ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ
ইসলাম সম্বন্ধে অমুসলিমরা অত্যান্ত বেশি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। তাদের অনেকে মনে করে যে মুসলিমরা অমুসলিমদের সম্মান দেওয়া দূর তাদের মানুষ বলে মনেই করে না। তাদের এই প্রকারের ধারণা একদম সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারন ইসলামে মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি কিরূপ আচরণ করা উচিৎ সেই সম্পর্কে অত্যান্ত সুন্দর পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। এবং কোরান ও হাদিসে এর অগণিত প্রমান, আদেশ ও উপদেশ হিসেবে মজুত রয়েছে। সুতরাং আমাদের এটা জানা উচিৎ যে, একজন মানুষ হিসেবে তার প্রতি সাধারণ বিবেচনায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি কি? তাহলে আমরা জানতে পারব অমুসলিমদের বিষয়গুলোকে ইসলাম কীভাবে গ্রহন করে এবং তাদের সাথে ইসলামের আচরণবিধি কি?
নিশ্চয়ই একজন সাধারণ মানবিক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত এবং সাধারণভাবে এ সাম্মানের বিষয়টি সকল মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। জাতি, ধর্ম ও বর্ণে নির্বিশেষে এতে কোন তারতম্য নেই। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় গ্রন্থে ঘোষণা করেনঃ
“আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিযিক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে মর্যাদা দিয়েছি।“ [সূরা আল –ইসরা, আয়াতঃ ৭০]
আদম সন্তানের এ সম্মানের বিষয়টি ব্যাপক তথা সকল মানুষই এতে অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ নিজেই আপন অনুগ্রহের ছায়া মুসলিম –অমুসলিম সকলের জন্যই বিস্তৃত করেন। কাজেই সকল মানুষকেই তিনি জলে-স্থলে বাহন ও রিযিক দান করেন, সকল মানুষকেই আল্লাহর সৃষ্টি জগতের সব কিছুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
ইসলামের এ দৃষ্টিভঙ্গিটি সকল মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলামী শরিয়াতে সকল ক্ষেত্রেই মানবকুলের প্রতি এ সম্মান রয়েছে। শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ সা. –এর সকল কথা এবং কাজেই এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। এটা আমাদের জন্য এক মহান ও অনন্য পন্থা ও পদ্ধতির সন্ধান দেয়, যে পন্থা ও পদ্ধতিতে রাসুলুল্লাহ সা. স্বীয় বিরুদ্ধাচরণকারী ও অস্বীকারকারীদের সাথে আচরণ করেছেন।
সকলের সাথেই রাসুলুল্লাহ সা. –এর আচরণ ছিল সম্মানসূচক। কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে অপদস্থ করা বা কারো প্রতি যুলুম করা কিংবা স্বীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং তার মর্যাদাহানি করা বৈধ নয়। এ বিষয়টি কুরান কারিমের অনেক আয়াত এবং রাসুলুল্লাহ সা. –এর জীবনচরিত থেকে স্পষ্টত ফুটে উঠে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“আর বৈধ কারণ ছাড়া সে প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ হারাম করেছেন”। [সূরা আল-আন’আম, আয়াতঃ ১৫১]
পবিত্র কুরানের এ আদেশটি ব্যাপক অর্থবোধক। কাজেই মুসলিম এবং অমুসলিম সকল মানব প্রাণই এখানে উদ্দেশ্য। অতএব ইসলামের আদল তথা ইনসাফ ও ন্যায়ের বাস্তবায়নও সাধারণভাবে সকলের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। ধর্ম ও বর্ণ বিবেচনায় এখানে তারতম্য করা যাবে না।
ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ কর্তৃক হারাম হওয়া প্রাণকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। চাই সেটি মু’মিনের প্রাণ হোক বা চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের। তবে যদি কারো দ্বারা এমন কোনো কাজ সংগঠিত হয়, যার দরুন তাকে হত্যা করা ওয়াজিব সেটা ভিন্ন ব্যাপার। অতঃপর তিনি একাধিক হাদিস উল্লেখ করেছেন। যেমন,
আবু বকর রা. রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, নবী সা. বলেন, “যে ব্যাক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধকে অন্যায়ভাবে কোনো কারণ ছাড়া হত্যা করেছে, আল্লাহ তার উপর জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন”।
ইসলামী শরিয়াতে সকল শ্রেণির মানুষের প্রতি সর্বপ্রকার যুলুম নিষিদ্ধ। আর এ নিষিদ্ধকরণ অগণিত আয়াতে কারিমাহ ও হাদিসে নববি দ্বারা প্রমাণিত এবং এ বিধান কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে। আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে বান্দার হিসাব নিকাশের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন- “আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মীযানসমূহ স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না”। [সূরা আল –আম্বিয়া, আয়াত -৪৭]
এখানেও ন্যায়বিচারের এ বিধানটি সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোনো শর্তযুক্ত হয়নি। কাজেই সেদিন কোনো মানবাত্মার প্রতিই যুলুম করা হবে না। চাই সে আল্লাহতে বিশ্বাসী হোক বা কাফির হোক, মুসলিম বা নাসরানী কিংবা আরো ভিন্ন চিন্তাধারী হোক না কেন কারো প্রতিই যুলুম করা হবে না। নিশ্চই যুলুম খুবই জঘন্য কাজ, আল্লাহ তাআলা নিজ ও নিজ বান্দাদের জন্য যুলুম চিরতরে হারাম করে দিয়েছেন। আবু যর গিফারী রা. নবি সা. থেকে হাদীসে কুদসী বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন- “হে আমার বান্দারা আমি আমার নিজের জন্য যুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মধ্যেও তা চিরতরে হারাম করেছি, কাজেই তোমরা পরস্পর একে অন্যের উপর যুলুম করো না”।
এটাই হচ্ছে মানুষের ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। এটা আত্ম-উপলব্ধি, সম্মান এবং মর্যাদাকর দৃষ্টিভঙ্গি এবং এব্যাপারে কতই না হৃদয়গ্রাহী ও মহৎতর পন্থা রাসুলুল্লাহ সা. আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছন যখন তার পাশ দিয়ে একজন ইয়াহুদির শবদেহ অতিক্রম করছিল। ইমাম মুসলিম রহ. ইবনে আবি লাইলার সুত্রে বর্ণনা করেন,
“কায়স ইবনে সা’দ ও সাহল ইবনে হুনাইফ দুজনই কাদেসিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তাদের পাশ দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল। এত তারা দুজনই দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদেরকে বলা হল যে, এ জানাজাটি একজন কাদেসিয়াবাসির। তারা দুজনই বললেন, রাসুলুল্লাহ সা. এর পাশ দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল এই জানাযাটি ইয়াহুদির, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?”
এটাই হচ্ছে শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সা. উপরোক্ত অবস্থান বা আচরণের দ্বারা সকল শ্রেনির মানুষের জন্য মুসলিমদের হৃদযন্ত্রে আত্ম-উপলব্ধি এবং সম্মানের বীজ বপন করেছেন এবং এরূপ সম্মানসূচক আচরণ তিনি সাধারণভাবেই করেছেন, ঐ ইয়াহুদির কোন আলাদা বৈশিষ্টের জন্যে নয়। রাসুলুল্লাহ সা. নিজে করেছেন এবং অন্যদের এরূপ করার আদেশ দিয়েছেন একথা জানার পরও যে ঐ লোকটি একজন ইয়াহুদি ছিল।
এটাই হচ্ছে দীন ইসলামে একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ন। এটাই হচ্ছে ইসলামী শরিয়াতে মানব মূল্যায়নের মূল দৃষ্টিভঙ্গি। রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক এ সম্মানসূচক দাঁড়ানো সামান্যতম সময়ের জন্য ছিল না বরং শবদেহটি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছিল। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ সুত্রে ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন, “রাসুলুল্লাহ সা. এবং তার সাহাবীগণ এক ইয়াহুদির শবদেহের সম্মানে শবদেহটি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিলেন”।
সুতরাং এই সব হাদিসের দ্বারা যে শিক্ষা রাসুলুল্লাহ স. দিয়ে গেছেন তা হল মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও মুসলমানদের একটি অবাঞ্ছনীয় কাজ। যাকে এড়িয়ে যাওয়া সুন্নাতের খিলাফ বা বিরুদ্ধাচরণ যেহেতু নবি সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে অনেকবার এরকম আচরণ প্রদর্শন দেখিয়ে গেছেন তাহলে প্রত্যেক মুসলমানের উপর অনিবার্য যে তার পথকেই অনুসরণ করেই তাদের জীবন যাপন করে চলা তবেই তার পাক্কা ও সফল মুমিন ও উম্মাতে মুহাম্মাদের মর্যাদা পাবে।