ড. তাহা জাবির আল‑আলওয়ানী: আধুনিক ইসলামী চিন্তার অগ্রপথিক
ইতিহাসে কখনো কখনো এমন কিছু মানুষ জন্ম নেন, যাঁদের চিন্তা, গবেষণা ও জীবনের প্রত্যক্ষ প্রভাব শুধু সমসাময়িক সমাজেই নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের দিকনির্দেশনায়ও কার্যকর হয়। ড. তাহা জাবির আল‑আলওয়ানী তেমনই একজন মনীষী, যিনি ইসলামি চিন্তার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক ও যুগোপযোগী ধারা প্রবর্তন করেছেন। তাঁর জীবন কেবল একজন ফকীহ বা গবেষকের জীবন নয়, বরং তিনি ছিলেন একাধারে চিন্তাশীল আলিম, ইসলামী জ্ঞানচর্চার নবজাগরণ-দ্রষ্টা এবং আধুনিক মুসলিম সমাজের দিকনির্দেশক।
১৯৩৫ সালে ইরাকের ফাল্লুজা শহরে জন্মগ্রহণকারী ড. আল‑আলওয়ানী তাঁর প্রজ্ঞা, গভীরতা ও চিন্তাশীলতার মাধ্যমে ইসলামী উসূল ফিকহ, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের জন্য এক যুগান্তকারী চিন্তা উপস্থাপন করেন। আজকের এই লেখায় আমরা তাঁর জীবনের নানা দিক—শৈশব, শিক্ষা, গবেষণা, চিন্তাধারা ও তাঁর রেখে যাওয়া অনবদ্য অবদান—বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব।
শৈশব ও প্রারম্ভিক শিক্ষা: আলোর খোঁজে যাত্রা
তাহা জাবির আল‑আলওয়ানীর জন্ম ১৯৩৫ সালে ইরাকের একটি ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক শহর ফাল্লুজায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং কুরআন মুখস্থসহ বুনিয়াদি ইসলামী জ্ঞান অর্জনে একনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ইরাকেই সম্পন্ন হয় এবং অল্প বয়সে তিনি অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রাখেন।
তাঁর জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণা তাঁকে নিয়ে যায় মিসরের প্রখ্যাত আল‑আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি ১৯৫৯ সালে শরীয়াহ অনুষদ থেকে স্নাতক, ১৯৬৮ সালে মাস্টার্স এবং ১৯৭৩ সালে উসূল আল-ফিকহে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর গবেষণার মৌলিক রূপরেখা ছিল ‘সূত্রবদ্ধ ও কুরআনভিত্তিক ফিকহ চর্চা’। এই অধ্যয়নপর্বেই তাঁর চিন্তার ভিন্নতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা উন্মোচিত হতে থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি ও শিক্ষা প্রসার
পিএইচডি অর্জনের পর তিনি বাগদাদে ৬ বছর শিক্ষকতা করেন এবং এরপর সৌদি আরবের ইমাম মুহাম্মদ বিন সৌদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘ ১০ বছর উসূল আল-ফিকহ বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এই সময়েই তিনি বিভিন্ন দেশে ইসলামী চিন্তার প্রচারে যুক্ত হন।
পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে “International Institute of Islamic Thought (IIIT)” নামক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একইসাথে তিনি “Graduate School of Islamic and Social Sciences (GSISS)” এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ফিকহ কাউন্সিল অফ নর্থ আমেরিকার (FCNA) প্রধান ছিলেন।
এই সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি শুধু মুসলিম সমাজেই নয়, বরং সমগ্র জ্ঞানের জগতে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল—ইসলামী জ্ঞান ও আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে এক সূক্ষ্ম এবং সময়োপযোগী সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা।
চিন্তার বৈপ্লবিকতা: কুরআনকেন্দ্রিক ইজতিহাদ
ড. আল‑আলওয়ানীর চিন্তার মূলে ছিল কুরআন ও সুন্নাহকে কেন্দ্র করে উসূল ফিকহের পুনর্গঠন। তিনি প্রথাগত মতামতের অন্ধ অনুসরণে বিশ্বাসী ছিলেন না, বরং কুরআনের আলোকে যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তব-নির্ভর ইজতিহাদে বিশ্বাস করতেন।
তাঁর লেখাগুলোর মধ্যে “Usul al-Fiqh al-Islami”, “Towards a Fiqh for Minorities”, “The Ethics of Disagreement in Islam”, এবং “La Ikrah Fi al-Din” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রন্থে তিনি ইসলামী আইনের মানবিক ও প্রাসঙ্গিক রূপ ব্যাখ্যা করেন, যেখানে মতপার্থক্যকে ধ্বংস নয় বরং বিকাশের একটি ধাপ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
তিনি ইসলামী আইনের বিকাশে “maqasid al-shari‘ah” তথা শরীয়াহর উদ্দেশ্যপূর্ণতা, মানবিকতা ও যুক্তিবোধকে কেন্দ্রীয় ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করেন। তিনি apostasy, interfaith relation, minority rights—এসব বিষয়ে সাহসী এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে নতুন চিন্তার দরজা খুলে দেন।
সংলাপ, সংস্কৃতি ও পারিবারিক জীবন
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ তাঁর জীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকার ধর্মচর্চা মানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সহাবস্থান। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মাঝে তিনি সংলাপের উদ্যোগ নেন এবং “Abrahamic Faiths” ভিত্তিক এক নতুন সহনশীল ধারার প্রতিষ্ঠা করেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন এক আদর্শ মানুষ। তাঁর স্ত্রী মোনা আবুল-ফাদল একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং তাঁর কন্যা ড. জয়নাব আল-আলওয়ানী আধুনিক ইসলামী চিন্তার এক উজ্জ্বল নাম। ড. আল-আলওয়ানী সংস্কৃতিসমৃদ্ধ মানুষ ছিলেন; সংগীত, কবিতা, ইতিহাস—সবই তাঁর জীবনবোধে প্রভাব ফেলেছিল।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
২০১৬ সালের ৪ মার্চ, ভার্জিনিয়ায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু কেবল একজন মানুষের মৃত্যু ছিল না, বরং একজন চিন্তানায়কের প্রস্থানে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তবে তাঁর রেখে যাওয়া শতাধিক প্রবন্ধ, ডজনখানেক বই এবং শতশত বক্তৃতা আজও মুসলিম বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচ্য ও অনুসরণীয়।
উপসংহার: এক প্রজ্ঞাময় আত্মার চিরন্তন দীপ্তি
ড. তাহা জাবির আল‑আলওয়ানীর জীবন কেবল একজন আলিমের জীবন নয়, বরং তা এক চিন্তাশীল আত্মার অন্বেষণ, ইসলামের মৌলিক বার্তাকে আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে রূপান্তরিত করার এক অনবদ্য প্রয়াস। তিনি প্রমাণ করেছেন যে ইসলাম শুধু অতীতমুখী ঐতিহ্যের ধর্ম নয়, বরং চিরন্তন প্রজ্ঞার এক সঞ্চার যা প্রতিনিয়ত নতুনভাবে ভাবা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
তাঁর চিন্তা ও কর্ম আমাদের শেখায় যে পরিবর্তন আসে বিশ্লেষণ ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে; আর এই পরিবর্তনই গড়ে তোলে এমন এক সমাজ যেখানে ধর্ম, বিজ্ঞান, ন্যায় ও মানবতা একসাথে পথ চলে। তিনি শুধু একজন গবেষক ছিলেন না—তিনি ছিলেন ইতিহাসের স্রোত পরিবর্তনকারী এক নীরব বিপ্লবী। তাঁর চিন্তার দীপ্তি যতদিন ইসলামী জ্ঞানচর্চা থাকবে, ততদিন আলোকবর্তিকার মতোই জ্বলতে থাকবে।