আলোহীন চোখে আখিরাতের পথ: দ্বীনি শিক্ষার ঘাটতি, করণীয় ও দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষার গুরুত্ব ও অবদান
দ্বীন ইসলাম, উম্মাতে মুসলিমা তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুবিধ খিদমতের ব্যাপারে বেসরকারী দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর অবদান এক কথায় অতুলনীয়। ইসলাম বিদ্যার্জন ও জ্ঞানার্জনকে মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয করে দিয়েছে, কারণ জ্ঞান বিদ্যা ব্যতিরেকে দুর্লভ মানব জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনা কোনক্রমেই। কুরআন মাজীদের ঘোষণা, "যারা এ পৃথিবীতে জ্ঞানাচ্ছ, তারা সেই পৃথিবীতেও অন্ধ হয়ে উঠবে।" বোঝা যাচ্ছে যে, বিদ্যাহীনতা ও অজ্ঞানতাকে অন্ধত্ব বলা হয়েছে। একটু ভেবে দেখলেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি এবং কোথায় যেতে হবে, তথ্য কেনই বা এই আবর্তন-বিবর্তন,-এ সম্পর্কে সম্যক ধ্যান-ধারণা ও দৃঢ় বিশ্বাস ছাড়া নিশ্চিন্ততায় বেঁচে থাকা যায় না। জী হ্যাঁ যায়, কিন্তু সেটা যে একান্তভাবেই উদ্দেশ্যহীন ও বেপরোয়া জীবন, তাতে সন্দেহ নেই। শ্রেষ্ঠতম মননশীল প্রাণী মানুষ বেপরোয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে কেন? যদি হয় তবে সে পশু পাখীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোথায়।
পার্থিব জীবনে ও পরকালে সাফল্য অর্জনের জন্যই দ্বীন ইসলাম বিদ্যার্জনকে অপরিহার্য ঘোষণা দিয়েছে। প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ইসলাম এই দুআটিকে ফরয দিয়েছে-
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এই জীবনকেও সুখ শান্তিময় করো, সেই জীবনকেও সুখী সুন্দর করিও আর আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করিও” (সূরাহ বাক্কারাহ, আয়াত নং ২০১)।
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে দ্বীনি শিক্ষার অপরিহার্যতা
এই শ্রেষ্ঠতম দুআটির সারমর্ম হতে জানা যাচ্ছে যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরেও একটি চিরস্থায়ী জীবন আছে এবং সেই জীবনের কল্যাণকর হওয়াটা এই জীবনের কল্যাণময়তার ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে মানুষ ব্যর্থ হলেই যে তাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতেই হবে, তারও স্পষ্ট ইসারা দুআটিতে মওযুদ রয়েছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, পার্থিব জীবন অতিবাহিত করা কোনো সহজ সরল ব্যাপার নয়। জীবন যাত্রায় তরতরিয়ে চলার জন্য 'সরল পথ'-এর সন্ধান পাওয়া একান্তভাবেই জরুরী। আর এই 'সিরাতিম মুস্তাকীম'-এর নির্ভুল- নির্ভরযোগ্য সম্মান প্রদান করাই হচ্ছে দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষার লক্ষ্য, যাতে মানুষ ইহকাল ও পরকালকে সুখশান্তিময় রূপে গড়ে তুলতে ব্যর্থ না হয়।
মূলতঃ এখানেই দুনিয়াবী ও দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘোর ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। পবিত্র কুরআনের তথা মানব জীবনের. দেশ দুনিয়ায় প্রচলিত শিক্ষালয়ের সিলেবাসে 'পরকাল' বলে কিছু আছে কি? থাকবারও কথাও নয়। আল্লাহ সেখানে নির্বাসিত। ধর্ম ধার্মিকতা উপেক্ষিত। এমাগ্রন্থ অবহেলিত। পরকাল এখন অধিকাংশ মনুষের কাছে নিছক কল্পিত ধ্যান ধারণায় পরিণত। অতএব দুনিয়াটাই এখন সব কিছু। এমন বিদ্যা অর্জন করো, যে বিদ্যায় অর্থোপার্জনের সুসম্ভবনা বিস্তর। পরিতাপের কথা যে, মুসলিমদের মধ্যেও এই প্রবণতা এখন আসমানে উঠেছে। উকীল, ডাক্তার, অফিসার, প্রফেসার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরি করার নেশা চেপে বসেছে। একেবারে বাচ্চাকাল হতেই ধর্মহীন শিক্ষাদানের প্রতি বাপ-মায়ের মনোবাঞ্ছা দুর্নিবার হয়ে উঠছে। একালে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে কেবলমাত্র সহায় সম্বলহীন দীনদরিদ্রপরিবারের হীনমন্যতাগ্রস্ত, ক্ষীণকায় ছেলেমেয়েরাই পড়া লেখা করছে। অস্বীকার কার উপায় আছে কি?
ইসলামী জ্ঞানের ঘাটতি: ভাষা, মানসিকতা ও সমসাময়িক বাস্তবতা
এ কথা অকপটে স্বীকার করতে হবে যে, আরবি ভাষা জানার অভাব কিংবা কুরআন-হাদীসের যথার্থ অর্থ ও মূল ভাবকে মাতৃভাষায় গভীরভাবে উপলব্ধির ব্যর্থতা—আজকের বহু মুসলমানের জন্য ইসলামকে আত্মস্থ করার পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামের মূল ভিত্তি—তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত—এই তিন বিষয়ের ওপর সঠিক বিশ্বাস ও গভীর উপলব্ধি গড়ে উঠা ছাড়া ইসলামী জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অথচ, আজকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায়—স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে—এই মৌলিক বিশ্বাসগুলো শেখার বা বোঝার কোন বাস্তবিক সুযোগ নেই।
প্রশ্ন জাগে—শুধু জুমার খুৎবা কিংবা ঈদের নামাজের কয়েক মিনিটের বক্তব্য শুনে কি একজন মুসলমানের ঈমানী চেতনা বিকশিত হতে পারে? একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মুসলিম যুবসমাজ—বিশেষত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা—আজ দুনিয়াবি ব্যস্ততায় এমনভাবে নিমগ্ন যে, দ্বীনি মাহফিল, আলোচনা সভা বা অনূদিত ইসলামি বই পড়ার সময় তারা পায় না; পেলে মন দেয় না; আর মন দেয় না, কারণ সে মন তৈরিই হয়নি।
ফলাফল হলো—আমরাও, আমাদের সন্তানরাও দ্বীনি জ্ঞানের দিক থেকে চরম রকমের দীনহীনতার মধ্যে বাস করছি। এখানে দ্বীনি দীনতা মানে শুধু অজ্ঞতা নয়, বরং আত্মার অভাব, ঈমানের দুর্বলতা এবং জীবনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদাসীনতা।
❝فَمَن كَانَ فِي هَـٰذِهِ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِي ٱلْآخِرَةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًۭا❞
“যে ব্যক্তি এই দুনিয়াতে অন্ধ (অন্তরের দৃষ্টিহীনতায়), সে আখিরাতেও অন্ধই থাকবে এবং আরো বিভ্রান্ত হব”—সূরা বনী ইসরাঈল, ১৭:৭২
দ্বীনি শিক্ষার ফরজিয়ত ও প্রয়োজনীয় উপাদান
ইসলাম কোনো ধর্মীয় অনুশাসনমাত্র নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই সমস্ত রকমের অন্ধত্ব—বিশেষত আত্মিক অন্ধত্ব দূর করার জন্যই দ্বীনি শিক্ষা মুসলমানদের জন্য ফরজ করে দেওয়া হয়েছে।
এই শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনটি জিনিস অপরিহার্য:
১. তালীম (শিক্ষা)
২. তারবিয়াত (চরিত্র গঠন)
৩. সোহবত (সৎ পরিবেশে অবস্থান)
আলহামদুলিল্লাহ, দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো—বিশেষত কিতাব বিভাগগুলো—এই তিনটি উপাদান একসঙ্গে দেওয়ার যোগ্য পরিবেশ তৈরি করে। সেখানে কুরআন ও সহীহ হাদীসের শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী শুধু তথ্যগত জ্ঞান লাভ করে না, বরং তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও আমলিক বাস্তবতা অর্জন করে।
সেখানে নামায না পড়ে, রোজা না রেখে, কুরআন তিলাওয়াত না করে, দরূদ শরীফ পাঠ না করে চলা যায় না। এইভাবে দ্বীন একটি জীবন্ত অভ্যাসে পরিণত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—মাদ্রাসার শিক্ষকদের বা মুদাররিসদের সাহচর্যে শিক্ষার্থীরা সৎকাজের প্রতি প্রেরণা ও নেক মানুষের সংস্পর্শ লাভ করে, যা তাদের চরিত্র ও চিন্তাকে দীপ্ত করে।
আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা
অন্যদিকে, অধিকাংশ আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) এসব দ্বীনি উপাদান অনুপস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত দুনিয়াবি চাকরি ও অর্থ উপার্জনের দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে কুরআন-হাদীস, হালাল-হারাম, পর্দা, তাকওয়া, সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি মৌলিক ইসলামী মূল্যবোধের কোনো স্থান নেই।
ফলে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বহু মুসলিম শিক্ষার্থী ধর্মীয় দিক থেকে শুধু দুর্বল নয়, বরং একপ্রকার "রেওয়াজী মুসলিম" হয়ে উঠছে। তারা মুসলমান পরিচয়ে নামাজবিহীন, কুরআনবিমুখ, এবং আত্মিক জবাবদিহিতা থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন।
তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়—চাকরি, ব্যবসা, অর্থ, ভোগ এবং আরাম। অথচ, ইসলাম বারবার সতর্ক করে দিয়েছে যে, জীবনের সব কাজই একদিন হিসাবের জন্য পেশ করা হবে।
ইসলাম কী বলে?
❝قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ ﴿١٤﴾ وَذَكَرَ ٱسْمَ رَبِّهِۦ فَصَلَّىٰ ﴿١٥﴾ بَلْ تُؤْثِرُونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا ﴿١٦﴾ وَٱلْءَاخِرَةُ خَيْرٌۭ وَأَبْقَىٰ﴿١٧﴾❞
“নিশ্চয় সে-ই সফল, যে আত্মশুদ্ধি করেছে, এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে সালাত কায়েম করেছে। বরং তোমরা পার্থিব জীবনকেই প্রাধান্য দাও, অথচ আখিরাতই উত্তম ও চিরস্থায়ী।”—সূরা আল-আ‘লা, ৮৭:১৪-১৭
এমন বাস্তবতায় দ্বীনি শিক্ষা ও দ্বীনদার পরিবেশ থেকে দূরে থাকা মানে শুধু দ্বীনের ক্ষতি নয়—বরং নিজের আত্মার ক্ষতি। দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান ছাড়া জীবনকে ঈমান ও আমলের পথে নির্ভুলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
আধুনিক চাহিদার সাথে দ্বীনি শিক্ষার সমন্বয়
কথাগুলো অপ্রিয় হলেও চরম সত্য নয় কি? এটাও একটা অকাট্য সত্য কথা যে, দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে একযোগে দ্বীনি ও দুনিয়াবী উভয়ই শিক্ষা দেওয়া হয়, কিন্তু স্কুল-কলেজের দুনিয়াবী শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্বীনিয়াতের কোনো স্থানই নেই। দেহের ও পোষাকের পাক পবিত্রতার কথা মাদ্রাসা শিক্ষায় আছে, কিন্তু স্কুল কলেজে দুনিয়াদারেরা 'পরিচ্ছন্নতা' বোঝে কিন্তু 'পাক সাফ' বোঝে না, পবিত্রতা কাকে বলে জানেনা। নখ, চুল, গোঁফকে কেটে হেঁটে সুন্দরভাবে রাখতে, পরিধেয় বস্ত্রকে মাটির ছোঁয়া হতে রক্ষা করতে, খাদ্যকে ডানহাতে চেটে চেটে খেতে যে রুচিকর সুশিক্ষা মাদ্রাসায় পাওয়া যায়, তার তুলনা হয়না। সম্প্রতিকালে দুনিয়ার সকল দ্বীনি মাদ্রাসাতেই যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের জায়েজ হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে। কম্পিউটারের জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। টেলারিং তো আগে থেকে আছেই। মেকানিক্যাল শিক্ষা কোথাও কোথাও চালু হয়েছে। বাংলা-হিন্দী-ইংলিশ প্রভৃতি ভাষা শেখানো হচ্ছে পুরোদস্তুর। বিজ্ঞান-ভূগোল- গণিত সহ জেনারেল নলেজেও পুড়য়াদের পটু করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে। যেটুকু বাকি আছে সেটা কেবল অর্থের অভাবেই। কিন্তু তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে সুনাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা এক কথায় অতুলনীয়।
নৈতিকতা ও দেশপ্রেমে মাদ্রাসার অবদান
এই কারণে যে, খিদমতে খালk অর্থাৎ নিঃস্বার্থভাবে নিশ্চয় নিঃস্বার্থে মানব সেবার যে সুশিক্ষা এখানে পাওয়া যায়, অন্য কোথাও কল্পনাতীত ব্যাপার। কেননা, একমাত্র ইসলামই এ সুশিক্ষা দেয় যে- হাকুল্লাহ এবং হাক্কুল ইবাদ বলে দুটো কথা আছে, যে দুটোকেই যথাসাধ্যভাবে পালন করা প্রত্যেক মুসলিমের ফরয কর্তব্য। পারলৌকিক কামিয়াবীর জন্য দুটোকেই সমানতালে আঞ্জাম দেওয়া অপরিহার্য। নতুবা আল্লাহর দরবারে অপরাধী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই ভয়ে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরী জনসেবাকে দ্বীনি দায়িত্ব মনে করে। খিদমত করে কিন্তু প্রচার করেনা। লোক দেখানো প্রবৃত্তি হতে দূরে থাকে। সব কিছু আল্লাহর খুশীর জন্যই করে। জীবনের প্রিয়তম জিনিসটিকে আল্লাহর রাহে দান করতে শিক্ষা পায়। পেটের কেটেও পকেটে হাত ভরে বিলিয়ে দিতে শেখে। এরা মন্দের বিরোধিতা করার সুশিক্ষা অর্জন করে, ভালোকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ারও তালিম পায়। সুনাগরিক আর কাকে বলে? জয়হিন্দ জয়হিন্দ করে চেঁচালেই কি দেশভক্তি এসে যায়? দেশের পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, বন-জঙ্গল ইত্যাদিকে ভালোবাসলেই কি দেশকে ভালোবাসা হয়ে যায়? প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাজই হচ্ছে, দেশের দুর্বল শ্রেণীকে কথা ও কাজ দিয়ে ভালোবাসা। অপসংস্কৃতিকে দূর করতে সচেষ্ট হওয়া। বাতিলের জায়গায় হককে প্রতিষ্ঠান দানের চেষ্টা করা। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষকে এক আল্লাহর বান্দা ও এক আদম হাওয়ার সন্তান মনে করা। এরই ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্ববোধে উত্তীর্ণ হওয়া। সুখের কথা যে, দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোতে এই দুর্লভ সুশিক্ষাই প্রদান করা হয়ে থাকে। ইসলামী ঈমান ও আমালের এগুলি অপরিহার্য অঙ্গ। সওয়াল ওঠে যে, সুনাগরিক গড়ে তোলার এমন উচ্চমানের শিক্ষা ও দীক্ষা এক মাদ্রাসা ছাড়া অন্য কোথাও দেওয়া হয় কি? সূরাহ নিসার প্রথম আয়াতে ঘোষিত হয়েছে-
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُوا۟ رَبَّكُمُ ٱلَّذِى خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍۢ وَٰحِدَةٍۢ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًۭا كَثِيرًۭا وَنِسَآءًۭ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ٱلَّذِى تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًۭا
অর্থাৎ "হে বিশ্বের মানবমণ্ডলী। তোমাদের প্রকৃত প্রভুকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি প্রাণ হতে সৃষ্টি করেছেন, তা হতেই তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন এবং উভয় হতে বহু পুরুষ ও নারী-দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেই প্রভুকে ভয় করো, যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের নিকট হতে নিজের নিজের হক দাবি করে থাকে এবং আত্মীয়তার নিকট সূত্র বিনষ্ট করা হতে বিরত থাকো। নিশ্চিত জানিও যে, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া দৃষ্টি রেখেছেন" (৪:০১)।
বলা প্রয়োজন, এমন সুশিক্ষার জন্য দেশের ও প্রদেশের সরকারকে একটি পয়সাও খরচ করতে হয় না। গোটা ভারতে এখন ছোটবড়ো মিলিয়ে ইসলামী মাদ্রাসার সংখ্যা ৫০ হাজারের কম নয়। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা কয়েক লক্ষ। চিন্তা করে দেখুন, স্বাধীনতার পরে এদেশে কতো সংখ্যক দীন দরিদ্র ছেলেমেয়েরা এসকল প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় পেয়ে আরবী-ফার্সী-উর্দু-বাংলা-হিন্দী- বিজ্ঞান-ভূগোল ইত্যাদির জ্ঞান লাভে ধন্য হয়েছে। অতুল্য ইসলামী শিক্ষা তো পেয়েছেই। সুনাগরিকত্বের সুশিক্ষাও দ্বীনি মাদ্রাসায় পাচ্ছে।
দীন-দরিদ্ররা দ্বীনি মাদ্রাসাতেই বিদ্যার্জন করে, খায়, থাকে ফ্রীতেই। তাদের অধিকাংশই মাদ্রাসা, মাসজিদ, ইয়াতিম খানায় জীবন জীবিকা নির্বাহ করে এ-ভাবেই। এসব কথা, যোলো আনাই সত্য কথা। এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থানের জন্য সরকারকে কিছুই ভাবতে হয়না। এর পরেও কি বলা চলে যে, সমাজ ও দেশকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামী মাদ্রাসার কোনো অবদান নেই? দেশে শান্তি সংহতি গড়ে তুলতে ইসলামের কোনো ভূমিকা নেই? অত্যন্ত জঘন্য কথা যে, স্বাধীনতার বয়স যতোই বাড়ছে, দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সরকারের তথা দেশের এক শ্রেণীর পরশ্রীকাতর নাগরিকদের সহিংস ষড়যন্ত্র ততোই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
মাদ্রাসা বিরোধী অপপ্রচার ও বাস্তবতা
বিগত কয়েক দশক হতে প্রায়ই বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অনুকরণে ভারতের ইসলামী মাদ্রাসাগুলিতেও বহুনিন্দিত তালিবানী ফৌজ তৈরি করা হচ্ছে। প্রমাণিত হলে মানতেই হবে যে, খোদ মুসলিমরাই ইসলামী জীবনাদর্শের ঘোর শত্রু। অতএব শাস্তিও অনিবার্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো মাদ্রাসাতে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। যা কিছু পাওয়া গেছে তা এই যে, অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই ছাত্রদের জন্য প্রয়োজনীয় চৌকী- টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চ ইত্যাদির বড়োই অভাব। ভালো কীচেন নেই, একসাথে সবাই বসে খাওয়ার জায়গা নেই, ভালো লাইব্রেরী নেই। খাদ্য-পানীয় সবই নিম্নমানের। এমন দূরবস্থায় বোমা-পিস্তলের ব্যয়বহুল শিক্ষাদান কষ্টকল্পিত ব্যাপার নয় কি? তাছাড়া এদেশে ইসলামী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মূলে কখনো কি এমন হীন উদ্দেশ্য নিহিত ছিল? আসল কথা, অন্যদেশের সন্ত্রাসবাদের উত্তপ্ত হাওয়ায় এদেশের মুসলিম জনতা এবং মাসজিদ মাদ্রাসাগুলি কোনোদিনই প্রভাবিত হয়নি, আর হবে নাও, কারণ মিশ্রিত সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের যে শিক্ষা দিয়েছে, ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় আগাগোড়া সে অনুযায়ীই সবার সঙ্গে মিলে মিশে এদেশে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোতে সে শিক্ষাই তো দেওয়া হয়ে থাকে। কুরআনী আয়াতের আলোকে তালিবে ইল্ল্মদের শেখানো হয় যে, মন্দের জবাব মন্দ দিয়ে নয় বরং ভালো দিয়ে দাও। যে সকল অমুসলিম উম্মাতে মুসলিমাকে তাদের জন্মভূমি হতে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র রচেনা, ধর্ম পালনে বাধা দেয় না, তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করো। সূরাহ মুমতাহিনা'র ৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলার বাণী -
لَا يَنْهُكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمُ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوُهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِين
অর্থাৎ "আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না এই কাজ হতে যে, তোমরা সেই লোকদের সঙ্গে কল্যাণময় ও সুবিচারপূর্ণ ব্যবহার করবে যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সহিত যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ী-ঘর হতে বহিষ্কৃত করেনি। সুবিচারকারীদের আল্লাহ্ পছন্দ করেন।"
উপসংহার: রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণে মাদ্রাসার প্রয়োজনীয়তা
কোনো দোষত্রুটি ব্যতিরেকে কেবলই ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্যই মাদ্রাসাগুলির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ নয় কি? এদেশে ধর্ম-সংস্কৃতির নামে বহু মতবাদ চালু আছে, পালন করা ও প্রচার করারও সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। ধর্মের নামে শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলারও অধিকার দেওয়া হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রীস্টান সকলেই এই অধিকার ভোগ করছেন। এতোটুকুই কেবল দরকার যে, ধর্মের নামে কেউ যেন জোরজবরদস্তি ও বাড়াবাড়ি না করে। ইসলামও এই মন মানসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সন্তোষের কথা যে, এদেশে যুগ যুগান্তর ধরে বিভিন্নতার মধ্যে একতার পরিবেশ বিরাজ করছে। মাঝে মধ্যে হিংসুকের দল মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দুর্ভাগ্যের কথা যে, রাষ্ট্রীয় সরকার এবং প্রশাসনও বহুক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টতায় ভুগছে। ফলে আমজানতার আত্মীয়তাবোধে ফাটল ধরছে।
ইসলামী শিক্ষাদীক্ষার নামে এদেশে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলি কোনো অর্থেই রাষ্ট্রবিরোধী, সমাজ শত্রু নয়। বরং রাষ্ট্রনির্মাণে এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে এগুলির নিঃশব্দ ভূমিকা অতি প্রশংসনীয়। অতএব দীন-দরিদ্র ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দীক্ষা ও খাওয়া পরার আশ্রয়ভূমি এই মাদ্রাসাগুলিকে আরও যুগোপযোগী রূপে গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেক সামর্থবান মানুষদের উদার হস্তে এগিয়ে আসাও এক অপরিহার্য কর্তব্য। উৎসাহিত করা এবং সুরক্ষার গ্যারান্টি দেওয়াও সরকার ও প্রশাসনের এক অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা, হিংসুকদের মিথ্যা ও মনগড়া বয়ানবাজিতে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো এ-কালে ভীষণ রকম মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে তথা সরকার ও প্রশাসনকে বুদ্ধি দান করুন, এই হচ্ছে আমাদের সকাল-সন্ধ্যার দুআ - আমীন।