বিশ্ব নবীর জীবনী: নবুয়াত এবং ইসলামের প্রচার -2
হুযুর ﷺ হাজরে আসওয়াদ কে যথাস্থানে স্থাপন করে তিনি একটি বিরাট সংঘর্ষের সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দিলেন। এ সংঘর্ষে কত খুনখারাবি হত, কে জানে! সেই যুগে খাদীজা বিনতে খওলিদ নামে আরবে এক বিত্তশালী মহিলা ছিলেন। তিনি বনু সাদ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রথম বিবাহের পর তিনি বিধবা হন এবং দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর দ্বিতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন এবং পুনরায় তিনি বিধবা হন। তিনি অত্যন্ত সম্মানিত সচ্চরিত্রের অধিকারি মহিলা ছিলেন। লোকেরা তাঁর বৈশিষ্ট্য মুগ্ধ হয়ে তাঁকে 'তাহিরা' (পবিত্রা) বলে ডাকত। তাঁর অগাধ ধন-দৌলত ছিল। তিনি লোকদের পুঁজি ও পণ্য দিয়ে ব্যবসা চালাতেন ।
হযরত ﷺ-এর বয়স তখন পঁচিশ বছর। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা উপলক্ষে তিনি বহুবার সফর করেছেন। তাঁর, বিশ্বাস্ততা, সচ্চরিত্রের কথা জনসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিলো। তার এ খ্যাতির কথা শুনে হযরত খাদিজা তাঁর কাছে এই মর্মে এক পয়গম পাঠান। 'আপনি আমার ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে সিরিয়া গমন করুন।' হযরত ﷺ তাঁর এই প্রস্তাব কবুল করলেন এবং পণ্যদ্রব্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত গমন করলেন। খাদিজা হযরত ﷺ-এর অসামান্য যোগ্যতা ও অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে প্রায় তিন মাস পর তার কাছে বিয়ের পয়গম প্রেরণ করেন। হযরত মোহাম্মদ ﷺ তাঁর প্রস্তাব কবুল করেএবং বিবাহ করলেন। বিবাহের সময় নবী ﷺ-এর বয়স পঁচিশ বছর এবং খাদিজার চল্লিশ বছর বয়স ছিল। নবী ﷺ-এর তিনজন পুত্রসন্তান এবং চারজন কন্যা সন্তান ছিল। এদের মধ্যে ছয় জন খাদিজা বিবির থেকে জন্ম নিয়েছিলেন। একজন হযরত ইব্রাহিম নবীজির অন্য স্ত্রী হযরত মারিয়া কিবতিয়ার থেকে জন্ম নিয়েছিলেন। এবার আমরা জানতে পারব যে নবী কারীম ﷺ কিভাবে নবুওয়াত লাভ করেন। মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে হেরা নামে একটি পর্বত গুহা ছিল। হযরত মুহাম্মদ ﷺসেই গুহায় খোদার স্মরণে মগ্ন থাকতেন। এভাবে দীর্ঘ ৬ মাস কেটে গেল। নবী কারীম ﷺ ৪০বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। একদা তিনি হেরা গুহায় যথারীতি খোদার স্মরণে মশগুল রয়েছেন। সময় টি তখন রমজান মাসের শেষ দিক। হঠাৎ জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সামনে প্রেরিত হলেন। হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আত্মপ্রকাশ করেই হযরত ﷺ-কে বললেন পড়ো'। তিনি বললেন আমি পড়তে জানি না। একথা শুনে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মোহাম্মদ ﷺ-কে বুকে জড়িয়ে ধরে এমনি জোর চাপ দিলেন যে, তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। অতঃপর হযরত ﷺ কে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন পড়ো। কিন্তু তিনি আগের জবাবেরি পুনরুক্তি করলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আবার তাঁকে আলিঙ্গন করে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন পড়ো। এবারেও হযরত ﷺ জবাব দিলেন আমি আমি পাঠক হতে নয়। পুনর্বার জিবরাঈল আলাইহিস সালাম হযরত ﷺ কে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন
إقرأ باسم ربك الذي خلق. خلق الإنسان من علق. إقرأ وربك الأكرم الذي علم بالقلم. علم الانسان مالم يعلم অর্থাৎ, পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন জমাট বাঁধা রক্ত থেকে । পড়ো এবং তোমার প্রভু অতিব সম্মানিত যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন । তিনি মানুষকে এমন জিনিস শিখিয়েছেন যা সে জানত না।এই হচ্ছে সর্বপ্রথম ওহী এবং নবীজির নবুওয়াত লাভ। এরপর জিব্রাইল আলাই সালাম চলে গেলেন এবং নবীজি ﷺ কাঁপতে লাগলেন। এই অবস্থাতেই বাড়ি ফিরলেন এবং বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা কে বললেন: আমার উপরে চাদর চাপিয়ে দাও! আমার সাথে একটি ঘটনা ঘটে গেছে যার কারণে আমার প্রাণের আশংকা হচ্ছে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা শুনে বললেন: না ,না , আপনি ভয় করবেন না। আল্লাহ পাক আপনাকে কখনো ক্ষতি করবেন না। কেননা আপনি সত্যি বলেন; অনাথ, অসহায়দের সাহায্য করেন, অত্যাচারিত ও পীড়িতদের সাথে সহানুভূতি দেখান, আল্লাহ পাক আপনাকে বিপদে ফেলবেন না। এতটা বলে সান্তনা দেওয়ার পরে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা নবী করীম ﷺ কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই অর্কা ইবনে নওফেল নামক একজন ধর্ম জ্ঞানীর কাছে নিয়ে গেলেন। নবি কারিম ﷺ তাঁকে হেরা গুহার বিস্তারিত ঘটনা ও হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর ঘটনাটি বলেন।
ওরকা বিন নওফল বলে উঠলেন: ইহা ওই রহস্য, যা মুসা আলাইহিস সাল্লামের উপরে নাযিল হয়েছিল। হে মোহাম্মদ ! আপনাকে সুস্বাগতম ও সুসংবাদ, আপনি যে আল্লাহর রাসূল। আহা! কি ভালো হতো যদি সে সময় আমি বেঁচে থাকতাম। যখন আপনার জাতি আপনাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করবে।
নবী পাক ﷺ বললেন: আমাকে আমার স্বজাতি দেশ থেকে তাড়াবে?
অর্কা বললেন: হ্যাঁ অবশ্যই। কাফের সর্বদা পয়গম্বরদের শত্রু হয়। আমি যদি সেকালে বেঁচে থাকি, তো অবশ্যই আপনার সাহায্য করবো। এখান থেকে নবী আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের দাওয়াতি পর্যায় শুরু হলো। প্রথম দিকে তিনি গোপনে দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। তিনার দাওয়াতে কয়েক জন ইসলাম গ্রহণ করলেন যেমন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা, আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু প্রমুখ ব্যাক্তি।
আবু বক্কর (র:)- এর প্রচেষ্টায় ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, আব্দুর রহমান বিন আউফ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, সাদ বিন আবি রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, তালহা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন । গোপনে ইসলামের দাওয়াত ছড়াতে লাগলো এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলো। এরপর তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। সুতরাং একদিন হযরত ﷺ সাফা পর্বতের উপর আরোহন করলেন এবং সেখানে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে বললেন: হে লোকসকল! আমি যদি বলি যে, এই পাহাড়ের পিছনে বিরাট একদল শত্রুসৈন্য তোমাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য ওত পেতে আছে, তাহলে তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?
লোকেরা বলল: নিশ্চয়ই করব। তুমি তো কখনও মিথ্যা কথা বলনি, আমরা তোমাকে সাদিক এবং আল আমিন বলেই জানি।
হযরত ﷺ বললেন: তাহলে শোনো আমি তোমাদেরকে এক খোদার বন্দেগীর দিকে আহবান জানাচ্ছি এবং মূর্তি পূজার পরিণাম থেকে তোমাদের বাঁচাতে চাচ্ছি। তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তাহলে তোমাদের এক কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি সম্পর্কেও সতর্ক করে দিচ্ছি।
এটা ছিল ইসলামের সাধারণ ও প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনা। এইভাবে ইসলাম চারিদিকে ছড়াতে লাগলো। এর ফলে কুরাইশগণ মুসলমানদেরকে জুলুম করতে শুরু করলো। সেজন্য হুযুর ﷺ আবিসিনিয়ার দিকে হিজরতের জন্য মুসলমানদের আদেশ দিলেন। এই হিজরত করার কারণ ছিল কুরাইশদের জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়া এবং আবিসিনিয়ায় ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর মক্কায় আরও জুলুম শুরু হয়ে গেল। যার কারণে তিনি মদিনার দিকে হিজরতের জন্য ফায়সালা করলেন। মদিনায় গিয়েও কুরাইশরা থামেনি। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত ছিল। তারপরে মুসলমানদের সাথে কুরাইশদের বদর যুদ্ধ হয়েছিল। বদর যুদ্ধে মুসলমানরা শুধু ৩১৩জন সৈন্য ছিলেন এবং যুদ্ধের জন্য অস্ত্রপাতিও সেরকম ছিলনা অপরদিকে কুরাইশরা ১০০০ জন সৈন্য ছিল এবং তাদের কাছে যুদ্ধের জন্য অনেক অস্ত্রপাতি ছিল। মুসলমানরা দুর্বল হওয়ার পরও আল্লাহর সাহায্যে বদর যুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন। এর পরেই আবার ওহুদ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো অপরদিকে মুসলমানরাও প্রস্তুত হল। এই যুদ্ধে মুসলমানরা ছিল ১০০০জন কিন্তু তারমধ্যে এক মুনাফিকের দল ৩০০জন চলে গেল। যার ফলে মুসলমানরা ৭০০জন হয়ে গেল। অপর দিকে কুরাইশরা ছিল ৩০০০ জন। অতঃপর আবার আল্লাহর সাহায্যে উহুদ যুদ্ধেও কুরাইশদের কাছ থেকে আবার জয়লাভ করলেন। এরপর কাফেরদের দল যুদ্ধের জন্য মদিনার দিকে রওনা হল। এবং মুসলমানরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো এবং মাটি খুড়তে লাগলো। এই খন্দক যুদ্ধতেও মুসলমানরা জয়লাভ করলেন। এইভাবে ইসলাম আরো ছড়াতে লাগলো । এরপরে হযরত মুহাম্মদ ﷺ কাবা জিয়ারতের জন্য তৈরি হলেন। যার ফলে কুরাইশরা মুসলমানদের সাথে দশ বছরের হুদায়বিয়ার সন্ধি করল। কুরাইশরা নিজে থেকে এই সন্ধিটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এটা ছিল মুসলমানদের এক বিরাট জয়। যার ফলে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করেছিলেন। মুসলমানরা হুনাইনের যুদ্ধ জয় লাভ করেছিলেন, তাবুকের যুদ্ধেও জয়লাভ করেছিলেন। যার ফলে মুসলমানরা এক বিরাট শক্তিশালী উঠলেন। পরিশেষে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬৩২খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তিনার ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীনরা পারস্য রোম এইসব শক্তিশালী দেশের সাথে যুদ্ধ করে জয় লাভ করেছিলেন এবং ইসলামকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলেন। যার ফলে বর্তমানেও ইসলামের প্রভাব ছড়িয়ে আছে।