ওস্তাদ মুহাম্মদ ফতুল্লাহ গুলেন: একজন পণ্ডিত যিনি সময়ের স্রোতকে উপলব্ধি করেছেন

হিজমত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ওস্তাদ মোহাম্মদ ফতুল্লাহ গুলেন ছিলেন একজন নম্র স্বভাবের পণ্ডিত যিনি ভারতকে ভালোবাসতেন এবং শায়খ আহমদ সারহিন্দি, (রহ.) আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের মতো ভারতীয় দার্শনিকদের সম্মান করতেন। ওস্তাদ, যিনি মানবজাতির মঙ্গল এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামের বহুমুখী অগ্রগতির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তিনি রেখে গেছেন হাজার হাজার অনুসারী যারা 170 টিরও বেশি দেশে অভিবাসী হয়েছেন, সেখানে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, 80টি মূল্যবান বই, শত শত রেকর্ডকৃত বক্তৃতা এবং একটি অনুকরণীয় জীবন।

সরল জীবন, উপাসনা

মহাশয় ছিলেন এক বিজ্ঞ আলেম ও ধর্মপরায়ন উপাসক যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের ছোট ঘরে থাকতে পছন্দ করতেন, প্রয়োজন মতো কথা বলতেন, অল্প ঘুমাতেন, অল্প খেতেন, রাতে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন এবং ৬৫ বছর ধরে দ্বীনের তাবলিগ ও শিক্ষা দিতেন। তিনি আধুনিক বিশ্ব পরিবেশে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে তা নিয়ে যথেষ্ট কথা বলেছেন এবং পৃথিবী ও মানবতার কল্যাণ ও অগ্রগতির জন্য সমস্ত কর্মকাণ্ডে সর্বাগ্রে থাকতে এবং তা বাস্তবায়িত করার জন্য বিশ্বাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সর্বদা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে বিশ্বাসীর পরিচয় তার আদর্শ জীবনধারা হওয়া উচিত, তিনি কেবল ধারণাগুলিই উপস্থাপন করেননি বরং সফলভাবে সেগুলিকে আত্মজীবনে বাস্তবায়িত করেছেন।

শ্রদ্ধেয় গুলেন 1938 সালে তুরস্কের কোরুজুক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি একজন পণ্ডিত ও ইমাম রামিস এফেন্দির পুত্র। মহোদয় গুলেন দশ বছর বয়সে কুরআন মুখস্থ করেছিলেন এবং চৌদ্দ বছর বয়সে তার গ্রামে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছিলেন, ধর্মীয় অধ্যয়ন শেষ করার পর 21 বছর বয়সে ইডিরনে শহরে একজন সরকারী প্রচারক এবং ইমাম নিযুক্ত হন। 1966 সালে, 28 বছর বয়সে, তিনি ইজমির শহরে পৌঁছেছিলেন।

সর্বদা খোদাভীরু ইমাম

সদ্য আগমনকারী মাননীয় ইমামকে লোকেরা এভাবেই বর্ণনা করত। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসূলকে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, তার জন্য দ্বীনের দুর্দশা এবং বিশ্ব মুসলিমদের সমস্যা ছিল একটি বেদনাদায়ক বিষয়। তিনি মুসলিম বিশ্বের সমস্যাগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সেগুলির সমাধানের জন্য গঠনমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে বার্ধক্য অবধি দৌড়েছিলেন, কিন্তু সেই বেদনা ও কান্না মৃত্যুর শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিল।

ইবাদতে ব্যস্ত জীবন

সে সময়ের মানুষ এমন একজন ইমামকে দেখছিল যে জীবনে প্রথমবারের মতো রাসূলের সুন্নাহ এত বেশি নকল করেছিল। তাহাজ্জুদ বন্ধ না করে, সোম ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত সুন্নত রোজা রাখা এবং অত্যন্ত যত্ন সহকারে সরল জীবনযাপন করে তিনি তাদের হৃদয় চুরি করেছেন। শুধুমাত্র উপাসনাগারে মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি সারা দেশে ভ্রমণ করেছিলেন এবং প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন তিনি সর্বদা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে মুসলমানদের উচিত এই যুগে আমাদের উপর অর্পিত ভালবাসার সুন্দর ধর্মটি মূলত আমাদের নিজের জীবনের মাধ্যমে অন্যদের কাছে তুলে ধরা। তার প্রচেষ্টার ফলে নৈতিক পরিবেশে আধুনিক কলেজগুলো গড়ে ওঠে।

সংঘাত ও কলহমুক্ত বিশ্বের পরিকল্পনা 

নিজের বিশ্বাস ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকা, ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা নির্বিশেষে মানুষকে বিবেচনা করা, আল্লাহর সৃষ্টির সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সৎ এবং সচ্ছল নীতির সম্মান করা।তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজ কোনো বিবাদ ও যুদ্ধ ছাড়াই পরস্পরকে সম্মান করা উচিত আর সকলের প্রচেষ্টা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য হওয়া উচিত যেখানে প্রেম এবং শান্তি সর্বত্র বিদ্যমান। তিনি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন, বিভিন্ন ধর্মের লোকদের একত্রিত করেছিলেন, দাতব্য সভা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং জোর দিয়েছিলেন। জনসাধারণের কল্যাণের জন্য সর্বত্রে হাত লাগিয়েছিলেন।

বিশ্ব মুসলিমদের প্রতি বেদনা

1990-এর দশকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, তখন তিনি 70 বছর ধরে ধর্মীয় অনুশীলন থেকে নিষিদ্ধ, নিঃস্বার্থ শিষ্যদের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান যেখানে একজন শিক্ষার্থী এমন একটি লোকে উন্নীত হতো যে দ্বীনের জন্য যে কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল এবং যাদের হাজার হাজার মানুষের বিশ্বাস রক্ষা করা এবং প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য ছিল।

তাঁর নির্দেশ ও শিক্ষাই তাঁর শিষ্যদের তুরস্কে উন্নত জীবনযাত্রা এবং ইউরোপীয় মানের উচ্চ চাকরির অফার ত্যাগ করতে এবং উষ্ণ দরিদ্র আফ্রিকান দেশ, শীতল সাইবেরিয়ান অঞ্চল এবং এমনকি যুদ্ধ এবং দাঙ্গা দ্বারা বিধ্বস্ত দেশগুলিতে ভালবাসার বার্তা নিয়ে অভিবাসন করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর শিক্ষার উপর ভিত্তি করে অসংখ্য কাজ মানুষের উন্নতি এবং মানব কল্যাণের লক্ষ্যে, প্রাণীদের সেবা করার লক্ষে ফি সাবিলিল্লাহ, বিশ্বের অনেক জায়গায় স্বাস্থ্য কার্যক্রম এবং স্বেচ্ছাসেবী কাজ চলছে।

তিনটি সমস্যা ও সমাধান

তিনি মত দেন যে মুসলিম বিশ্বের প্রধান সমস্যা হল অনৈক্য। অজ্ঞতা ও দারিদ্র্য এবং ঐক্যের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সংলাপ কেন্দ্র স্থাপন এবং অজ্ঞতা দূর করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিনি চালু করেন। বিপুল পরিমাণে মুসলিম জনসংখ্যা কে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবেশ করতে উত্সাহিত করা, এবং যারা এবং যারা আগে থেকেই এই সেক্টরে যারা রয়েছে তাদের সমিতি তৈরি করা এবং তাদের আরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরিতে সহায়তা করার জন্য নেটওয়ার্কিং, দরিদ্রদের উপকৃত করা হলো উক্ত প্রতিষ্ঠাগুলির প্রধান কাজ। সারা বিশ্বে এই আন্দোলনের স্তম্ভ হল প্রত্যেক সৎ মুমিন মানুষ যারা তাদের সাহাবীদের উদাহরণ অনুসরণ করে যারা অনুদানে প্রতিযোগিতা করতেন এবং উদারভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করাকে তাদের কর্তব্য হিসাবে দেখতেন।

অভিযোগ এবং ঘটনা

বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য ভালো মানুষ গঠনের প্রয়োজন এবং তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং এর জন্য তিনি হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছেন।তিনি সারা জীবন গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং ধারাবাহিকভাবে সহিংসতার পক্ষে এবং অসহিংসতার বিরুদ্ধে লিখেছেন এবং প্রচার করেছেন এবং "ভালোবাসা ও সহনশীলতার বৈশ্বিক সভ্যতার দিকেপ্রেম ও সহিষ্ণুতার একটি বিশ্বজনীন সভ্যতার দিকে" (Toward a Global Civilization of Love and Tolerance) এবং "সুফিবাদের অনুশীলনের মূল ধারণা" (Key Concepts in the Practice of Sufism) এর মতো বই লিখেছেন। 

বিনয়ের নমুনা 

ক্ষমতা, অর্থ ও খ্যাতির প্রতি তিনি কখনই মুগ্ধ হননি। তিনি একজন বিনয়ী আলেম ছিলেন। তিনি যখন শ্রোতাদের মধ্যে প্রবেশ করতেন তখন তিনি অন্যদেরকে তার পক্ষে দাঁড়াতে দেননি এবং হিজমতের অধীনে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাউকে তিনি তার অটোগ্রাফ বা তার ছবি তুলতে দেননি। এমনকি একজন নেতার পদটিও তার পছন্দ ছিলনা। তিনি সবসময় জনসাধারণের মধ্যে থেকে একজন হতে চেয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল এবং হোস্টেল 160টি দেশে ছড়িয়ে আছে, তার শিক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত শিক্ষা ইসলামী মূল্য, ধর্মীয় বা শারীরিক নির্বিশেষে, মানুষ গঠন করা একটি পুণ্য।

পুরস্কার এবং স্বীকৃতি

বিশ্ব শান্তি ও ধর্মীয় সম্প্রীতিতে অবদানের জন্য তিনি অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। 2011 সালে নিউইয়র্ক ভিত্তিক ইস্ট ইনস্টিটিউটের শান্তি পুরস্কার, 2013 সালে কোরিয়া থেকে ম্যানহে শান্তি পুরস্কার এবং 2015 সালে গান্ধী কিং ইকেদা শান্তি পুরস্কার মাত্র কয়েকটি। 2018, 2022 এবং 2023 সালে, তিনি বিশ্বের 500 জন প্রভাবশালী মুসলিম পণ্ডিতদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন। 2013 সালে তিনি টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের 100 জন প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন ছিলেন।

সাহিত্যিক অবদান

তিনি একজন কবি, লেখক, প্রভাষক এবং চিন্তাবিদ ছিলেন যিনি 82টি মোটা বই লিখে ভুবনধারা থেকে বিদায় নিয়েছেন। নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে তাঁর 'দ্য ইনফিনিট লাইট' খুবই বিখ্যাত। দা মেসেঞ্জার অফ গড: মোহাম্মাদ, কি কন্সেপ্টস ইন দ্যা প্র্যাকটিস অফ সুফিজম: এমারাল্ড হিলস অফ হার্ট, দা এসেনশিয়ালস্ অফ ইসলামিক ফেইথ, পার্লস অফ উইসডম, কোশ্চেনস এন্ড আনসার্স আবাউট ইসলাম, টোয়ার্ড এ গ্লোবাল সিভিলাইজেশন অফ লাভ এন্ড টলারেন্স, ফ্রম সীড তো সেডার: নারচারিং দা স্পিরিচুয়াল নীডস ইন চিলড্রেন ইত্যাদি তিনার বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে কিছু। বিশ্বে তার অবদানের উপর দশটিরও বেশি গভীর অধ্যয়ন বই আজ পাওয়া যায়। "আল্লাহর জন্য", "বিটুইন থট অ্যান্ড অ্যাকশন; অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল বায়োগ্রাফি অফ ফেথুল্লাহ গুলেন", "এ লাইফ ইন টিয়ার্স", "ফেথুল্লাহ গুলেন এ লাইফ অফ হিজমেট" ইত্যাদি ইংরেজিতে পাওয়া যায়।

তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় বসবাস করেন। তিনি 20 অক্টোবর 86 বছর বয়সে ঈশ্বরের প্রিয় হয়ে যান এবং পারলোকগমন করেন। আল্লাহ তার সকল নেক আমল কবুল করুন এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দিন... আমীন

(Courtesy: Abdurrahman Hudawi )

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter