কেরালার ইসলামী ঐতিহ্য: মামবুরাম থাঙ্গালের জীবন ও অবদান  (পর্ব ২)

আমরা সকলেই মাম্বুরাম থাঙ্গাল সাহেবকে মনের অন্তর থেকে ভালোবাসি, তাই তিনার সম্বন্ধে পড়ি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দেখলাম যে তিনি ভারতের দক্ষিণ রাজ্য কেরালায় কিভাবে পদার্পণ করেলেন, তাঁর পরিবার ও বিবাহ সম্বন্ধে আমরা প্রথম পর্বে জেনেছি । এবার এই পর্বে দেখে নিই যে তিনার জীবন পরিচালনায় নীতি কেমন ছিল, তিনি কিভাবে জীবনযাপন করতেন ও তিনার কিছু অতুলনীয় অবদান এবং পরলোকে গমন !   

মামবুরামে থাঙ্গাল সাহেব:

মামবুরামে বসতি স্থাপনের পর, থাঙ্গাল সাহেব মামবুরাম থাঙ্গাল' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাকে 'থারামাল থাঙ্গাল' নামেও ডাকা হতো। তিরুরাঙ্গাডির পুরাতন জুম্মা মসজিদটি ছিল এই এলাকার প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ।

বসতি স্থাপনের পরের শুক্রবার, থাঙ্গাল তিরুরাঙ্গাডির জুম্মা মসজিদে জুম্মা আদায় করতে যান। তখন সেখানে খ্যাত আলেম কাজী জামালুদ্দীন মখদুমী (রহ.) জুমা'আর খুৎবা দিচ্ছিলেন। খুৎবার পর, জুমা'আর নামাজ চলাকালীন হঠাৎ থাঙ্গাল সাহবে নামাজ থেকে হাত খুলে দল ত্যাগ করেন এবং মসজিদের অন্যদিকে গিয়ে যোহরের নামাজ শুরু করেন।

নামাজের পর এই নবাগত ব্যক্তির কর্মকাণ্ড এলাকাবাসীর মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অনেকেই তার অস্বাভাবিক আচরণে অবাক হন। পরিস্থিতি বুঝতে, কেউ কেউ তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। তখন তিনি বলেন, "আমি নামাজে প্রবেশ করার সাথে সাথেই কাজী সাহেব একটি গরুর কথা ভাবতে শুরু করেন। এই কারণেই আমি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি।"

লোকেরা তৎক্ষণাৎ কাজীর কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে কাজী সাহেব উত্তর শুনে অবাক হয়ে যান এবং বলেন, "এটা একশত ভাগ সত্যি। একজন ব্যক্তি বলেছিল যে আজ সে আমার বউয়ের কাছে একটি গরু নিয়ে আসবে। নামাজের সময় মনে পড়ে গিয়েছিল" এই ঘটনা পর স্থানীয়দের মধ্যে থাঙ্গাল সাহেবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

নীতি এবং পন্থা

আলাভি থাঙ্গাল সাহেব ধর্মীয় বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তিনি আল্লাহর আইনশাস্ত্রের বিধান সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি পোন্নানি মাখদুমদের মতো আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তরের প্রচেষ্টা করেছিলেন, এরাই কেরালার মুসলমানদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন। যদিও এটি রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হস্তক্ষেপ করেছিল, কিন্তু এর পেছনের প্রেরণা সম্পূর্ণ ধর্মীয়ছিল।

থাঙ্গাল সাহেব সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংশোধনকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ইসলামী বিশ্বাসে ফাটল সৃষ্টি করা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের আন্দোলনকে দমন করেছেন। এজন্য তিনি একটি দল গঠন করেছিলেন।

সেই সময়ের আরেকটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, ইসলামের নতুন আগতদের অধিকার অবস্থান রক্ষা করা। প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে থাঙ্গাল সাহবে এবং তার পুত্র সাইয়্যেদ ফাদল পুকোয়া (রহঃ) এই বিষয়ে ন্যায্য সৎ অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে এলাকার হিন্দু দেশীয় সামন্তবাদের আধিপত্যের অবসান ঘটে এবং মুসলমান হওয়ার মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তারা মুসলমান হওয়াকে গর্বের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা নতুন বিশ্বাসীদের তাদের সামন্ত জমিদারদের সামনে মাথা নত না করার সুযোগ দেয়। বিশ্বাসীরা তাদের অধিকার সুযোগ-সুবিধা স্বীকৃতি লাভ করে।

থাঙ্গাল সাহেব ঔপনিবেশিক দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী চরম পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি কেরালার প্রদেশগুলিতে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা একটি অনন্য ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্য আক্রমণকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামন্তবাদের অত্যাচার তীব্রভাবে নিন্দা করেন এবং শ্বেতাঙ্গ সেনাবাহিনীকে তাড়ানোর জন্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেন।

তিনার প্রিয় বন্ধু উমর কাজীর সঙ্গে ব্রিটিশদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। শেষ পর্যন্ত, তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে 'সাইফুল বাথার' নামে একটি প্রচারপত্র লেখেন।

ধ্যাত্মিক জীবন

থাঙ্গাল সাহেব 'বাআলাভি' সুফি তরিকত অনুসরণ করতেন। এটি কাদিরি সুফি পন্থার একটি শাখা যা সাইয়্যিদ বাআলাভি পরিবার দ্বারা জনপ্রিয়, যারা শেখ জিলানী (রহ.)-এর শিষ্য ছিলেন। তাই থাঙ্গাল একই সময়ে কাদিরি বাআলাভী হন।

মামবুরাম থাঙ্গাল ছিলেন মাওলা আল-দাভিলা পরিবারের সদস্য। এটি বাআলাভী পরিবারের অধীনে আসে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই পরিবার থেকে তিনিই প্রথম কেরালায় পদার্পন করেন। একজন ঔপনিবেশিক বিরোধী নায়ক, সমাজকর্মী, অধিকার রক্ষাকারী, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হওয়ার সত্ত্বেও, থাঙ্গাল সাহেব তাঁর সুশৃঙ্খল আধ্যাত্মিক জীবনের জন্যও উল্লেখযোগ্য।

তিনি কাদিরিয়াহ সূফী তরিকতের একজন শেইখ ছিলেন। তিনার কাছে অনেক মুরিদ সদস্যের দল ছিল। তিনি আপন জামানার কুতুব ছিলেন। এই কারণেই, তিনি 'কুতুবুজ্জামান' নামে পরিচিত হন। এটি আউলিয়াদের অনুক্রমের সর্বোচ্চ অবস্থান। 

আল্লাহ তাঁকে এমন মর্যদাপূর্ণ পদে উন্নীত করেন। কুতুবরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। তাঁকে এমন একটি পদ দ্বারা ভূষিত করা এই দেশের জন্য একটি বড় আশীর্বাদ। মালায়ালিগন তিনার জীবদ্দশায় এবং তার পরেও যথেষ্ট ভাগ্যবান।

পরলোক গমন 

মামবুরাম থাঙ্গাল, যিনি কেরালার মুসলিম পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, প্রায় ১২৫৯ হিজরিতে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হন। দিনে দিনে রোগ বাড়তে থাকে এবং পায়ে ব্যথা শুরু হয়। এটি চেরুর যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গুলির প্রভাবের কারণে হয়েছিল। তবে এনিয়ে বড়াই করেননি। সেই আঘাতই রোগের কারণ ছিল। মালাবারের অনেক নেতৃস্থানীয় চিকিত্সক তাঁর পরীক্ষা করার জন্য মামবুরামে আসেন, কিন্তু তাদের কেউই রোগের কারণ খুঁজে পাননি।

এভাবেই পুথুর শহরের বাসিন্দা চেলাক্কোট আহমেদ কুট্টি বৈদ্যর মামবুরামে পৌঁছান। তিনি অবিলম্বে তাঁর সাথে পরামর্শ করে বলেনঃতাঁর শরীরে একটি তাজা ক্ষত রয়েছে যা সেরে উঠবে না। এটাই ক্লান্তির প্রধান কারণ। আমি এটি শুকানোর জন্য একটি মলম লাগাব, উপশম হবে"

ডাক্তারের রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা দেখে থাঙ্গাল অবাক হয়ে যান, এবং বলেন যে "আপনি সত্যিই একজন মহান চিকিৎসক...!" এবং তাকে আশীর্বাদ করেন। এই সম্মান এবং স্বীকৃতি সেই পরিবারের জন্যও ছিল। ওষুধ ব্যবহার করেও সাময়িক উপশম ছাড়া থাঙ্গাল সাহেব রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। দিনে দিনে তাঁর শরীর ক্লান্ত হয়ে আসছিল। খবরটি শীঘ্রই মালাবারের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বিভিন্ন এলাকার শিষ্য সুশীল নেতারা আসেন। এমনকি এদের মধ্যে অনেক হিন্দু ভক্ত পণ্ডিতও ছিল। ১২৬০ হিজরি (১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) ৭ই মোহাররাম রবিবার রাতে মামবুরাম থাঙ্গাল পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৯৪ বছর। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে মামবুরামে জনতার ঢল নামে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কেরালার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঢলে পড়ছিল। সোমবার, মহররমের অষ্টম দিনে, হাসান জিফরি, থাঙ্গাল সাহেবের জানাজা পড়ান।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter