ইসলামে সন্তানের সঠিক লালন-পালন ও শিক্ষা: নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক

ইসলাম সন্তানের লালন-পালনকে এক মহান দায়িত্ব ও আমানত হিসেবে দেখেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, “জেনে রেখ তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা”। অর্থাৎ, সন্তানরা শুধুমাত্র আনন্দের উৎস নয়, তাদের প্রতিপালন মধ্য দিয়ে অভিভাবকদের ঈমান এবং দায়বদ্ধতা পরখ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ গৃহবন্দীর রক্ষক এবং দায়িত্ব শীল। এই দিকনির্দেশনা স্পষ্ট করে দেয় যে, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের দায়িত্ব অপরিসীম। শিশুরা তাদের শৈশবে যে আদর্শ পায়, তা পরবর্তী জীবনে ছাপ রেখে যায়। অতএব, শিশু পিতা-মাতার প্রথম শিক্ষা-নিকেতন; তাদের মধ্যে যে মূল্যবোধ, চরিত্র ও বিশ্বাস গড়ে ওঠে, তা পরিবার থেকেই শুরু হয়। পরিবারে আদর্শ ও মহব্বতের পরিবেশ না থাকলে সন্তান বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকি প্রবল হয়।

পারিবারিক শিক্ষা ও নৈতিক আদর্শ

ইসলামে পরিবারকে সন্তানের প্রথম স্কুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। নবীজির (সা.) এই হাদীস স্মরণযোগ্য: “প্রত্যেক নবজাতক ইসলামি স্বভাব (ফিতরাত) অনুযায়ী জন্ম নেয়; অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খ্রিস্টান অথবা অন্যান্য পথের লোক বানায়”। অর্থাৎ শিশুর আদিম প্রকৃতি নিষ্পাপ এবং সৎ চরিত্র নিয়েই শুরু হয়; তাই পিতা-মাতার আদর্শ আচরণ ও প্রশিক্ষণই শিশুর চারিত্রিক ভিত্তি গঠন করে। মাওলানা ইমরান হুসাইন লিখেছেন, মাতাপিতার করুণাময় স্নেহ আর আদরশীল আচরণ শিশুর হৃদয়ে আনন্দ ও নিরাপত্তার বোধ সৃষ্টি করে, যা তার মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। স্বাভাবিকভাবেই দম্পতি সদয় এবং ধার্মিক হলে, তাদের শিশুরাও সেই গুণ ধারণ করে। অপরদিকে, নিষ্ঠুরতা, অবহেলা ও সহিংসতা শিশুর মধ্যে মানসিক জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা বড় হয়ে সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। অতএব, পিতা-মাতার প্রথম কর্তব্য হলো সন্তানের প্রতি কোমলতা, মমতা ও আদর প্রদর্শন করা; শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা, আলাপ-আলোচনা এবং স্নেহপূর্ণ মিশ্রণে ব্যস্ততার মধ্যে সময় দেওয়া।

ইসলামের শাস্ত্রে সন্তানের প্রতি ভাল আচরণ ও সদ্ব্যবহার নির্দেশিত রয়েছে। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী, “উত্তম শিষ্টাচার শেখানোর চেয়ে বড় দান কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য করতে পারে না”। অর্থাৎ, পিতা-মাতা শেখানো আদব-কায়দা, ভদ্রতা ও সৎ আচরণই আসল সম্পদ। নবীজির (সা.) আদর্শ থেকে দেখা যায় যে তিনি নাতি হাসানকে চুমু দিয়ে আশীর্বাদ করতেন এবং কখনো শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর হতেন না। একবার আকরা ইবন হাবীশ্ উল্লেখ করেছিল তার দশ সন্তান থাকে কিন্তু তিনি কাউকে আদর করতেন না; তখন নবীজির (সা.) জবাব করেছিলেন, “যে ব্যক্তি দয়া প্রদর্শন করে না, সে দয়ার প্রাপ্যও হতে পারে না”। এই শিক্ষা স্পষ্ট করে যে, সন্তানের প্রতি উদারতা ও দয়াশীল আচরণ পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আল্লাহর রহমতের অন্যতম মাধ্যম।

পিতা-মাতার দাওয়া এবং দায়িত্ব পালনের গুরুত্বও ইসলামে আলোচিত। রূপকভাবে বলা হয়, পিতা-মাতা সন্তানদের জন্য নিজ জীবনের ত্যাগ করেন; তাই তাদের কল্যাণের জন্য তাদের দোয়া সবসময় আল্লাহ কবুল করেন। পরিবারে পারস্পরিক মানসিক বন্ধন ও আধ্যাত্মিক সহায়তা গড়ে তোলা শিশুর আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক চেতনা বিকাশে সহায়ক। ইসলামে হারমোনিয়াস পরিবারের প্রতিষ্ঠাই আদর্শ মনে করা হয়েছে, যেখানে প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করে, যেমন নবীজির (সা.) হাদীসে ইঙ্গিত আছে: “প্রত্যেকেই রাঈ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল”।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রেরণা

শিশুরা যখন বুঝতে পারে, তখন থেকেই তাদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঈমানপ্রযুক্তি সৃষ্টি করা উচিত। ইসলামে মুসলিম শিশুকে প্রথম শিক্ষা হিসেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ দেওয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, “শিশুর প্রথম শিক্ষা হোক ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’”। শিশুকে সহজ করে-সরল ভাষায় আল্লাহর একত্ববাদ শেখানো এবং তাকে নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদত পরিষ্কারভাবে বোঝানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, সাত বছর বয়সে সন্তানদের নিয়মিত নামাজ আদায় করা শেখাও; দশ বছর হলে পর পরাজ্ঞা দিয়ে না পড়লে শাস্তি প্রদান করো। এ নির্দেশনা থেকে বুঝা যায় কিভাবে ইসলামে শৈশবে ধৈর্যশীল শিক্ষা আর প্রয়াসের মাধ্যমে প্রাথমিক আল্লাহতত্ত্ব শেখানো হয়।

শিশুর চরিত্রে ইসলামের নৈতিক আদর্শ এবং সূরা-হাদীসের ভিত্তিতে মৌলিক ধারণাগুলো গোপন করা অন্যতম লক্ষ্য। ইসলামে কোরআনের আয়াত এবং নবীজির (সা.) সুন্নাহ অনুযায়ী সুন্দর চরিত্র (আখলাক) গঠন করানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে সন্তানদের তিনটি গুণে আদব পাঠাও: তোমাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা, তাঁর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা ও কোরআন পাঠের প্রতি অনুরাগ। মূলত, পিতা-মাতার কর্তব্য হলো সন্তানকে ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলা, যাতে সে মিথ্যা, অন্যায়, বিদ্বেষের মতো নৈতিক দুর্বৃত্তির পথ পরিহার করে। পরিবার এবং মাদ্রাসার চর্চার মাধ্যমে শিশুর হৃদয়ে আল্লাহভীতি, পরকালীন জবাবদিহিতা ও মানবকল্যাণের বোধ সৃষ্টি করা হয়, যা তার চিরস্থায়ী আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

আধুনিক যুগের শিক্ষা ব্যবস্থাও ইসলামের সঙ্গে সংমিশ্রিত হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে শিশু ও কিশোরেরা সাধারণ বিদ্যালয় বা কলেজে পড়ালেখা করেন। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে পিতা-মাতার কর্তব্য হচ্ছে পর্দা-শিক্ষা, কুরআন ও সীরাতের শিক্ষা বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে শিশুদেরকে সুশৃঙ্খল ও নৈতিক চরিত্রে গড়ে তোলা। উভয় ক্ষেত্রের মাঝে সমন্বয় করে শিশুকে প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামী আদর্শে অনুধাবন করিয়ে দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, স্কুলে গণিত বা বাংলা শিখলেও, সন্ধ্যায় সে কোরআন বা নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার শিক্ষা পাওয়া প্রয়োজন।

আধুনিক পৃথিবীতে শিশু ও প্রযুক্তি বিষয়ক চ্যালেঞ্জ

সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের যুগে সন্তানের লালন-পালন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এখন অধিকাংশ পরিবারই নূন্যতম পরিবার কাঠামো, যেখানে দুজন পিতা-মাতা চাকরিজীবী। এর ফলে সন্তানদের জন্য গুণগত সময় দেয়ার তাগিদ ও বাড়তি চাপ দেখা দেয়। অনেক পরিবার শিশুকে নিরাপত্তায় রাখতে স্মার্টফোন কিংবা ইন্টারনেট সুবিধা দিয়ে দেয়, কিন্তু ফলাফল বিপরীত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত আসক্তি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং মনোযোগশীলতা, স্মৃতিশক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে। মুসলমান পিতা-মাতার উচিত শিশুকে আধুনিক প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার শিখানো এবং অশ্লীল বা অপ্রয়োজনীয় কনটেন্ট থেকে দূরে রাখা।

ডিজিটাল যুগে ইসলাম আমাদের গোপনীয়তা ও সত্যনিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে। তাই অনলাইনে শিশুদেরকে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় অনুসন্ধান না করা, মিথ্যা তথ্য না ছড়ানো এবং সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করার শিক্ষা দেয় ইসলামের নির্দেশনা। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক”। শিশুদের মধ্যে এই আদেশমালা এবং উদার মূল্যবোধ গড়ে তুলে দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, বর্তমান স্কুল-শিক্ষা সিস্টেমেও মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য আল্লাহর নিকট আনুগত্য, সহমর্মিতা এবং চরিত্রসংহতি বিষয়ক পাঠক্রম সংযোজন করা যেতে পারে।

আধুনিক যুগে পরিবার পরিবর্তনশীল হলেও ইসলামিক আদর্শ অপরিবর্তিত দিশারী। শিশুদেরকে মনে করিয়ে দিয়ে বলা হয় যে, মহানবী (সা.) ছিলেন শিশুদের জন্য সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তিনি নিজে সদা দয়া-দক্ষতায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে মুসলিম পরিবার আজকের দিনেও সেই আদর্শ অনুসরণ করে সন্তানদের প্রতি আন্তরিক মমতা প্রদর্শন এবং তাঁদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে সমস্ত চেষ্টা চালায়।

উপসংহার

সার্বিকভাবে, ইসলাম সন্তান লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষায় পূর্ণাঙ্গ নীতিনির্দেশনা দিয়েছে। কোরআন ও হাদীসে সন্তানকে আল্লাহর আমানত ও পরীক্ষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই মা-বাবার প্রতি রয়েছে দারুণ দায়িত্বশীলতা – নৈতিক আচরণ, স্নেহ ও আদর্শের মাধ্যমে সন্তানের চরিত্র গঠন করা। একই সাথে শিশুকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও আমল শেখানো (যেমন শিরকের বিরুদ্ধে ঈমান, নামাজ ও কোরআন) তার আধ্যাত্মিক ভিত্তি সুদৃঢ় করে। আধুনিক পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ ও প্রযুক্তির যুগেও এই ইসলামী শিক্ষাই পথ প্রদর্শক, যা শিশুদেরকে সৎ, সহিষ্ণু ও আল্লাহভীতিশীল করে গড়ে তোলে। পরিশেষে বলতে পারি, সন্তানের সঠিক লালন-পালন ও শিক্ষা যখন নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিকই জোরালো করে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি পরিপূর্ণ একজন মুসলিম হিসেবে সমাজকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter