নবীজির (ﷺ) মহৎ চরিত্র (৪): শান্তি এবং সহনশীলতা 

বর্তমান পরিবেশে শান্তির হাঁক প্রচন্ড প্রতিধ্বনিত কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পরিণতিতে দুর্নীতি, জবরদস্তি, নিপীড়ন এবং অত্যাচার আর কিছু নয়। ডাক দে শান্তি-প্রচারকদের  - দেখ একবার নবী  (ﷺ) কেমন ছিলেন শান্তি-সংরক্ষক।     

   নবী-উস-সালাম অর্থাৎ শান্তির দূত উপাধিতে আখ্যায়িত হযরম মুহাম্মদ (ﷺ) শান্তি ও সহনশীলতা প্রচারে  যে বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করেছেন তা সর্বকালের জন্য সার্বজনীনভাবে অনুকরণীয়। নবী (ﷺ) নির্মিত দারুস সালাম যথা শান্তির ভূবনে আজকের সকল প্রকারের ব্যাধির নিরাময় আরোগ্য বিদ্যবান। এই অন্বেষণে অনুসন্ধান করা যাক শান্তি ও সহনশীলতা প্রচারে নবী মুহাম্মদের (ﷺ)  অতুলনীয় ভূমিকা। 
   মানব জীবন শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে অনেক শান্তিবাদী অনেক শান্তি তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন, কিন্তু সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় বৃথা গেছেন। তদুপরি, তাদের প্রচেষ্টা যদি একটি অংশে শান্তি আনয়ন করে, অন্যদিকে অন্য বিভাগে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে। যাইহোক, নবীর (ﷺ) শান্তি প্রক্রিয়া যতটা প্রাসঙ্গিক ততটাই বাস্তব।  উপরন্তু, ঐশ্বরিক নীতির উপর ভিত্ত নবী (ﷺ) পরিচালিত শান্তি প্রক্রিয়া ছিল একেবারে অন্তর্ভুক্তিমূলক; তথাকথিত শান্তিবাদী তাত্ত্বিকদের মত শোষণমূলক নয়।


রহমত: শান্তির উৎস 
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ইসলামকে শান্তি ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে দেখার জন্য পূর্বের দ্বিতীয় পর্ব রহমতের চর্চাটা সামনে নিয়ে আসা দরকার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন বলেন: “এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি কিন্তু রহমত করে সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য।” (আল-কুরআন, সূরা হজ্জ্ব; ২১:১০৭) মহানবী (ﷺ) ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত রহমতের অপার উৎস। আরবি শব্দ ‘রহমত’-এর অর্থ হল করুণা, দয়া, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি। আর এসব বৈশিষ্ট্যগুলিকে যদি শান্তির উপকরণ বলা হয় তাহলে সারাংশে আসা যায় যে নবীর (ﷺ) শান্তি পরিমণ্ডল রেখার মধ্যেও রহমতের অপার পরিসীমা অন্তর্ভুক্ত। 
  তাঁর (ﷺ) মোহনাহীন শান্তিরেখা মানুষের উপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বব্রহ্মণদের সকল সৃষ্টি পরিবেষ্টিত। শিশু, পুরুষ-নারী, পশু-পাখি, মোমিন-কাফের, জড়-জীব সবার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল করুণা ও ভালোবাসার। 


শান্তি বজায় এবং সামাজিক বিচার
বর্তমান সমগ্র কৃত্রিম শান্তি প্রণালীর একটি বড় অক্ষমতা হল শব্দকে কর্মতে নিয়ে আসে। শান্তির স্থাপনার ওপর পৃথিবীব্যাপী বহু নিয়ম এবং অনেক কানুন গঠিত হয়েছে, কিন্তু তা প্রণয়নে সার্বিক সফলতা কখনও অর্জন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক সরকারি-বেসরকারি সংগঠন যেমন জাতিসংঘ, জি-২০, ইত্যাদী সংস্থার মৌলিক উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী শান্তি স্থাপনা করা কিন্তু দিনের পর দিন পৃথিবী অশান্তিতে ভরে উঠছে। সামাজিক বিচার কখনোই সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না। 


   নবীর (ﷺ) সামাজিক বিচার কেমন ছিল এবার দেখা যাক। আবার একই কথা বলা যাবে - নবী (ﷺ) সবার প্রতি সঠিক বিচার দেখিয়েছেন। নবীর (ﷺ) আদালতে পশুপাখি থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, দাস-বন্দী, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং সাধারণ মানুষ সকলেই সমান বিচার পেয়েছে। 
   ঐতিহাসিক এক উক্তি থেকে তাঁর (ﷺ) ন্যায়বিচারের মান অনুধাবন করা যায়: “আল্লাহর কসম! যদি ফাতিমা বিনত মুহাম্মদও যদি চুরি করতো, তবে নিশ্চয়ই আমি তার হাত কেটে দিতাম।” (সহীহ মুসলিম)
  এইরূপ ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা যদি বজায় থাকে, অবশ্যই পৃথিবী অবিচার-মুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার দূরদর্শিতা এতই বিশাল এবং সার্বিক হওয়া চায় যা হযরত (ﷺ) বাস্তবে দেখিয়েছেন। ন্যায়বিচার ব্যতীত সামাজিক শান্তি এক অসাধ্য স্বপ্ন যা কখনোই সম্ভব নয়। অনুরূপ, ব্যক্তিগত অধিকার নিয়েও বিচারের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। হযরত নবী করিমের (ﷺ) বর্ণনা এসেছে: “প্রত্যেক হাক্বদারকে তার হাক্ব প্রদান করুন।” (সহীহ বুখারী) আর এই অধিকার ধর্ম রঙে চিহ্নিত নয় বরং সার্বিক মানব সৃষ্টির। নিম্নে জানা যাবে যেহেতু বেধর্মীদেরও বিচার যদি সত্য হয় তবে তা স্বীকার্য। 
শান্তি-সংঘে অংশগ্রহণ


সত্য ও ন্যায়ের নীতিতে গড়ে উঠলে জোট ও সংগঠনের কার্যক্রমও প্রশংসনীয়।  প্রকৃতপক্ষে ঐক্যবদ্ধ একটি সংঘ যা জনগণের মধ্যে শান্তি-নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং তা প্রচারে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে।  এ কারণেই কুরআন মুসলিম সম্প্রদায়কে সৎকর্মের প্রচার ও অসৎকাজের নিষেধের জন্য নিবেদিত এক সামাজিক শ্রেণীর আদেশ দিয়েছে। (আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান; ৩:১০৪)
  অনুরূপ এক শান্তির সংঘে নবীজির সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যায় যা ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত, তবুও আবার নবুয়াত প্রকাশের পূর্বে। হিলফুল ফুযুল (যার বাংলা অর্থ শান্তির সংঘ বা কল্যাণের শপথ) গঠনের পটভূমিকা এতই অনুপ্রেরণামূলক যে কীভাবে কিছু সৎ মানুষ একত্রিত হয়ে সমাজে শান্তি বজায় রাখার এবং প্রত্যেককে তার নিরাপত্তা ও প্রাপ্য দেওয়ার শপথ গ্রহণ করে। অনেক সময় পর নবী (ﷺ) সেই সামাজিক সংগঠনের কথা স্মরণ করে বলেন: আমি আবদুল্লাহ বিন জুদআনের বাড়িতে একটি চুক্তি প্রত্যক্ষ করেছি, যা আমি সমস্ত লাল চুলের উট পরবর্তীতেও ভাঙতে চায়না। আজ যদি আমাকে আবার এতে আমন্ত্রণ জানানো হয় তবে আমি তা গ্রহণ করব। (সিরাত ইবনে হিশাম) 

শান্তি-চুক্তিতে সাক্ষর 

৫২৮ সালে (মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরী) স্বাক্ষরিত হয় নবীর (ﷺ) নেতৃত্বে মুসলমান এবং মক্কার কুরাইশদের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি যা ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল বিন আমরের সমস্ত শর্তে নবী সম্মত হন। এমনকি নবী কারীম (ﷺ) সমঝোতা লেখক আলীকে (রা.) তাদের দাবিতে আল্লাহ-প্রদত্ত উপাধি নাম রাসূলুল্লাহ মুছে ফেলতে আদেশও দেন। তদুপরি, কোরাশদের শর্তসমূহ এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট ছিল যে যদি কেউ যদি কেউ মক্কা থেকে পালিয়ে গিয়ে মুহাম্মদের (ﷺ) কাছে আশ্রয় নেয় তাহলে তাকে আবার ফেরত পাঠানো হবে, কিন্তু তার বিপরীত নয় যথা যদি কোনো মুসলমান পালিয়ে কুরাইশদের কাছে আশ্রয় নেয় তাহলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে না। এইসব আধিপত্যবাদী দাবি নিয়ে সাহাবীগণ আপত্তি থাকলেও নবী সবটাই মেনে নেন। 

  মক্কার বেড়ায় থেকেও হজ্জের উদ্দেশ্য পূরণ না করেই অন্য এক শর্তানুসারে নবী  (ﷺ) তাঁর সহচরদের নিয়ে মদিনায় প্রত্যাগমন করেন। শত্রুর সঙ্গে সমন্বয়, নিজের সঙ্গে ত্যাগ - শান্তি ও সহনশীলতার  কি অপরূপ দৃষ্টান্ত।   

শান্তি শত্রুর সঙ্গে 

শুধু হুদাইবিয়ার শান্তি সন্ধিই নয়, এরূপ অনেক উদাহরণ বিদ্যামনা নবীজির (ﷺ) আদর্শ জীবনীতে আবর্জনা নিক্ষেপকারী বৃদ্ধা থেকে হামজার (রা.) হত্যাকারী হিন্দা পর্যন্ত এবং আরও অনেক। হুদাইবিয়া সন্ধির ঠিক দু’বছর (অষ্টম হিজরী) পরের ঘটনা। নবী (ﷺ) দশ হাজার সাহাবাদের নিয়ে মক্কা জয় করেন যা ‘ফাতাহ মক্কা’ নাম পরিচিত। পরাস্ত মক্কাবাসীরা  নবীর সামনে শির নত করে উপস্থিত হলে শান্তির নবী ঘোষণা করেন: ‘...আজ রহমতের দিন… তোমরা যাও, তোমরা স্বাধীন।’ এরাই মক্কার সেই সকল মানুষ ছিল যারা নবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদেরকে নির্যাতন করে, হত্যার ষড়যন্ত্র করে, নিজ  জন্মভূমি থেকে বহিষ্কার করে। কি চমৎকার শান্তির দৃষ্টান্ত! অসাধারণ ক্ষমার উদাহরণ! কি অপুরূপ সহনশীলতা! নবীর (ﷺ) শান্তির শিক্ষা দিয়েছেন যে ধৈর্য প্রতিশোধের চেয়ে উত্তম।  

   প্রয়োজনে যুদ্ধের ময়দানে অবরোহন করেও নবী (ﷺ) দয়া, ক্ষমা ও শান্তির পাঠ শিখিয়েছেন যে ‘নারী, শিশু ও বৃদ্ধদিগকে হত্যা করিবে না। ফলন্ত বৃক্ষ কাটিও না, আবাদ ভূমিকে ধ্বংস করিও না, খাওয়ার উদ্দেশ্যে ভিন্ন বকরী বা উট হত্যা করিও না, মৌমাছির মৌচাক পোড়াইয়া দিও না অথবা পানিতে ডুবাইয়া দিও না, গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ মাল হইতে কিছু চুরি করিও না, হতোদ্যম বা ভীরু হইও না।’ (মুয়াত্তা)

শান্তির সংবিধান

বহুত্ববাদ, সহযোগিতা, পারস্পরিক সুরক্ষা, দ্বন্দ্ব সমাধান প্রভৃতি শান্তির শব্দগুলি হিজরতের পর মদীনায় নবী (ﷺ) প্রচারিত বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার ঘোষণায় নিহিত হয় যা প্রায় পঞ্চাশটি ধারায় গঠিত। এটিকে মদিনার সংবিধান বলা হয়।  কার্যত এটি বিশ্বশান্তির সংবিধান। এই শান্তি সনদ দ্বন্দে লিপ্ত জাতি-উপজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং সার্বজনীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নমুনা দেখায়।  তাছাড়া, মদিনা সংবিধানে সংখ্যালুঘ সম্প্রদায় যেমন ইয়াহুদীরাও সমান অধিকার পায়। এইভাবে নবী (ﷺ) বিশ্বশান্তির প্রক্রিয়া আরাম্ভ করেন।  

শান্তির অন্তরমহল

শেষ কোথায়, শান্তি ও সহনশীলতার প্রচারে নবী মুহাম্মদের (ﷺ) ভূমিকা ব্যাখ্যায় অবশই উল্লেখনীয় যে ইসলামের নীতিকথা সর্বদা ভিত্তিমূলক মৌলিক বিষয়বস্তুকে লক্ষ্য করে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় পূর্বোক্ত নবীর শিক্ষা যেমন আবশ্যিক, অনুরূপ প্রয়োজন কিছু অভ্যান্তরিন ভিত্তিমূলক উপাদানও। শান্তির অন্তর্মহল হচ্ছে হৃদয়। এক হাদিসের বর্ণনা অনুসারে - ‘প্রত্যেক ব্যক্তির শরীরে একটি মাংসপিন্ড রয়েছে, উহা সুস্থ থাকলে সমস্ত শরীর সুস্থ থাকে। আর উহা বিনষ্ট হলে সারা শরীর বরবাদ হয়ে যায়। আর উহা হলো কলব (অন্তর)’। (সহীহ বুখারী) 

   অতএব হৃদয় শান্ত না হলে সমাজে শান্তি আনা সম্ভব নয়।  উপায় হচ্ছে মন সর্বদা সন্তুষ্ট যথা রাজি (মুতমাইন্না) হওয়া। অবশ্যই এতে নবী (ﷺ) প্রদর্শিত বৈশিষ্ট প্রয়োজন যেমন আন্তরিকতা (ইখলাস) এবং ধর্য্য (সবর)। অনুরূপ নবীরই (ﷺ) নিৰ্দেশিত বেশ কিছু হৃদয় ব্যাধি থেকেও পরিত্রান পেতে হবে যেমন অহংকার (কিবর), হিংসা (হাসাদ), রাগ (গজব), চুকলি (গীবত), লোক দেখান (রিয়া) ইত্যাদি। তবেই ব্যাক্তিগত থেকে সামাজিক এবং তা থেকে বৈশিক শান্তি ও সহনশীলতা অর্জন করা যাবে। হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) যে শান্তির দূত ছিলেন অবশই তিনি এইসব বৈশিষ্ঠে গুণান্বিত ছিলেন। তবেই তো পৃথিবীজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আজও তাঁর শান্তির এবং সহনশীলতার অমূল্য বাণী।    

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter