নারী: ইসলামী প্রেক্ষাপটে সম্মান ও নিরাপত্তা; পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলনের তরঙ্গ ও বাস্তবতা

ইসলামে নারীর সম্মান, হিজাব, নিরাপত্তা 

মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলাম হল মানুষের জন্য আল্লাহর প্রেরিত জীবন বিধান। মুসলিম নারীদের অভিজ্ঞতাবিভিন্ন সমাজের মধ্যে এবং বিভিন্ন সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কুরআনে বেশ কয়েকজন নারীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে শুধু একজনেরই নামসহ উল্লেখ করা হয়েছে। আর তিনি হলেন মারিয়াম। এমনকি বাইবেলেও এতবার উল্লেখ করা হয়নি। গোটা একটা সূরাই তার নামে নামকরন করা হয়েছে, যেটা সূরা মারইয়াম নামে পরিচিত। কুরআন অনুসারে, তিনি জন্মথেকেই আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত। অল্পবয়সেই তিনি ফেরেস্তা প্রধান জীব্রাইলের মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া বার্তা পান, যে তিনি তাকে নির্বাচিত করেছেন।

ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনের যেখানে সূরা নিসা – অর্থাৎ ‘নারী’ শীর্ষক অধ্যায়টি প্রদর্শিত হয়েছে। এটি পারসিয়ান, আরবি ও কুফিক লিপিতে লেখা। ইসলাম পুরুষ ও নারীদের আল্লাহর কাছে সমান মর্যাদার অধিকারী বলে বিবেচনা করে এবং কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে, পুরুষ ও নারী "একক আত্মা থেকে সৃষ্টি"  এবং অন্যান্য স্থানে)।

সুন্নি ইসলামে, নারীদের জন্য কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত কিছু নীতিমালা রয়েছে। ফিকহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র) অনুযায়ী, এই নীতিমালাগুলোর ব্যাখ্যা এবং হাদিস গবেষণার মাধ্যমে সুন্নি আলেমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেসব হাদিসকে সন্দেহাতীতভাবে বিশুদ্ধ বলে মনে করেন, সেগুলোর ভিত্তিতে নারীদের জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।কুরআন অনুসারে, পুরুষ এবং নারীদের সমান নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা উভয়েই পরকালে সমান পুরস্কার লাভ করবে। 

ইসলামের নবী মুহাম্মদ তার জীবদ্দশায় নয় বা এগারো জন নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যা তার স্ত্রীদের সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার ওপর নির্ভর করে। প্রাক-ইসলামি আরব সংস্কৃতিতে, বিবাহ সাধারণত গোত্রের বৃহত্তর প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পন্ন হতো এবং এটি গোত্রের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে জোট গঠনের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত হতো। বিবাহের সময় কুমারীত্বকে গোত্রীয় সম্মানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট বলেন যে মুহাম্মদের সকল বিবাহই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় করার রাজনৈতিক দিক বহন করে এবং তা প্রাক-ইসলামী আরবীয় প্রথার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

কুরআন, হাদিস এবং সুন্নাহ (মুহাম্মদের বাণী ও কর্মের দৃষ্টান্ত) অনুযায়ী নারী ও পুরুষ উভয়ের জ্ঞানার্জনের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়। কুরআন সকল মুসলমানকে, তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে, জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর নির্দেশ দেয়। এটি ক্রমাগত মুসলমানদেরকে প্রকৃতিতে বিদ্যমান আল্লাহর নিদর্শনসমূহ থেকে পাঠ গ্রহণ, চিন্তা-ভাবনা, গভীরভাবে অনুধাবন এবং শিক্ষা অর্জনে উৎসাহিত করে। অধিকন্তু মুহাম্মদ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য শিক্ষা অর্জনে উৎসাহিত করেন তিনি ঘোষণা করেন যে জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম পুরুষ ও নারীর জন্য একটি ধর্মীয় কর্তব্য। পুরুষের মত প্রত্যেক নারীই নীতিগত ও ধর্মিয় এমন বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভূক্ত। যাতে তিনি জ্ঞানঅন্বেষণ করেন, নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির চেষ্টা করেন, মননকে সমৃদ্ধ করেন, নিজের মেধা-প্রতিভার চর্চা করেন যাতে তার সুপ্ত সম্ভাবনার দ্বারা নিজে এবং তার সমাজ উপকার লাভ করতে পারে।

পশ্চিমা নারীবাদের দাবি এবং সমস্যাগুলো 

নারীবাদ  ১৮৮০ সালে বৈশ্বিক আন্দোলন হিসেবে ফ্রান্সে, ১৮৯০ সালে যুক্তরাজ্যে এবং ১৯১০ সালে  যুক্তরাষ্টে নারীবাদ শব্দটির প্রচলন হয়। নারীবাদ হলো নারী ও পুরুষের মধ্যকার সমতার একটি মতবাদ, যাতে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তার রোধে নারীদের সংগঠিত হওয়ার উপর এবং সামাজিক জীব হিসেবে সমঅধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের জন্য সমাজকে নিরাপদ আবাসস্থলে রূপান্তরিত করার উপর গুরুত্ব দেয়। নারীবাদ মতাদর্শ হলো নারীরা রাজনৈতিক, সামাজিক, লৈঙ্গিক, বৌদ্ধিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে  পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। নারীবাদের কর্মকান্ড বৃহৎ পরিসরে নারীদের অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত। নারী যেখানে বৈষম্যের শিকার, পুরুষের অধস্তন, সেখানে নারীবাদ এ অবস্থার পরিবর্তন সাধনে পরিচালিত। নারী আন্দোলনকারীরা নারীর আইনগত অধিকার (চুক্তির অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, বৈবাহিক অধিকার, ভোটাধিকার), দৈহিক স্বাধীনতা ও অখন্ডতা রক্ষার অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা, প্রজনন অধিকার (যথেচ্ছা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করার অধিকার, সন্তানের সংখ্যা নির্ধারণের অধিকার, উন্নতমানের প্রসূতি চিকিৎসা লাভের অধিকার) অর্জনের জন্য, পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক ও মানসিক হয়রানি ও নিগ্রহ থেকে নারী ও কিশোরীর নিরাপত্তার জন্য; সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য, বেসরকারি খাতে চাকরিক্ষেত্রে, ব্যবসা বানিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য; কর্মস্থলে নারীর অধিকার, যার মধ্যে মাতৃত্ব ছুটি, সমান মজুরি ও বেতন প্রভৃতি অন্তর্ভূক্ত; সকল মানবাধিকার লাভ করার সুযোগ নিশ্চিত করা, এবং শিক্ষার সকল স্তরে নারীর অধিকার  নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়। বস্ত্তত যেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য বিদ্যমান, নারী আন্দোলনকারীরা সেসব জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যের প্রতি গুরুত্ব দেয় ।

নারীবাদী আন্দোলন পশ্চিমা বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ভোটদানের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, শ্রম অধিকার ও কাজের জন্য পুরুষের সমান মজুরি ও বেতন লাভের অধিকার; বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, প্রজনন অধিকার (জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতের অধিকার) এবং সর্বোপরি সম্পত্তির অধিকার লাভ করা। এতদসত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, নারী-পুরুষ অসমতা ও বৈষম্য কেবলমাত্র উন্নয়নশীল বিশ্বে নয়, উন্নত বিশ্বেও প্রচলিত রয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্বের কিছু অংশে নারীবাদ শতাব্দীর শুরু থেকেই একটি চলমান আন্দোলন । এর সূচনাকালে, নারীবাদ চারটি উচ্চ মুহূর্তের মধ্য দিয়ে গেছে যাকে বলা হয় তরঙ্গ । প্রথম তরঙ্গের নারীবাদ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্বেতাঙ্গ নারীদের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ছিল এবং এর মধ্যে ভোটাধিকার এবং রাজনৈতিক সমতা, শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার, সাংগঠনিক নেতৃত্ব এবং বৈবাহিক স্বাধীনতা জড়িত ছিল। দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আরও লড়াই করার চেষ্টা করেছিল। যদিও নারীবাদের প্রথম তরঙ্গে মূলত মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ নারীরা জড়িত ছিল,।

বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর নারী, বর্ণের নারী এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের নারীদের নিয়ে এসেছিল যারা সংহতি খুঁজছিল। তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদ ব্যবসায় এবং তাদের পারিবারিক জীবনে নারীদের আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্যের দিকে নজর দেওয়া অব্যাহত রেখেছে এবং রাজনীতি ও মিডিয়াতে নারীর বৃহত্তর প্রভাবের জন্য নতুন করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সক্রিয়তার প্রতিক্রিয়ায়, নারীবাদীদের গর্ভপাতের অধিকারের মতো নারীর প্রজনন অধিকারের উপরও মনোযোগ বজায় রাখতে হয়েছে। নারীবাদী আন্দোলন তিনটি ধারায় পরিচালিত হয়েছে। নারীবাদের প্রথম ধারাটি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় ছিল। এ পর্যায়ে বৈবাহিক চুক্তিতে সমঅধিকার এবং সম্পত্তি লাভ ও ভোগ করার অধিকার অর্জনের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে প্রথম ধারা যাত্রা শুরু করে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ প্রধান দাবিতে পরিণত হয় এবং নারীবাদী আন্দোলন নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। ঐ আন্দোলনে  যুক্তরাজ্যে গৃহসম্পত্তির মালিক ত্রিশোর্ধ মহিলারা ১৯১৮ সালে ভোটাধিকার অর্জন করে। ১৯২৮ সালে ২১ বছরের ঊর্ধ্বে সকল নারী ভোটাধিকার লাভ করে। ভোটাধিকার প্রাপ্তি প্রথম ধারার নারীবাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন।

দ্বিতীয় ধারায় এসে নারীবাদী আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠা নারীবাদের লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়। দ্বিতীয় ধারার নারীবাদের মধ্যে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় যে, সাংস্কৃতিক অসমতা ও রাজনৈতিক অসমতা পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে তারা সকল নারীকে বোঝাতে সচেষ্ট হন যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তার ক্ষমতার কাঠামোয় নারীর ব্যক্তিগত জীবনকে পুরুষের চাহিদা মতো গড়ে তুলেছে। এই অনুভূতি থেকে জন্ম নেয় দ্বিতীয় ধারার নারীবাদী শ্লোগান ‘যা ব্যক্তিগত তা-ই রাজনৈতিক’।

১৯৬৩ সালে বেটি ফ্রাইডেন  তাঁর ‘The Feminine Mystique’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তৎকালীন কলেজ-শিক্ষিত নারীদের অসন্তোষ ও স্বপ্নভঙ্গকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেসব শিক্ষিত নারী আশানুরূপ চাকরি পাননি তাদের গৃহের কাজে (রান্না করা ও ঘরগোছানোর কাজ) বাধ্য করা হয়েছে। বেটি ফ্রাইডেন  নারীর জীবনে পরিপূর্ণতা আসে ‘সন্তান প্রতিপালনে এবং গৃহকর্ম সম্পাদনে’, এ মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর মতে নারী একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস ব্যবস্থার শিকার, যে ব্যবস্থা নারীকে স্বামী ও সন্তানের মাঝে নিজ জীবনের পরিচয় ও অর্থ খুঁজতে বাধ্য করে এবং নারীকে পরিবারের পরিচিতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজের পরিচিতি বিসর্জন দিতে বাধ্য করে। সমাজে নারীর ভূমিকার এই নতুন ব্যাখ্যা নারীমুক্তি আন্দোলনের পথ দেখায় এবং ‘মুক্তি’ নারীর আকাঙ্খার  রূপায়ন হিসেবে পরিগণিত হয়। ‘নারীমুক্তি’ শ্লোগানটি প্রথম ব্যবহূত হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬০ এর দশক থেকে নারীমুক্তি আন্দোলন সমতার দাবি তোলে। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল পুরুষের সমান পারিশ্রমিক, পুরুষের সঙ্গে সমান আইনগত অধিকার, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের স্বাধীনতা ইত্যাদি। নারীমুক্তি আদর্শের সঙ্গে যে সকল বিষয় জড়িত হয়, তার মধ্যে রয়েছে দেহের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও চলাফেরার অধিকার; সার্বজনীন ভোটাধিকার; সরকারি পদলাভের অধিকার; কাজ করার অধিকার ন্যায্য ও সমান বেতনের অধিকার; সম্পত্তির মালিকানা; শিক্ষা; সামরিক বাহিনীতে কর্ম; আইনগত চুক্তি করার অধিকার; সর্বোপরি, বৈবাহিক, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব ও ধর্মীয় অধিকার। যদিও নারী মুক্তি প্রত্যয়টি জনমনে গৃহীত হয়েছে, তথাপি নারী আন্দোলন প্রত্যয়টি নারীমুক্তি প্রত্যয়ের সমার্থক হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন দেশে ব্যবহূত হয়। দ্বিতীয় ধারার নারীবাদের দুটি মূল শ্লোগান হলো ‘যা ব্যক্তিগত তা-ই রাজনেতিক’ এবং ‘নারীমুক্তি’।

তৃতীয় ধারা শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে। দ্বিতীয় ধারার নারীবাদে শ্বেতাঙ্গ নারীদের প্রতিচ্ছবি রূপায়ন করাকে তৃতীয় ধারার নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করেছে এবং ঐ ধারার মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ নারীর অভিজ্ঞতার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ এবং শ্বেতাঙ্গ মহিলার অভিজ্ঞতাকে বিশ্বজুড়ে সকল নারীর অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করেছে। দ্বিতীয় ধারার মতবাদের বিরোধিতা এসেছে মূলত পূর্বের উপনিবেশ ও তৃতীয় বিশ্ব থেকে। তৃতীয় ধারার নারীবাদ বিশ্বাস করে যে, ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য দেশগুলোর হাতে বর্ণগত, শ্রেণিগত ও নৃগোষ্ঠীগত শোষণ ঔপনিবেশিকউত্তর সমাজে নারীকে প্রান্তিক করে রেখেছিল। এ ধারা মতে, ঔপনিবেশিক সমাজে পিতৃতন্ত্রই জেন্ডার বৈষম্যর একমাত্র কারণ নয় বরং ঐ সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যের অন্যতম কারণ হলো উপনিবেশবাদ। ঔপনিবেশিকউত্তর নারীবাদীরা উপমহাদেশের শিক্ষিত নারীদের নিস্ক্রিয় ও নির্বাক প্রতিরূপ এবং পশ্চিমা আধুনিক শিক্ষিত এবং ক্ষমতাশীল নারীর চিত্রকে সমালোচনা করেন। তৃতীয় ধারার নারীবাদ মূলত স্থান ও সংস্কৃতি ভেদে নারীদের পরস্পর থেকে ভিন্ন বলে মনে করে।

তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদীরা ‘আত্মপরতন্ত্র বর্ণবাদ, শ্রেণিবাদ, জাতিবিদ্বেষ’ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নারীদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা উপেক্ষা করার জন্য পশ্চিমা নারীবাদীদের সমালোচনা করে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে যে নারীবাদ বিকাশ লাভ করেছে, পশ্চিমা নারীবাদীরা সে নারীবাদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করায় সমালোচিত হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ নারীবাদ অ-শ্বেতাঙ্গ বিশ্বের নারীদের সমস্যা বুঝতে পারে নি। বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে নারীবাদী অভিজ্ঞতার উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, যা পশ্চিমা নারীবাদী অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন। এখন ক্রমেই উপলব্ধি জোরদার হচ্ছে যে, পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেয়া মডেল দিয়ে নয়, প্রত্যেক দেশ ও প্রত্যেক অঞ্চলকে নিজ নিজ সমাজের সাংস্কৃতিক মডেলের আওতায় নির্যাতন, অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজস্ব সংগ্রাম ও আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে।

তৃতীয় ধারার নারীবাদের মূল যুক্তি হলো নারীরা বর্ণ, জাতি, দেশ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন। তৃতীয় ধারার নারীবাদ সকল স্ববিরোধিতা ও দ্বন্দ্বকে গ্রহণ করে এবং সকল বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনকে স্থান করে দেয় এবং নারীর জন্য কি মঙ্গলকর, কি মঙ্গলকর নয়, সে সম্পর্কে দ্বিতীয় ধারার মডেলকে চ্যালেঞ্জ করে। উন্নত ও উন্নয়নশীল সমগ্র বিশ্বে স্কুল কলেজে মেয়েদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তারা শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করছে, তারা শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করছে। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে। চলাফেরার স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে। তারা বিচিত্র অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে বিগত দশকের নারীবাদের মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা সত্তর দশকের নারীবাদীদের বিশ্বাস ও কর্মকান্ডকে অনুসরণ করতে সম্মত নয়। নতুন অর্জিত স্বাধীনতা তাদের অতীতের অবস্থায় আবদ্ধ থাকতে সম্মত নয়। তারা অগ্রসর হতে চায় এবং স্বাধীন নারী প্রজন্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা নতুন ও অভিনব পরিপূর্ণতা লাভ করতে চায়। তৃতীয় ধারার নারীবাদের আর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে সহিংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তৃতীয় ধারা পারিবারিক সহিংসতা এবং কর্মস্থলে হয়রানির বিরোধিতা করে।

ভারতে নারীবাদ  হল ভারতের নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার আন্দোলন। এই ধারণাগুলিকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রেও এই আন্দোলনের অংশীদারেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকেন। এটি ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। অন্যান্য দেশের নারীবাদী আন্দোলনের মত ভারতেও এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্যের মধ্যে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা অর্জন সমান পারিশ্রমিকে কাজ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সমানাধিকার এবং রাজনীতিতে সমানাধিকার। ভারতীয় নারীবাদীরা ভারতের নির্দিষ্ট পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে কিছু স্বতন্ত্র আন্দোলনও পরিচালনা করেছেন, যেমন সতীদাহ প্রথা রদ ও উত্তরাধিকার আইনের প্রতিষ্ঠা।

ভারতে নারীবাদের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসনের আরম্ভের পর সতীদাহ প্রথার বিরোধিতার মাধ্যমে সূত্রপাত হয় প্রথম পর্বের। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সংস্কারপন্থীরা শিক্ষায় সংস্কার করে নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন, বিভিন্ন প্রথায় নারীদের অংশগ্রহণের কথা বলেন। ১৯১৫ থেকে ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত স্থায়ী দ্বিতীয় পর্বে মহাত্মা গান্ধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনে নারীদের সামিল করে নেন এবং দেশের নানা স্থানে স্বতন্ত্র নারী সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর অর্থাৎ তৃতীয় পর্বে ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়েছে বিয়ের পর, কর্মক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মেয়েদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা।

ভারতের নারীবাদী আন্দোলনের সাফল্য এখনও অবধি সীমিত। আধুনিক ভারতের অধিবাসী নারীদের বহু ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের জমিতে অধিকার ও শিক্ষায় অধিকারের বিষয়গুলোতে বিশেষ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। গত দুই দশকে দেশে লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাতের প্রবণতা বেড়েছে। বর্তমান ভারতে নারীবাদ এগুলোকে নির্মূল করতে চায়। ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের সমালোচনাও হয়েছে। এই সমালোচনার মূল অভিযোগ হল এই আন্দোলন দেশের ইতোমধ্যেই বিশেষাধিকার প্রাপ্ত নারীদের মধ্যে বহুলাংশে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে ও নিম্ন বর্ণের নারীদের অবহেলা করছে। এর ফলে বর্ণভিত্তিক নারী-সংগঠন ও আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে।[

ইসলামে নারীর সম্মান, হিজাব, নিরাপত্তা 

১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবস! নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাজমা খানের উদ্যোগে ২০১৩ সাল থেকে গত এক যুগ ধরে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর সব ধর্ম ও শ্রেণি-পেশার নারীর কাছে হিজাবের সৌন্দর্যকে পরিচিত করা।

ইসলামের বিধানসমূহের মধ্যে হিজাব একটি গুরুত¦পূর্ণ বিধান। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, “হে রাসূল! মুমিন পুরুষদের বলে দিন! তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।” (সূরা ২৪ আন-নূর ৩০)। আল্লাহ আরো বলেন, “হে নবী! মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।” (সূরা ২৪ আন-নূর ৩১)। মূলত হিজাবের মূল উদ্দেশ্য হলো নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে বন্ধ করা। যার মাধ্যমে সমাজ থেকে অনাচার বিলুপ্ত হবে। ইসলামের প্রথম যুগে হিজাবের বিধান নাজিল হওয়ার পর সর্বপ্রথম এ বিধানটি পালন করেছিলেন মহিলা সাহাবীগণ। হিজাব পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন তারা। হিজাব পালনের মাধ্যমে তারা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। উম্মাহর খেদমতে নিজেদের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়েছিলেন। হিজাবের মধ্যে অবস্থান করে তাদের জীবনব্যবস্থা কেমন ছিল তার কিছু খণ্ডচিত্র জানার চেষ্টা করব আজ আমরা। যার মাধ্যমে হিজাবের প্রকৃত স্বরূপ ও গুরুত্ব আমাদের হৃদময়ঙ্গম করতে সহজ হবে আশা করি।

হিজাব পালনে প্রথমেই আসে পোশাকের কথা। ঐতিহাসিক ইবন সাদ তার আত-তাবাকাত গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রা.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন যার মাধ্যমে বোঝা যায়, তিনি পাতলা কাপড় যাতে শরীর দৃশ্যমান হয় এমন পোশাক পছন্দ করতেন না। হযরত আয়েশা (রা.)-এর ভাতিজী হাফসা বিনত আবিদর রহমান মাথায় একটি পাতলা ওড়না পরে তাঁর সাথে দেখা করতে এলে তিনি তাকে একটি মোটা ওড়না পরতে দিয়ে বলেন, “তুমি জান না, আল্লাহ তায়ালা সূরা নূর-এ কি বলেছেন!”

পায়ের কোন অংশ বের হয়ে থাকাও ছিল তাদের কাছে অপছন্দনীয়। তিরমিযীর হাদীসে আছে, হযরত ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, “যে ব্যক্তি তার পরিধেয় বস্ত্র অহঙ্কার বসত ঝুলিয়ে দিয়ে চলা-ফেরা করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার দিকে তাকাবেন না। এ কথা শুনে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা (রা.) বললেন, তাহলে মহিলারা তাদের কাপড়ের আঁচল কীভাবে রাখবে? তিনি বললেন, এক বিঘত ঝুলিয়ে দেবে। অতঃপর তিনি বললেন, তাতে যদি তাদের পা উন্মুক্ত থাকে। তিনি বললেন, তবে এক হাত পরিমাণ ঝুলিয়ে দিবে, এর বেশি নয়।”

উপরের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে নারীকে প্রয়োজনের তাগিদে হিজাব রক্ষা করে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ইসলাম অনুমোদন করে। তবে কোন অবস্থায় হিজাববিহীন বা গায়রে মাহরামের সাথে অবাধ মেলামেশাকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম হিজাবের মাধ্যমে নারীকে আবদ্ধ করে রাখেনি, বরং নারীকে নিরাপত্তা ও সম্মান দান করেছে।

পত্রপত্রিকা খুললেই নারী নিগ্রহের যে ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাই, তার পেছনে অন্য অনেক কারণের সাথে নারী ও পুরুষ উভয়ের পর্দাহীনতা, অবাধ মেলামেশা একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই সমাজের নারী-পুরুষ উভয়েরই হিজাবের বিধানের মধ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়াটা জরুরি। প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা।

উপসংহার

ইসলামে নারীর সম্মান, হিজাব, এবং নিরাপত্তা নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে, তা আধুনিক পশ্চিমা সমাজের তুলনায় ভিন্ন। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীকে সম্মানিত করার মূলনীতি হলো তাকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, এবং মর্যাদা প্রদান করা। হিজাবের মাধ্যমে ইসলাম নারীকে তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণতাকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। পশ্চিমা সমাজ যেখানে নারীর শারীরিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, সেখানে ইসলাম নারীর পূর্ণ মর্যাদা এবং সামাজিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়। যদিও পশ্চিমা সমাজের ধারণায় নারীর স্বাধীনতা এবং সমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইসলাম নারীর সমান মর্যাদা ও অধিকারকে দৃষ্টিভঙ্গির মূল ভিত্তি হিসেবে রাখে, যা নারীকে কেবল শারীরিক নয়, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক দিক থেকেও সম্মানিত করতে চায়।

এভাবে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী যে মর্যাদা লাভ করে, তা কোনোভাবেই পশ্চিমা ধারণার সাথে বিপরীত নয় বরং একটি গভীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজের বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং চিন্তাধারা নারীকে সম্মান ও অধিকার দিতে বিভিন্ন পথে চলে, তবে ইসলামের মূল লক্ষ্য হলো নারীর নিরাপত্তা, সম্মান, এবং সমাজে তার যথাযথ ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করা।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter