কেরলে মুসলমানের উন্নতি কল্পে শাইখ আহমাদ জয়নুদ্দিন মখদুম (রহঃ) এর ভূমিকা

শাইখ আহমাদ জয়নুদ্দিন মখদুম বিন শেখ মুহাম্মদ আল গাজ্জালি আল-মালিবারি), শেখ জয়নুদ্দিন মখদুম প্রথমের নাতি,তিনি ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন ও ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে কেরলের পন্নানি রাজ্যের কুঁহিপাল্লি গ্রামে মৃত্যু বরণ করেন।  তিনি বিভিন্ন পদে অভিজ্ঞ ছিলেন ।তিনি লেখক, বক্তা, ইতিহাসবিদ, আইনশাস্ত্রবিদ এবং আধ্যাত্মিক নেতা এবং ব্যাপকভাবে জয়নুদ্দিন মখদুম সেকেন্ড বা জাইনুদ্দিন মখদুম আল সাগীর নামে পরিচিত। তিনার পরিবার ইয়েমেন থেকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গাগুলি ভ্রমণ করেন বিশেষ করে উপকূলীয় শহরগুলি যেমন কীলাক্কার, মাদুরাই এবং ক্যালপাট্টানাম ইত্যাদি জায়গা গুলি ইসলাম প্রচারের উদ্দ্যেশে এসেছিলেন। শাইখ আলী বিন আহাম্মেদ মা'বারি এবং তিনার ভাই শাইখ ইব্রাহিম কায়েলপাট্টানাম  থেকে কচ্চির নিকটবর্তী জায়গা কোচাঙ্গাদি তে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনার পিতার ইন্তিকালের পর তিনি তিনার চাচাজান ইব্রাহিমের নেতৃত্বে আসেন এবং কেরলের পন্নানি জেলায় ইস্থাপিত হয়ে যান। 

শিক্ষা : 

শাইখ আহম্মেদ জাইনুদ্দিন প্রাথমিক শিক্ষা কোজিকোডের শাইখ আবু বাক্কার ফখরুদ্দিন কাছ থেকে অর্জন করেন। তার পরে তিনি মক্কায় চলে যান তিনি সেখানে হজ পালন করেন এবং সাত বছর ইসলামি শরীয়তের ব্যাখ্যা ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে ইসলামী জ্ঞান অৰ্জন করেন। মক্কায় পড়া শেষের পূর্বেই তিনি পন্নানি তে না ফিরে এসে মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় চলে যান ওখানে ৫ বছর শিক্ষা অর্জন করে পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন। 

 

তিনি তার পিতামহের উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন এবং ভারতের কেরালার পোন্নানি এলাকায় প্রধান কাজি (বিচারক) হিসেবে নির্বাচিত হন এবং পন্নানীর গ্র্যান্ড মসজিদের প্রধান মুফতি হিসেবে দায়িত্ব নেন, এই পদে তিনি ছত্রিশ বছর ধরে জড়িত ছিলেন,  পাশাপাশি পোন্নানি জুম্মা মসজিদের ঐতিহাসিক পোন্নানি দরসে বা পল্লী দরসের প্রধান মুদারিস (প্রধান শিক্ষক) হিসেবে নিযুক্ত হন। পোন্নানি জেলা এত উন্নত করে তোলেন যে সেই সময় পোন্নানি জেলাটিকে দ্বিতীয় মক্কা বলে জানা যেত। একজন ঐতিহাসিক লিপিবদ্ধ করেছেন যে তার পরামর্শদাতা ইবনে হাজার আল-হাইথামী পন্নানিতে এসেছিলেন এবং সেখানে অল্প সময়ের জন্য অবস্থান করেছিলেন। কথিত আছে যে, ইবনে হাজার আল-হাইথামী কর্তৃক উপস্থাপিত পাথরের তৈরি বিখ্যাত প্রদীপটি এখনো পন্নানী দরসে রাখা আছে যেই প্রদীপ ব্যাবহারিত হয় যখন পোন্নানি দরসে যিনারা পড়া শেষ করে শেষে  তিনাদেরকে সেই প্রদীপের সামনে বসানো  হয়।

 

মাখদুম জুম্মামসজিদের নির্মাণ: 

বিখ্যাত মাখদুম জুম্মা মোসজিদ ১৫১৯-১৫২০ খ্রিস্টাব্দে পন্নানি সরজমিনে স্থাপন করা হয় যা  ১৭৫৩-৫৪ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার করা হয়। এই মসজিদ টি পুরোটাই কাঠ দিয়ে তৈরী যা এক হিন্দু কাঠমিস্ত্রির নেতৃত্বে মসজিদ টির কাজ সম্পূর্ণ করেন এবং পরবর্তীতে সেই হিন্দু কাঠমিস্ত্রীটি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনাকে আসারি থাঙ্গাল নামে জানা যায়। 

 

তিনি মাকদুম পরিবারে মাহে নামক এক নিকটবর্তী জায়গা চোম্বলে ৯৩৮ হিজরা ১৫৪২  খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতামহের তত্ত্বাবধানে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। তিনি তার পিতা মুহাম্মদ গাজ্জালী এবং তার চাচা আব্দুল আজিজ বিন শেখ মখদুম প্রথম এর অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। । তিনি আল হাফিজ শিহাবুদ্দীন বিন আল হাজর আল হাইথেমি, হারামাইনের গ্র্যান্ড মুফতি (মক্কা   ও মদীনার প্রধান আইনশাস্ত্রবিদ) এবং হাদীস ও ফিকহের বিশ্লেষণকারি, ইজ্জুদ্দিন বিন আবদুল আজিজ আল-এর মতো বিখ্যাত পণ্ডিতদের নির্দেশনা পেয়েছিলেন। ইজ্জদ্দীন বিন আব্দুল আজিজ আল জা’য়ামী, শেখ আব্দুল রহমান বিন জিয়াদ এবং সাইয়্যিদ আব্দুল রহমান আল সাফাবীনির্দেশনা পেয়েছিলেন । তিনি কুতুব আল জামান জাইন উল আরিফিন মুহম্মদ বিন শেখ উল আরিফ আবু হাসান আল বাকরি এর কাছ থেকে তাসাউউফ (সুফি আধ্যাত্মিক জ্ঞান) অর্জন করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কাদরিয়া তরীকতের শায়েখ হিসেবে উপস্থিত হন।

 

রাজনৈতিক অঙ্গনে: 

 

তিনি নিজেকে একজন আলেম হিসেবে কাজ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি,এমনকি তিনি  রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ করেছিলেন, সেই সময়কালে প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে উচ্চসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের আকবরের শাসনামলে বসবাস করেছেন এবং বিজাপুরের সুলতান প্রথম সুলতান আলী আদিল শাহ, সেইসাথে কালিকটের সামুথিরিদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি পর্তুগালের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠোর সমর্থক ছিলেন এবং যুবকদের তাদের বিরুদ্ধে রক্ষা করার জন্য সামুথিরিদের বিশেষ সেনাবাহিনীতে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তার মাস্টারপিস তুহফাতুল মুজাহিদীন ফি আখবার-উল-বুরতুগালিন-এ, তিনি মালাবারের মাটিতে পর্তুগিজদের বর্বরতা তাদের মুসলিম বিরোধী অবস্থানের বিশেষ উল্লেখ সহ ও বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেছেন। তিনি মুসলিম যুবকদের মধ্যে পবিত্র যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা এবং পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের অনিবার্যতা সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করতেন। উল্লিখিত পাঠে, তিনি তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন যারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তাদের জন্য সর্বশক্তিমানের অফুরন্ত প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে এবং তাদের মনোবলকে বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের মনকে ইসলামের স্বর্ণযুগের মধুর স্মৃতির দিকে নিয়ে যেতেন। তিনি আইনশাস্ত্র, ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি অন্যান্য লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য কমান্ডের জন্য পরিচিত ছিলেন। 

 

প্রধান কাজ: 

 

তুহফাতুল মুজাহিদিন:-

“তুহফাতুল মুজাহিদিন” এর অৰ্থ হচ্ছে শহীদদের বিজয়ের গৌরব, এবং এটি জাইনুদ্দিন মাখদুম দ্বিতীয়র অতিপ্রয়জোনীয় ও বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। এই পুস্তকটি আরবি ভাষায় ১৫৬০ থেকে ১৫৮৩ খিরিস্টাব্দে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সর্ব প্রথম এই পুস্তকটি আরবি ভাষায় লিসবন দেশে প্রকাশিত করা হয়েছিল। এই পুস্তকটির এক কপি মিসরের আল আজহার বিশ্ব বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে রাখা আছে এবং এটিকে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হয়েছে। 

তিনার সুপরিচিত বই "তুহফাতুল মুজাহিদিন"এই বইটিতে তিনি তিনার বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বের সমন্ধে লিপিবদ্ধ করেছেন যা ইতিহাসে এখনো প্রচালিত এবং বিশেষ করে উত্তর ভারতের রাজ্য কেরলের ঐতিহাসিক দিক কে ব্যাখ্যা করেছেন। যখন ইংরেজর আমলের সময় যে মুসলিমদের উপর অত্তাচার চালিয়েছিল সেই অত্যাচার থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা বিস্তারিত এই বইটিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছ। শুধু তাই নয় পর্তুগিজরা কেরেলের মানুষদের প্রতি খুব অত্যাচার চালিয়েছিল এবং তিনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের কে ভারত থেকে পুনরায় তাদের নিজেস্ব দেশে ফায়ার যেতে হয় এই সম্বন্ধেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে এই বইটিত।       

 

ফাতহুল মুয়ীন:- 

এই বইটি ফিকহ ও ইসলামী আইন শাস্ত্রের উপর লিপিবদ্।  বিশেষ করে শাফি মাজহাবের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন।  এবং এই বইটি মিসরের আল আজহার বিশ্ব বিদ্যালয়ে প্রচলিত। এই বইটি শাফি মাজহাবের বিভিন্ন মসলা মাসাইল তৎপর্য দলিল সহিত ব্যাখ্যা করেছেনা এবং এই বইটি কেরলের বিভিন্ন শাফি মাজহাবের মাদ্রাসা গুলিতে প্রচালিত। এই বইটি ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হয়েছে। সিরি লংকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া,মিসর ইত্যাদি দেশগুলিতে এই কিতাবটি  ফিকহের আদর্শ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।        

 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter