ইসলামী পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ খোদাভীরু শাসক হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ)

ইতিহাসের পাতা ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এমন কিছু মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়, যাদের জীবন শুধুমাত্র  তাদের সময়ের মানুষের জন্য নয়, বরং সমস্ত যুগের মানুষের জন্য শিক্ষার আলো হয়ে থাকে। ঠিক তেমনই  ইসলামিক ইতিহাসেও এমন অনেক মহান ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায়, যাদের জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে আল্লাহর ভয় নিয়ে জীবন যাপন করতে হয়, কেমন করে দায়িত্ব পালন করতে হয়, এবং কেমন করে সর্বদা মানুষের উপকার করতে হয়। তাদের মধ্যে এক অন্যতম ব্যক্তি হলেন হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ)। তিনি শুধু একজন খলিফা ছিলেন না, বরং  তিনি ছিলেন এক মহান আল্লাহভীরু শাসক, যিনি নিজের শাসকতার ক্ষমতাকে দুনিয়ার জন্য ব্যবহার না করে এক মহান দায়িত্ব ও পরীক্ষার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

তিনি ক্ষমতায় আসার পর মানুষের দুর্ভোগ ও দারিদ্রতা  কমাতে চেয়েছেন, সর্বদা নিজের সুখ-শান্তি ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তিনি কখনো নিজের জন্য আলাদা রাজপ্রাসাদ তৈরি করেননি, বরং রাজকীয় বিলাসিতার জীবনযাপন ছেড়ে এক সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটিয়েছেন। তিনি দিনরাত চিন্তা করতেন, কোন গরিব না খেয়ে থাকছে না তো? কোনো বিধবা কষ্টে নেই তো? বিচারের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না তো?, কারণ তিনি জানতেন, একদিন তিনাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, এবং নিজের শাসনের প্রতিটি বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।

হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ) শিখিয়েছেন নেতৃত্ব মানে কারো উপরে শাসন করা নয়, বরং তাদের সেবা করা। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই প্রকৃত শাসকের কাজ। তার জীবনে আমরা দেখি, কীভাবে একজন মানুষ দুনিয়ার সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেগুলো পরিত্যাগ করে সর্বদা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একটি জীবন্ত কুরআনের প্রতিচ্ছবি, যিনি আল্লাহর বিধানকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়

হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ) ইসলামের ইতিহাসে এমন একজন মহান ব্যক্তি, যার জন্ম, শৈশব এবং পারিবারিক পরিবেশই তাকে এক মহৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিল। তিনি হিজরি ৬১ সালে, পবিত্র শহর  মদিনাতুল মুনাওয়ারাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনার পরিবারের সকল সদস্যই ছিল অত্যন্ত সত্যপরায়ণতা ও ধর্মপ্রাণ। তিনার বাবা ছিলেন আব্দুল আজিজ ইবনে মারওয়ান, যিনি তৎকালীন সময়ে মিশরের গভর্নর ছিলেন এবং উমাইয়া বংশের শাসক শ্রেণির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনার মা উম্মে আসিম ছিলেন খলিফা হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রাঃ) এর নাতনি। আর এইভাবে, হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ ছিলেন হযরত উমর ফারূক (রাঃ) এর বংশধর।

তিনার শৈশবকাল কাটে মদীনায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবি, ন্যায়নিষ্ঠা ও চিন্তাশীলতা ছিলেন। তিনি খেলাধুলার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না বরং জ্ঞান অর্জন, কুরআন পড়া এবং আলেমদের সংস্পর্শে  থাকাই ছিল তিনার প্রিয় কাজ। তিনার পরিবার তাকে কখনও দুনিয়ার বিলাসিতা শেখাননি, বরং সর্বদা তারা তিনাকে আল্লাহভীরুতা, তাকওয়া, ন্যায়বিচার ইত্যাদি জিনিস শেখাতেন। 

তিনার শিক্ষাদীক্ষা শুরু হয়েছিল তৎকালীন সময়ের মদিনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওলামা হযরত সালেহ ইবনে কিসান (রহঃ) এর কাছ থেকে। এই আলেম তিনাকে কুরআন শেখাতেন, হাদীস পড়াতেন, এবং ইসলামিক ভাবে জীবনযাপনের  শিক্ষা দিতেন। তার চরিত্র গঠনে সালেহ ইবনে কিসানের এক অরুপ  অবদান ছিল। এছাড়াও, তিনি অন্য অনেক তাবেয়ী ও জ্ঞানী-গুণী আলিমদের সংস্পর্শে থেকেছেন, যিনারা তিনাকে শেখাতেন, কেমন করে একজন শাসক আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে শাসন করতে পারে।

কর্মজীবন

হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ) এর কর্মজীবন ছিল এক শিক্ষণীয় ইতিহাস, যা আজকের দিনে একজন আদর্শ শাসক ও দায়িত্বশীল মানুষ কেমন হওয়া উচিত তা আমাদের বুঝিয়ে দেয়। খিলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার আগেই তিনি ছিলেন ইসলামি শাসনব্যবস্থার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তৎকালীন সময়ে তিনি মদিনার গভর্নর ছিলেন, এবং সেই সময়ে তিনি ইনসাফ, সততা ও আল্লাহভীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন।

গভর্নর হিসেবে তিনি কখনও, যেকোনো কাজের জন্য জনগণের উপর জোর খাটাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন শাসকের আসল কাজ হচ্ছে জনগণের সেবা করা এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। তাই তিনি সর্বপ্রথম বিচারব্যবস্থার সংস্কার করেন। ধনী হোক বা গরিব, আরব হোক বা অনারব, মুসলিম হোক বা অমুসলিম সবার জন্য তিনি সমান বিচার করতেন। তার কাছে কেউ প্রভাবশালী ছিল না, সবাই ছিল আল্লাহর বান্দা, আর তিনি নিজেকে আল্লাহর একজন খেদমতগার মনে করতেন।

তিনি তিনার কর্মজীবনে শিক্ষা ও জনসেবার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেলেন। তিনি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, পানির কূপ খনন করান, পথচারীদের জন্য ফ্রি পানির ব্যবস্থা করেন। এই কাজগুলো তিনি গভর্নর হিসেবে নিজের উদ্যোগে করতেন। এমনকি তিনি তিনার নিজের রাজকীয় ভাতা থেকেও গরিবদের জন্য ব্যয় করতেন। তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না। তিনি একজন বড়ো শাসক হওয়ার সত্তেও তিনার পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা ছিল সাধারণ মানুষের মতো।

একবার তার স্ত্রী রাজপ্রাসাদের একটি দামী অলংকার চাইলেন। তিনি খুব সহজভাবে বললেন, “এই দুনিয়ার অলংকার দিয়ে কি হবে? আসল অলংকার তো জান্নাতে চাই” এবং তারপর থেকে তার স্ত্রীও দুনিয়ার অলংকারের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, তিনি শুধু নিজে ধার্মিক ছিলেন না, বরং পরিবারকেও সেই সঠিক ধর্মের পথে চালিত করতেন।

তার গভর্নর সময়ে কোনো বিদ্রোহ বা বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। বরং মানুষ তার শাসনব্যবস্থায়  খুশি ছিল। কারণ তিনি কখনো কারো উপর অন্যায় করেননি, কখনও মানুষের প্রতি নির্যাতন করেননি। তার শাসনকালে ছোট বড় সবাই জানত, কোনো অভিযোগ থাকলে গভর্নর সাহেব সেই রাতেই বিচার করে সমস্যার সমাধান করবেন।

খিলাফতকাল 

খিলাফতের শীর্ষ পদে বসার পর হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ) ইসলামিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু করেন। একটি ছোটো সময়ের (দুই বছর কয়েক মাস) খিলাফতকালে তিনি এমনসব উন্নত ও কল্যাণময় কাজ করে গেছেন, যা অন্যান্য শাসকরা দীর্ঘ বছর ধরে শাসন করেও তা করতে পারেনি। তার এই শাসনকাল এতটাই উন্নত ও কল্যাণময় ছিল যে, ইসলামি ঐতিহাসিকরা তিনাকে খুলাফায়ে রাশেদিনদের (প্রথম চার ন্যায়পরায়ণ খলিফা) পর শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে গণ্য করেছেন।

খিলাফতের শীর্ষপদে বসার পরই তিনি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার পরিবর্তে সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষের মাঝে যান। তিনি সকল অবৈধ উপার্জন বন্ধ করেন, এমনকি নিজের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের কাছ থেকেও যা অন্যায়ভাবে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো তিনি ফেরত আনেন। রাজকোষে থাকা সমস্ত সম্পদ শুধুমাত্র জনগণের কল্যাণে ও তাদের উন্নয়নে ব্যয় করেন কিন্তু কখনও নিজের জন্য এক টাকাও গ্রহণ করেননি।

তিনি কর ব্যবস্থায় এক বৃহৎ পরিবর্তন আনেন। গরিব ও দারিদ্র্য লোকদের কর মাফ করে দেন কারণ তিনি বুঝতেন, একটি জাতিকে যদি এগিয়ে নিতে যেতে হয় তাহলে সর্বপ্রথম তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে হবে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যকে জনগণের জন্য সহজ ও সরল করে তোলেন, চাষাবাদে উৎসাহ দেন, কৃষকদের জন্য কর কমিয়ে দেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারিভাবে সাহায্য চালু করেন।

তিনার এই ইনসাফ, সুবিচার, সর্বদা ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্যপরায়ণতা দেখে অমুসলিমরাও ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ইতিহাসবিদরা বলেন, “তিনার শাসনকালে এত বেশি পরিমাণ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল যে, রাজস্ব আয় কমে যায়, কারণ তৎকালীন সময়ে নবমুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া নেওয়া হতো না।” তিনি জোর করে ইসলাম প্রচার করতেন না, বরং তিনার ইনসাফ আর মানবিকতায় মানুষকে আকৃষ্ট করে তুলত।

তিনার শাসকতার সময় তিনি প্রত্যেক গভর্নরদের চিঠি লিখে বলতেন, “কোনো অন্যায় সহ্য করা হবে না, আল্লাহর ভয়ে শাসন করো।” তারপর যেসব গভর্নর দুর্নীতি করত ও তার কথাকে অমান্য করত, তিনি তাদের বরখাস্ত করতেন এবং তাদের স্থলে যোগ্য, ধর্মভীরু ও ধর্মপ্রাণ লোকেদের নিযুক্ত করতেন। আর তার শাসনকালে, এভাবেই সারা ইসলামী রাষ্ট্রজুড়ে একটি সুবিচারের বাতাস বইত।

ইসলামী শিক্ষা প্রসারের জন্য হাদীস সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন এবং বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত ইবনে শিহাব আয-জুহরী (রহঃ) কে হাদীস লেখার আদেশ দেন। আর এই হাদীস সংকলন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে দাড়ায়।

তার খিলাফতকালে যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সংঘর্ষ সমস্ত কিছুর  বদলে শুধুমাত্র শান্তি, ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের  মাধ্যমে এক নতুন   ইসলামিক অঞ্চলের সৃষ্টি হয়। যেখানে  মুসলমান ও অমুসলমান সবাই শান্তিতে বসবাস করত। বিদ্রোহ, দাঙ্গা, ঝগড়া, সংঘর্ষ কিছুই ছিল না। তার শাসনকাল ছিল যেন জান্নাতের এক অপূর্ব ছায়া।

উপসংহার

হযরত উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ) এর জীবন কেবল একটি রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, বরং এটি এক আদর্শ জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন, যিনি ইসলামিক শাসনব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। 

আজকের দিনে যেখানে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা ও দায়িত্বহীনতা সর্বত্র যায়গায়  দেখা যায়, সেখানে তার মতো একজন শাসক আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি কখনোই ক্ষমতার অহংকার করেননি। বরং ক্ষমতা পাওয়ার সাথে সাথে বলেছিলেন, “এটা আমার জন্য একটি বড় বোঝা, যার জন্য আমাকে কিয়ামতের ময়দানে জবাব দিতে হবে।” এই চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র একজন প্রকৃত মুমিনের মাথায় আসতে পারে।

 ইতিহাস সাক্ষী আছে, তার মৃত্যুর পরে পুরো উম্মাহ কেদেছিল। এমনকি যারা অমুসলিম ছিল, তারাও  বলেছিল, “আমরা একজন সত্যিকারের ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্তপরায়নতা শাসককে হারালাম।” তিনি মৃত্যুর আগে বলে যান, “আমার কবর যেন সাধারণ মানুষের মতো হয়, কোনো বিলাসিতা যেন না থাকে।” আর এটাই হলো তার নম্রতা ও তাকওয়ার পরিচয়।

উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহঃ) আমাদের শেখান ক্ষমতা দিয়ে নয়, চরিত্র দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়। তিনি ছিলেন জনতার নেতা, জনতার খেদমতগার, একজন সৎ খলিফা, একজন সত্যিকার মুসলমান।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter