এবং সংস্থার দ্বারা বিদেশি অনুদান গ্রহণ ও ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ করে। এর মূল লক্ষ্য হলো যে এই নিশ্চিত করা যে বিদেশি তহবিল ভারতের সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা অখণ্ডতায় কোনো ক্ষতি না করে। এই আইনটি আসলে ভারতীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের কল্যাণমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সহায়তা করার জন্য তৈরি হলেও, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার FCRA লাইসেন্স বাতিল করে। এছাড়া, এই খবরটি রিপোর্ট করার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং স্বাধীন ইউটিউবারদের হুমকি দেওয়া হয়।

তদ্রূপ, ভারতীয় সরকার কর্তৃপক্ষ নিউজক্লিকের সাংবাদিকদের বাড়িতে অভিযান চালায়, যার ফলে সংস্থার এক রিপোর্টার তিস্তা সেতলভাদের বাড়িও ভাঙচুর করা হয়। তিনি মূলত ২০০২ সালের মুসলিম-বিরোধী গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য এই ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন।    

বেসরকারী সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শুধুমাত্র খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ৬৬৮টি ঘটনা ঘটেছে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসে হিন্দু চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলি ছত্রিশগড় রাজ্যে বেশ কয়েকটি গির্জায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে এবং খ্রিস্টানদের জোরপূর্বক হিন্দু ধর্মে পুনরায় রূপান্তর করার চেষ্টা করে। প্রায় ৩০ জনকে ধর্মত্যাগ করতে অস্বীকার করার কারণে মারধর করা হয়। দু’মাস পর, দুই খ্রিস্টানকে জামিন ছাড়াই আটক করা হয় এবং তফসিলি উপজাতির মানুষদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও অব্যাহত থাকে।

২০২৩ সালের জুন মাসে ৫০০-র বেশি খ্রিস্টান গির্জা এবং দুটি ইহুদি উপাসনালয় ভাঙচুর করা হয়েছে। মণিপুরের সহিংসতার কারণে ৭০ হাজারের বেশি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী দুজনেই তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন।

ডিসেম্বর মাসে কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন প্রদানকারী ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এবং এই বিষয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে বিভিন্ন সাংবাদিককে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক, এরফান মেহরাজ, যিনি কাশ্মীরের মুসলিমদের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন, তাকে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় পুলিশ আটক করেছে।

মুসলিম বিরোধী ঘটনাগুলির বিবারণ 

বছরজুড়ে মুসলমানদের ওপর সহিংসতা এবং তাদের উপাসনালয়গুলোর ওপর হামলা অব্যাহত ছিল। বেশ কয়েকটি মসজিদ ধ্বংস করা হয়, এবং পুলিশের উপস্থিতি ও তদারকির অধীনে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। "গরু রক্ষা" করার ছদ্মবেশে মুসলমানদের টার্গেট করা হয়, এবং উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা সহ ১৮টি রাজ্যে এই কর্মকাণ্ড বেআইনি বলে বিবেচিত হয়েছে।

হরিয়ানার মুসলিম অধ্যুষিত নুহ জেলায়, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে একটি হিন্দু মিছিলের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়, যেখানে তরবারি বহনকারী অংশগ্রহণকারীরা মুসলিম-বিরোধী স্লোগান দিতে আরম্ভ করে। এই সহিংসতায় মুসলমানদের সমাধি ও মসজিদে অগ্নিসংযোগ করা হয়, যার ফলে ইমাম মোহাম্মদ হাফিজসহ অন্তত সাতজন নিহত হন।

এই সহিংসতার পেছনে আংশিকভাবে সুপরিচিত গো-রক্ষক মনু মানেসার দায়ী ছিল, যে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দুই মুসলিম পুরুষকে হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। বিজেপি পার্টির সমর্থনে সে মিছিলের আয়োজন করে এবং মুসলিমদের প্রতি হিংসাত্মক ভাষণ দেয়। 

উপসংহার 

ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। USCIRF ২০২৪ সালের প্রতিবেদন এবং সাম্প্রতিক ঘটনার বিশ্লেষণ আমাদের জানাচ্ছে যে, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, দলিত, এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নানা ধরনের সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ভারতীয় সরকারের নীতিমালার অব্যাহত পরিবর্তন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর চাপও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

এমন পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ভারত সরকারের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার দাবি জানানো এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর অধিকার সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। ধর্মীয় স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি মৌলিক মানবাধিকার নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই সকলের জন্য নিরাপদ ও স্বাধীনভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।


Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter