বিশ্বনবী মুহাম্মদ (স.) এর সংগ্রামী জীবন

             জাহেলিয়াতের ঘোর আঁধারে নিমজ্জিত মা নবজাতিকে হিদায়াতের পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হচ্ছেন মুহা ম্মদ (স.)। শিরক, বিদয়াত, অন্যায়, অবিচার, অশ্লীলতা ও অসভ্যতার পঙ্কিলতায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এ পৃথিবীকে নব উদ্যমে আলোকোজ্জল করতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে এক অনন্য অনুপম আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রকাশ্য অকাট্য প্রমাণস্বরূপ তাঁকে অসংখ্য মুজিযা প্রদান করেছেন।

জন্ম, শৈশব কৈশোর কাল:-

              হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৫৭০ খৃষ্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। বিশ্ব নবীর জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তিছিল। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং মাতার নাম আমেনা। অতি অল্প বয়স থেকেই আল্লাহ তাকে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নেন। জন্মের পূর্বেই মুহাম্মাদ পিতাকে হারিয়ে এতিম হন। ৬ বছর বয়সে মা আমেনা এবং ৮ বছর বয়সে দাদা আবদুল মোত্তালেব এর মৃত্যুর পর এতিম মুহাম্মাদ এর দায়িত্বভার গ্রহন করেন চাচা আবুতালেব।এতিম শিশু বড় হয়ে উঠে চাচার সযত্নে ভালবাসায়।

             তৎকালীন আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন নারীদের কা ছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতি অনুসারে হয়রত মুহাম্মদ কে'ও হালিমা বিনতে আবুজুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়। এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার স্বচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন।

 তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য :-

             শিশু মুহাম্মদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মুহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূরণ হল। ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে, একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেন ফেরেশতা জিবরাঈল ও ফেরেশতা মিকাঈল। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে বক্ষ বিদারণের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

এই ঘটনার পরই হালিমা নবীজিকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণহওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। তখন একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর যিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। 

             একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যু র পর দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদ নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদা'ই মুহাম্মাদ এর দেখাশোনা করতে থাকেন। মুহাম্মদ এর বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবুতালিবকে হযরত মুহাম্মদ এর দায়িত্ব দিয়ে যান।

             আবুতালিব ব্যবসায়ী ছিলেন। তখনকার আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদ এর বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচা আবুতালিবের সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলে ন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবুতালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবুতালিব তাবুফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। 

             কথিত আছে, শহরটিতে "জারজিস" নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এসময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হিসেবে চিহ্নিত করেন। 

              ফিজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন মুহাম্মদ এর বয়স ছিল ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছুকরার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছুএকটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তাঁর উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের কারণে পরিচিত মহলের সবাই তাকে "আল-আমিন" (আরবি: االمين ,অর্থঃ "বিশ্বস্ত, বিশ্বাসযোগ্য, আস্থাভাজন") "আল- সিদ্দিক" (অর্থ: "সত্যবাদীl") বলে সম্বোধন করতেন।

মুহাম্মদ না মকরণ:-

              মুহাম্মদ এর জন্ম হওয়ার পরই মা আমেনা এ সংবাদ দাদা আব্দুল মুত্তালিবকে পাঠান। সংবাদ পাওয়ার পরেই তিনি ছুটে আসেন। পরম স্নেহে দেখেন, যত্নের সঙ্গে কোলে নিয়ে কাবার ভেতর প্রবেশ করেন, আল্লাহর হা মদ বর্ণনা করেন এবং দোয়া করেন। অতঃপর তাঁর নাম রাখেন "মুহাম্মদ"(প্রশংসিত)।

আহমদ নামকরণ: বিবি আমিনা গর্ভাবস্থায় স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত নাম অনুসারে "আহমদ" (উচ্চ প্রশংসিত) নাম রাখেন। বাল্যকাল হতে মুহাম্মদ ও আহমদ উভয় নামি প্রচলিত ছিল। উভয় নামই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। দুগ্ধ পান কাল: সর্বপ্রথম তাঁকে তাঁর মাতা হযরত আমেনা দুগ্ধ পান করান। অতঃপর আবুলাহাবের বাঁদী সুওয়াইবাতাকে দুগ্ধ পান করায়। অতঃপর ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন। হাওয়াযিনগোত্রের বানী সাদ এর নারী হালীমা ছাদিয়া এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হন। এমনভাবে যে, অন্য কোন ধাত্রী শিশু মুহাম্মদকে গ্রহণ করল না পক্ষান্তরে, হালিমা সাদিয়াও অন্য কোন শিশু পেলনা। ফলে বাধ্য হয়ে রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামকে গ্রহণ করলেন। গ্রহণ করার পর থেকেই হালিমার ঘরে ইলাহী বরকতের জোয়ার শুরু হল। দুবছর দুগ্ধ পানের পর বিবি হালিমা শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে তাঁর মায়ের নিকট হাজির হন এবং সাথে সাথে এই আকাঙ্খাও ব্যক্ত করেন যে, শিশুকে আরো কিছুদিনের জন্য তাঁর নিকট যেন থাকতে দেয়া হয়।  এদিকে মক্কায় তখন মহামারী চলছিল। উভয় দিক চিন্তা করে বিবি আমেনা তাঁর শিশুকে হালিমার নিকট ফিরিয়ে দেন। এমনি ভাবে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মুহাম্মদ বানী সাদে লালিত পালিত হন। সেখানে তিনি তাঁর দুধ ভাইদের সঙ্গে জঙ্গলে ছাগল চড়াতেন। ~সহীহ আল বুখারী, কিতাবুন নিকাহ, সীরাতুননবী: ১/১৭২

