হাজি মোহাম্মদ মহসিন: দানবীরতার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি
বাংলার ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছেন, যাঁদের কর্ম ও অবদান মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন হাজি মোহাম্মদ মহসিন। তিনি ছিলেন আত্মত্যাগী, সমাজসেবী ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে নিবেদিতপ্রাণ এক মনীষী। দানবীর হিসেবে তাঁর পরিচিতি শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র উপমহাদেশেই প্রসারিত। নিঃস্বার্থ সমাজসেবা, দরিদ্র-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো, এবং শিক্ষা ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সহায়তার জন্য তিনি আজও স্মরণীয়।
জন্ম ও পরিচয়
এই মহামনীষী হাজি মোহাম্মদ মহসিন ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হাজি ফয়জুল্লাহ এবং মাতার নাম জায়নব খানম—উভয়েই ছিলেন শিক্ষিত ও ধর্মপরায়ণ। পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী; তবে ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী ও সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
শিক্ষা ও হজযাত্রা
তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পারিবারিক উদ্যোগে। শিশু অবস্থায় বাড়িতেই মৌলিক শিক্ষা লাভ করেন। পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি তিনি একজন নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন। পরে তিনি তৎকালীন শিক্ষাকেন্দ্র মুর্শিদাবাদের এক মোক্তবে পড়াশোনার জন্য যান। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা, আরবি ও ফারসি ভাষা, ইতিহাস, সাহিত্য এবং যুক্তিবিদ্যার চর্চা করেন। পাশাপাশি আত্মজিজ্ঞাসা ও আধ্যাত্মিক চিন্তায় মনোনিবেশ করেন।
মুর্শিদাবাদে কিছুদিন শিক্ষালাভের পর তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। পরে আরব দেশে গিয়ে দীর্ঘ ২৬ বছর কাটান। মক্কা, মদিনা ও নাজাফে অবস্থান করে হজ সম্পন্ন করেন, ইসলামী শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং সুফি চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন।
সম্পদের উত্তরাধিকার
হাজি মোহাম্মদ মহসিনের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল তাঁর দিদি মন্নুজানের বিপুল সম্পদের উত্তরাধিকার লাভ। মন্নুজান ছিলেন একজন ধনী নারী, যাঁর স্বামী মির্জা সালাহউদ্দীন ছিলেন নবাব আলীবর্দী খাঁর প্রিয়ভাজন। নবাব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন। ১৭৫৪ সালে মির্জা সালাহউদ্দীনের মৃত্যু হলে মন্নুজান নিঃসন্তান অবস্থায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ভাই হাজি মহসিনের নামে লিখে দিয়ে যান। ১৮০৩ সালে মন্নুজানের মৃত্যুর পর মহসিন তাঁর নিজস্ব সম্পদসহ বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হন। তবে তিনি এই সম্পদের মাধ্যমে বিলাসবহুল জীবনযাপন না করে, সমাজসেবায় নিজেকে নিবেদন করেন।
দান ও সমাজসেবা
হাজি মহসিন তাঁর সম্পদের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেন গরিব, এতিম ও অসহায় মানুষের কল্যাণে। তিনি নিজে অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাঁর কাছে মানুষের ধর্ম, জাত বা সম্প্রদায় কোনো বিভাজনের বিষয় ছিল না। মানবসেবাই ছিল তাঁর ব্রত।
তিনি হুগলি ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষাদান ও ইবাদতের ব্যবস্থা ছিল। পাশাপাশি হুগলি কলেজ ও মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষাবিস্তারে অনন্য ভূমিকা রাখেন। মুসাফিরদের জন্য তিনি থাকার ও খাবারের সুব্যবস্থা করেন। তিনি নিজ হাতে ৭২টি কুরআন শরীফ লিখে তা বিক্রয় করে প্রাপ্ত অর্থ দরিদ্রদের সেবায় ব্যয় করেন। রমজানে রোজাদারদের ইফতার, বিশ্বনবী দিবসে গরিবদের খাওয়ানো, বস্ত্র বিতরণ ও অর্থদান—সব কিছু তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। ১৮০৩ সালে তিনি ‘হাজি মোহাম্মদ মহসিন ওয়াকফ এস্টেট’ গঠন করেন, কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান ও অবিবাহিত। আজও এই ওয়াকফ এস্টেটের আয়ে বহু শিক্ষার্থী, দরিদ্র পরিবার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উপকৃত হচ্ছে।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা
হাজি মহসিন শিক্ষাবিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হুগলিতে তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে আরবি, ফারসি, ইংরেজি, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ের পাঠদানের ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষার্থীদের জামা-কাপড়, বই-খাতা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী তিনি নিজ খরচে দিতেন। তাঁর নিযুক্ত মোতাওয়াল্লিরা ইমামবাড়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ফ্রান্সিস টিড এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৮৩৬ সালে এটি কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
দানবীর হাজি মোহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালের ২৯ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। তাঁকে হুগলি ইমামবাড়ার পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও ওয়াকফ সম্পত্তির মাধ্যমে তিনি আজও অমর।
আজও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ওয়াকফ এস্টেট থেকে পরিচালিত হয় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রম।
মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান সময়ে, যখন সমাজে আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদিতা প্রবলভাবে বিরাজমান, তখন হাজি মোহাম্মদ মহসিনের জীবন আমাদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—ধনসম্পত্তি কেবল ভোগের জন্য নয়; বরং মানবতার সেবায় উৎসর্গ করাই প্রকৃত সফলতা।
তাঁর জীবনদর্শন, দানবীরতা ও সমাজসেবার দৃষ্টান্ত আজকের প্রজন্মকে একটি আলোকিত, দায়িত্বশীল ও মানবিক জীবন গঠনের পথে আহ্বান জানায়।
উপসংহার
হাজি মোহাম্মদ মহসিন ছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ মানুষ। তাঁর প্রতি বাঙালি জাতির ঋণ অপরিমেয়। তাঁর দানশীলতা, মানবপ্রেম, শিক্ষা ও ধর্মের প্রতি অনুরাগ এবং নিঃস্বার্থ সমাজসেবা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। আজ যখন সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে, তখন হাজি মহসিনের জীবনদর্শন ও আদর্শ অনুসরণ করাই হতে পারে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ওয়াকফের মাধ্যমে আজও বহু শিক্ষার্থী শিক্ষালাভ করছে ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাই তিনি আজও স্মরণীয়, অমর এবং চিরস্থায়ী।