সীমাঞ্চলের রাজনৈতিক জাগরণ: বিহারের নতুন ক্ষমতাভূমির উত্থান
বিহারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রূপান্তর যেন এক নীরব জনপদের দীর্ঘনিশ্বাস ভেঙে উচ্চারণে রূপ নেওয়ার মুহূর্ত, সীমাঞ্চলভূমির বহুদিনের অলক্ষিত ক্ষোভ, উপেক্ষা ও আত্মসংগ্রহ একযোগে মিলিত হয়ে ২০২৫ সালের নির্বাচনে এক অভুত্থানী রাজনৈতিক পরিচয় রচনা করেছে। যে অঞ্চল কখনো প্রান্তে ঠেলে রাখা হত, সেই অঞ্চলই আজ বিহারের ক্ষমতার মানচিত্রে নতুন দিকরেখা আঁকছে। AIMIM-এর উত্থান, প্রচলিত জোট-সমীকরণের ভাঙন, প্রতিনিধিত্বের দাবির উন্মোচন এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংবেদনশীলতার পুনর্মূল্যায়ন, সবকিছু মিলিয়ে সীমাঞ্চলভূমি যেন ঘোষণা করছে এক নতুন প্রভাতের সূচনা: “আমরা আর কারও ছায়া নই; আমরা আমাদের রাজনৈতিক আলো নিজেরাই সৃষ্টি করব।” এই রূপান্তরের কণ্ঠস্বরই হলো বিহারের নতুন মেজাজ, এক নবজাগরণের দিগন্ত, যা শুধু নির্বাচনের ফল নয়, একটি অঞ্চলের আত্মপরিচয়ের জাগরণও বটে।
বিহারের রাজনীতির সার্বিক নাড়ি স্পর্শ করলে সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ২০২৫ সালের নির্বাচন কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর কিংবা নেতৃত্বের পালাবদলের সাধারণ ঘটনা নয়; বরং এটি এমন এক ভৌগোলিক জনপদের আত্মপ্রত্যয়ের ঐতিহাসিক উত্থান, যে জনপদ যুগের পর যুগ নিজের ন্যায্য দাবিকে নির্বাক সহিষ্ণুতার আচ্ছাদনে চাপা দিয়ে রেখেছিল। বহুদিনের সেই অনুচ্চারিত স্বর এ বার প্রতিবাদের দৃঢ়তায় উচ্চারিত হয়েছে, ঘোষণা করেছে যে সীমাঞ্চল আর বিহারের প্রান্তরেখায় লুকিয়ে থাকা কোনো ছায়া অঞ্চল নয়; সে এখন পূর্ণ রাজনৈতিক সত্তা, সুস্পষ্ট ভূমিকা এবং আত্মমর্যাদার দৃঢ় ভিত্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
যে সীমাঞ্চল একসময় সংবাদপত্রের শেষ পাতার সংক্ষিপ্ত বিবরণে সীমাবদ্ধ থাকত, কোনো মন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় কয়েকটি নিরুত্তাপ বাক্যে উল্লেখ পেত, কিংবা প্রশাসনিক নথির প্রান্তে নামমাত্রভাবে স্থান পেত, সেই অঞ্চল আজ প্রত্যয়ভরে জানিয়ে দিচ্ছে— “এইবার যথেষ্ট। আমরা আমাদের ইতিহাস নিজেদেরই হাতে রচনার অধিকার প্রতিষ্ঠা করব।”
২০২০ সালের ফলাফলের পর ২০২৫ সালে AIMIM-এর পুনরুত্থান এই বৃহত্তর পরিবর্তনের সুস্পষ্ট নিদর্শন। সীমাঞ্চলের জনগণ এ বার কেবল ভোটদাতা হিসেবেই উপস্থিত হয়নি; বরং তারা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রবাহের নির্মাতা, নতুন ভাবনার বাহক এবং রাজনীতির দিকরেখা নির্ধারণের এক স্বতন্ত্র শক্তিকেন্দ্র।
সীমাঞ্চলের এই উত্তরণ কোনো বিশেষ দলের বিজয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি দীর্ঘদিনের উপেক্ষা, অসম প্রতিশ্রুতি এবং অবহেলিত বাস্তবতার বিরুদ্ধে জনমনের সঞ্চিত যন্ত্রণার প্রতিক্রিয়া। পূর্ণিয়ার (purnia) আর্দ্র বাতাস হোক কিংবা কিশনগঞ্জের প্রভাত— গলি, চত্বর, চায়ের আড্ডা— সবখানেই একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি নির্বাচনের সময় আমরা স্মরণীয়, বাকিটা বছর আমরা ভোলানো।
মানুষের রাজনৈতিক স্মৃতি ভুলে যায়নি যে লালুপ্রসাদের দীর্ঘ পনেরো বছরের শাসন হোক, কিংবা নীতীশ কুমারের দুই দশকের উন্নয়ন-আখ্যান, কোনো রূপেই সীমাঞ্চলের মৌলিক পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিশ্রুতির বন্যা এসেছে, কাগুজে প্রকল্পের সারি নেমেছে; কিন্তু বাস্তবের ক্ষেত্রফলে সেই প্রকল্পের ফলশস্য কোনোদিন সুলভ হয়নি। বন্যার ঢেউয়ের সঙ্গে জনপদ তলিয়ে গেছে, কর্মসংস্থানের আলো বহু আগেই ম্লান হয়ে পড়েছে, আর চিকিৎসার সন্ধানে পাটনার দূরত্ব যেন হয়ে উঠেছে এক অন্তহীন পরিভ্রমণ। এই পরিস্থিতিতে AIMIM-এর উত্থান নিছক রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি ছিল মানসিক মুক্তির এক নবজাগরণ। সাধারণ মানুষ অনুভব করতে শুরু করল “কেউ আছে, যে কেবল বক্তৃতার ভাষা জানে না, আমাদের আঙিনার মাটি, আমাদের দুঃখ, আমাদের প্রতিদিনের সংগ্রামও বোঝে।”
ফলে ২০২৫ সালের ফলাফল যখন AIMIM-কে আবারও দৃঢ় অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করল, তখন একে কেবল ভোটের অভিমুখ নয়, বরং নবগঠিত রাজনৈতিক চেতনাজাগরণের প্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়া উপায় রইল না। অন্যদিকে বহুদিন ধরে প্রচলিত RJD–এর পরিচিত “গণসমীকরণ”, যা একসময় বিহার রাজনীতির অপ্রতিরোধ্য সূত্র হিসেবে বিবেচিত হত এইবার সীমাঞ্চলের মানুষ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল যে তার কার্যকারিতা এখন কেবল অতীতের এক কিংবদন্তি। প্রতিনিধিত্বের অভাব, বাস্তব উন্নয়নের শূন্যতা, সামাজিক–আর্থিক কাঠামোয় কোনো মৌলিক পরিবর্তন না আসা, এসবই মানুষের মননে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ফলে তারা ঘোষণা করল “আমরা আর সমীকরণের অঙ্ক নই; প্রকৃত প্রতিনিধিত্বই আমাদের সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবে।”
AIMIM-এর মাত্র কয়েকটি আসনের যুক্তিসংগত দাবি RJD যেভাবে অগ্রাহ্য করল, তা বহু ভোটারের মনে বঞ্চনা ও উপেক্ষার তীব্র অনুভূতি জন্ম দিল। তারা উপলব্ধি করল যে, “আমাদের ভূমি, আমাদের প্রশ্ন, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে আমাদের অনুপস্থিতিতেই।” এই মানসিক প্রতিক্রিয়ার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ভোটের ফলাফলে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, AIMIM-কে যে বহুক্ষেত্রে কোনো প্রধান দলের ছায়া-রাজনীতি বলে প্রচার করা হয়, তার ভিত্তি নির্বাচন কমিশনের বুথ-তথ্যের বিশ্লেষণে দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৫, ২০২০ ও ২০২৫ এই তিন পর্বের ধারাবাহিক ফলাফল স্পষ্ট করে যে দলটির ভোট অন্য কোনো দলের ভাঙন নয়; বরং এটি এক স্বতন্ত্র স্বর, এক আঞ্চলিক আত্মপরিচয়ের উত্থান, এবং স্থানীয় অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠা স্বকীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন।
সীমাঞ্চলের পথেঘাটে আজ কথোপকথনের ভাষাই বদলে গেছে। মানুষ বলছে “আমরা কারও ভোট-ভাণ্ডার নই; আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই রচনা করব।” এই উচ্চারণ আবেগপ্রবণ হলেও এটি একইসঙ্গে রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপক্বতা এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
২০২৫ সালের নির্বাচনী ফলাফল জানিয়ে দিল যে বিহারের রাজনীতি আর কেবল পাটনার ক্ষমতা-কেন্দ্রেই গঠিত হবে না; সীমাঞ্চলের অভিমতও সমান গুরুত্বে রাজনীতির পথরেখা নির্ধারণ করবে। বৃহত্তর দলগুলোকে এখন স্বীকার করতে হবে যে এই অঞ্চল শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সত্তা, নিজস্ব ভূগোল, নিজস্ব প্রশ্ন এবং দৃঢ় আত্মপরিচয় নিয়ে।
এই সময় তাই কেবল AIMIM–এর সাফল্যের কাহিনি নয়; এটি সীমাঞ্চলের স্বশাসন চেতনার নবোদিত অধ্যায়, এক নীরব বিপ্লবের সূচনা, যার ভাষ্য তারা নিজেরাই লিখছে। সীমাঞ্চল আজ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে “আমরা কারও ছায়া নই; আমরা আমাদের আলো নিজেরাই নির্মাণ করব।” এবং এই ইতিহাস–রচনার যাত্রা এখনো কেবল শুরু মাত্র।