 দাদা চাচার তত্ত্বাবধান কাল:

              মুহাম্মদ এর পিতা-মাতার মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব নেন। তিনি তাকে খুব স্নেহ করতেন। এমনকি নিজের ছেলেদের উপরও তাঁকে প্রাধান্য দিতেন। নিজে র আসনে বসাতেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পূর্বপর্যন্তই তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিলেন।দা দা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবুতালিব তাঁর দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স ছিল আট বছর। তিনি চাচা আবুতালিবকে বকরী লালন-পালন ও শাম দেশে র ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করতেন।

নবুয়তের পূর্ববর্তী কাল:-

              আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা দমনের জন্যই "হিলফুল ফুজুল" নামক একটি শান্তি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তরুণ বয়সে মুহাম্মাদের তেমন কোন পেশা ছিল না। তবে তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করে ছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সাদ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। মুহাম্মাদ অল্প সময়ের মধ্যেই এ কাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তার উপাধি হয়ে যায় "আল আমিন" এবং "আল সাদিক" যেগুলোর বাংলা অর্থহচ্ছে যথাক্রমে "বিশ্বস্ত" এবং "সত্যবাদী"। ব্যবসা উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদের সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।

             খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংশা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ বলে ন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মাদ তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫।

             মুহাম্মাদের বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কাবা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবুউমাইয়া মা খজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। 

             পরদিন মুহাম্মাদ সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়ি ত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।

মা খাদীজা এর সঙ্গে বিবাহ:-

             পঁচিশ বছর বয়সে মক্কার ধনবতী নারী খাদিজা বিনতে খোয়ালিদের সাথে মুহাম্মদ এর বিয়ে হয়। অভিজাত সতী, ধনবতী, নারী খাদিজা বিভিন্ন লোককে পণ্য দিয়ে ব্যবসা করাতেন এবং তিনি লাভের একটা অংশ গ্রহণ করতেন। মুহাম্মদ এর সততা, সত্যবাদীতা ও বিশ্বস্ততা তখন সুবিদিত ছিল। আল-আমীন, আসসাকিন এর প্রশংসা শুনে তিনি তার কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান। মুহাম্মদ রাজী হন এবং ব্যবসা শেষে অনেক বেশি লাভসহ তার সব কিছুবুঝিয়ে দেন। মুহাম্মদ গুণ মুগ্ধ ও অলৌকিক সংকেতের কথা শুনে মা খাদিজা বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় এবং উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখন খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন মুহাম্মদ আর কোনো বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করেননি। এরপর আদর্শিক প্রয়োজনে এবং নারী সমাজের বিভিন্ন উপকা রের জন্য তিনি মোট ১১টি বিয়ে করেন। দুজন তার মৃত্যুর পূর্বেমারা যান আর ৯ জনের সাথে তিনি বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করেন।

 নবুয়ত প্রাপ্তি কাল:-

             চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মা দ নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এভাবে একদা তিনি হেরা গুহায় তাশরীফ আনেন এমন সময় তাঁকে নবুয়তের পদমর্যাদা দিয়ে সৌভাগ্যবান করার পবিত্র মুহুর্তএসে যায়। জন্মের ৪১ তম বছরে ২৭ ই রজব (হিজরতের ১৩ বছর পূর্বে) মুতাবিক ৬১০ খৃষ্টাব্দ তারিখে জাগ্রত ও চৈতন্য অবস্থায় এঘটনা সংঘটিত হয়। আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) প্রথমবারের মত তাঁর কাছে আসেন।পৃথিবীবাসীদের জন্য আল্লাহর সর্বশেষ ঐষীবাণী, বিশ্বমানবতার মুক্তির পথের দিশারী, জ্বিন ও মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবন বিধান আল কুরআনুল কারীমএর সর্বপ্রথম কথাগুলো নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। জিবরাইল (আঃ) এসে বলেন,“পড় তোমার প্রভুর নামে"-তাঁর সা মনে হেরা গুহায় ফেরেশতা আগমন করেন এবং বলেন: "পড়ুন"। তিনি উত্তর দিলেন: আমি কি ভাবে পড়ব? ফেরেশতা বললেন:

 . পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন . সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে . পাঠ করুন আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু . যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন . শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না (সূরা আলাকঃ -)

             উত্তরে নবী জানান: তিনি পড়তে জানেন না। এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই কথা বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ নিজে র অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ পড়তে সমর্থহন। অবর্তীর্ণহয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ। সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত।

প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গ্রহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন।  বারবার বলতে থাকেন, "আমাকে আবৃত কর"। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবী। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে।

             এবার অবতীর্ণহয় সূরা মুদ্দাসসির এর কয়েকটি আয়াত। এরপর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণবদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলততার মধ্যেই নবীর মক্কী জীবন শুরু হয়।

মিরাজ সফর কাল:-

              মুহাম্মদ -এর বয়স যখন ৫১ বছর নয় মাস হয়, তখন তাঁকে সশরীরে মর্যাদাপূর্ণ ইসরা ও মিরাজ ভ্রমণের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়। মিরাজে মুহাম্মদ প্রথমে কা বা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে যান, অতঃপর সেখান থেকে এক এক করে সাত আসমান অতিক্রম করে মহান আল্লাহর আরশে আজীমে তাশরীফ গ্রহণ করেন। এ মিরাজ সফরে মুহাম্মদ পাঁচ ওয়াক্ত না মাযে বিধান লাভ করেন। মিরাজে গিয়ে মুহাম্মদ জান্নাত এবং জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। দাওয়াতের আদেশ কাল: মহান আল্লাহ তায়ালা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলামের দাওয়াতের আদেশ দিয়ে ইরশাদ করেন হে চাদরাবৃত ব্যক্তি! ওঠ এবং সতর্ক কর।

 মক্কী জীবনে গোপনে ইসলাম প্রচার কাল:

              প্রত্যাদেশ অবতরণের পর নবী বুঝতে পা রেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভী ত ধ্বংস করা ব্যাতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিলনা। তাই প্রথমে তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেন। মুহাম্মাদের আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন "খাদিজা"। এরপর মুসলি ম হন মুহাম্মাদের চাচাতো ভা ই এবং তার ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর "আলী" ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য মুহাম্মদ নিজ বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শমেনে নেয়নি। এ সভাতে শুধুএকজনই ইসলাম গ্রহণ করে সে হলো "আলী"। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিল মুহাম্মদ এর অন্তরঙ্গ বন্ধু"আবুবকর"। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এবং এই প্রচারকাজ চলতে থাকে সম্পূর্ণ গোপনে।

মক্কী জীবনে প্রকাশ্যে দাওয়াত:-

               তিন বছর গোপনে দা ওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। নবী সাফা পর্বতের ওপর দাড়িয়ে চিৎকার করে সকলকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভুনেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্‌র রাসূল। কিন্তু এতে সকলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়।

 

মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন কাল:-

               বিরুদ্ধবাদীরা কয়েকটি স্তরে নির্যাতন শুরু করে। যেমন: প্রথমত উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি, এরপর অপপ্রচার, কুটতর্ক এবং যুক্তি। এক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় যাকে সফল করার জন্য একটি নেতিবাচক ফ্রন্ট গড়ে উঠে। একই সাথে গড়ে তোলা হয় সাহিত্য ও অশ্লীল গান-বাজনার ফ্রন্ট, এমনকি এক পর্যায়ে মুহাম্মাদের সাথে আপোষেরও প্রচেষ্টা চালায় কুরাইশরা। কিন্তু মুহাম্মাদ তা মেনে নেননি কারণ আপোষের শর্তছিল নিজের মত ইসলাম পালন করা, সেক্ষেত্র তার ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতো।

ধৈর্যও অবিচল:-

               মুসলমানগণ মুশরিকদের সকল নির্যাতন ও নিপীড়ন ধৈর্যও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করতেন। কেননা মুহাম্মদ তাদেরকে সাওয়াব ও জান্নাত লাভের আশায় বিপদে ধৈর্যধারণ ও অনড় থাকার পরামর্শদেন। মুশরিকদের নির্যাতন ভোগ করেছেন এমন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবী হলেন : বিলাল ইবনে রাবাহ ও আম্মার ইবনে ইয়াসিররা  প্রমুখ। মুশরিকদের নির্যা তনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ইয়াসির ও সুমাইয়া রা. এবং ইসলামের ইতিহাসে তারাই সর্বপ্রথম শহীদ।

 তায়েফ গমন কাল:-

              মুহাম্মদ এর আশ্রয়দা তা চাচা আবূতালিবে র মৃত্যুকে কুরাইশরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। তার উপর নির্যাতনের মাত্রা পূর্বের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দিল। এ কঠিন পরিস্থিতে সহযোগিতা ও আশ্রয় পাওয়ার আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্ত সেখানে উপহাস ও দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পাথর নিক্ষেপ করে আহত করে। ফলে তিনি আবার মক্কায় ফিরে যান।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter