মহৎ চরিত্র (৬): নবী মুহাম্মদের (ﷺ) সরলতা
এখন মক্কা-মদিনা ও আরব উপদ্বীপের বিস্তর অঞ্চলজুড়ে অবিতর্কিত প্রধান হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (ﷺ)। সত্য ধর্মের পরিচয় নিমিত্তে মহিমান্বিত অঙ্গুষ্ঠ মোহর লাগিয়ে তিনি সমসাময়িক জ্ঞাত পৃথিবীর শক্তিশালী পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের রাজাদের দূত মাধ্যম চিঠি পাঠিয়েছেন।
অন্যদিকে তিনি মহা বিশ্বপ্রভু আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ শরীয়ত প্রদানকারী, প্রেরিত দূত তালিকায় সর্বশেষ বিশ্বনবী, সৃষ্টি পূর্বের রহস্য, নৈশভ্রমণে স্রষ্টার বিশেষ নিমন্ত্রিত, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি তাঁর সন্তুষ্টি, ফেরেস্তার শান্তির জপে তাঁর নাম, আদেশে তাঁর তাঁরা দণ্ডায়মান।
আবারও তিনি আরব পুত্র বিশ্ব-সর্দার, মানবতার সংহার, সভ্যতার সংস্কারক, অজ্ঞতার আলো, চরিত্রের পূরক, আদর্শের সেরা প্রতিমান। স্বামী, পিতা, গুরু, বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী, যোদ্ধা, নেতা - জীবন ও সমাজের প্রত্যেক পর্যায়ের তিনি উৎকৃষ্ট উনুসরণ পাত্র।
এতো মহামান্বিত, গুণান্বিত এবং প্রশংসিত তবুও তাঁর চরিত্র সমাহারে এক অনন্য রত্নরূপে প্রস্ফুটিত সরলতার আদর্শ। সরলতার এই গুণই অন্যান্য মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যকে সৌন্দর্যতা প্রদান করে, নচেৎ বিপরীতে শুধুমাত্র অহংকার সমস্ত সৎ বিশেষণের বিরোধাভাসমূলক। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি সহস্র জ্ঞানের অধিকারী হয় কিন্তু এই বিতৃষ্ণ অহং থেকে মুক্ত না থাকতে পারে তাহলে জ্ঞান তাঁর জন্য আরও বড়ো বিপদ। একই কোথায় দৈহিক সৌন্দর্যে, শারীরিক শক্তিতে, কিংবা অন্য কোনও আকর্ষণে অহংকারের রং যদি মিশ্রিত হয়ে যায় তাহলে তা দুর্নাম করে ফেলে। অন্যদিকে, কেউ যদি কোনো দিকে দিয়ে কিছুর স্বল্পতায় থাকে তাঁর সরলতার কখনও তাঁর পূরক হয়ে দাঁড়ায়। আর বিশ্বনবী (ﷺ) তো দুই থেকেই পরিপূর্ণ। তিনি তো মহান স্রষ্টার প্রচার, “আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন।” (সূরা আল-কলাম: ৪)
এই পরিমাণে প্রাচুর্যতার সত্বেও নবীজির (ﷺ) সরলতা এবং সাধারণ ব্যাক্তিত্ব অবাক করে দেওয়ার যা তাঁকে অসাধারণ করে তোলে। মুগ্ধ এই চরিত্রের আকর্ষণে অনেক পন্ডিত পূর্বেই বিশদ আলোচনা করে গেছেন তার মধ্যে থেকে কিছু এখানে তুলে ধরা হল।
প্রধান উৎস
ব্যাপার এমন যে ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল (রহ:) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত হাদীস সংকলন সহীহ আল-বুখারীতে ‘কিতাব আর-রিকাক’-এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সরল ও বিলাসমুক্ত জীবন নিয়ে একটি বিশেষ অধ্যায় রচনা করেন। তারপর ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আল-তিরমিযী (রহ:) নবীজির (ﷺ) অসাধারণ পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরে ৫৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত একটি স্বাধীন হাদীস সংগ্রহ উপস্থাপন করেন যা শামায়েলে তিরমিজি বা আশ-শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যা নামে পরিচিত।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সরলতা ও বিনয়ী ব্যবহার তাঁর সমগ্র ক্ষেত্রে দৃশ্যমান - ব্যাবসা-বাণিজ্যে, শিক্ষতা-শস্যতাতে, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিধান, বলা, চলা, ও প্রভৃতি আচার-আচরণে। নবিজীর পূর্ণাঙ্গ জীবনীতে বহু দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ উজ্জলময় হয়ে সরলতার শিক্ষা দেয়। তিনি তাঁর বাণীতে আদর্শশীল ছিলেন, “কেউ যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিনয় অবলম্বন করে তবে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।” (সহীহ মুসলিম)
কিছু দৃষ্টান্ত
শামায়েলে মুহাম্মদিয়ার এক বাংলা ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাধারণত চামড়া বা চটের তৈরি বিছানা বা মাদুর ব্যবহার করতেন। আরামদায়ক বিছানার প্রতি তাঁর কোন আগ্রহই ছিল না। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলাম চটের বিছানায় শুয়ে থাকার কারণে তাঁর শরীরে দাগ লেগে যায়। এ দৃশ্য দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ বললেন তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! রোম ও পারস্য সম্রাটগণ কত আরামে জীবন-যাপন করছে। রাসূলুল্লাহ বলেন, দুঃখের কোন কারণ নেই এদের ভাগ্যে দুনিয়া আর আমাদের ভাগ্যে আখিরাত।
বিনয়ী নবী (ﷺ)-এর সরলতা এখানেই পরিমাপ করা যায় যে তিনি একদা বলেন: তোমরা আমার সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করো না। যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে থাকে। আমি আল্লাহর বান্দা। আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলই বলো। (শামায়েলে তিরমিযী)
এই বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার যে বিশ্বসর্দার সমসাময়িক আঞ্চলিক শাসকদের থেকে কত বিনম্র, সরল এবং বিনয়ী ছিলেন। এরই কারণে তাঁর (ﷺ) শিষ্য সদস্যরা এমন ছিলেন যা পৃথিবীর আর কোনও দরবারে পাওয়া যেতো না (যেমনটা পূর্বের পর্বে উল্লেখ্য করা হয়েছে)। ঠিক একই রকম ঐশ্বরিক ঘোষণা, “আল্লাহ্র দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন; যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত।” (সূরা আলি-ইমরান: ১৫৯)
শামায়েলে থেকে উদ্ধৃত আরেকটি বর্ণনা অবাক করার মতো মনে হয় যেখানে নবী করীম (ﷺ) আত্মসম্মান ও অহংকারের মত কুমানবিক উদ্দীপনা উৎখাত করে রেখেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী-কে যবের রুটি এবং কয়েক দিনের পুরনো চর্বির তরকারী খাওয়ার দাওয়াত করলেও তা গ্রহণ করতেন। রাসূলুল্লাহ এর একটি বর্ম এক ইয়াহুদির নিকট বন্ধক ছিল। শেষ জীবন পর্যন্ত তা ছাড়ানোর মতো পয়সা তাঁর হাতে ছিল না।
বিশ্ব রাজত্বের এমন শাসক ছিলেন তিনি (ﷺ) যে ‘একমাত্র আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া কখনো রাসূলুল্লাহ স্বীয় হাত দ্বারা (ইচ্ছাকৃতভাবে) কাউকে প্রহার করেননি এবং কোন দাস-দাসী বা স্ত্রীলোককেও আঘাত করেননি’। তিনি এমন রাজত্বের অধিকারী ছিলেন যে ‘ইন্তিকালের সময় হাতিয়ার, একটি খচ্চর এবং কিছু জমি ছাড়া আর কিছু রেখে যাননি। সেগুলোও সাদাকা করে যান।’