ওয়াকফ: ইসলামের একটি অনন্য কল্যাণ ব্যবস্থা 

কোন ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে যখনই বিতর্কের সৃষ্টি হয়, তখনই এর একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক দিক সামনে আসে। অর্থাৎ আমাদের সামনে বিষয়টি গভীরভাবে অধ্যয়নের সুযোগ আসে এবং আমরা এর সত্যতা মানুষকে বোঝাতে পারি। যেমন যখন ‘লাভ জিহাদ’ বা ‘মাদক জিহাদ’ নামক অপপ্রচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নিরপেক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জিহাদ ও মাদকের অপব্যবহার বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করতে শুরু করে। 

যদিও ওয়াকফ ইস্যুতে সরকারের একতরফা পদক্ষেপ একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তবুও এটি আমাদের জন্য ওয়াকফের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট জানার একটি উপযুক্ত অবসর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বেশ কয়েক মুসলমান এবং বহু মুসলমান সম্পর্কে এবার পরিচিত হবে 

অভিধান ও পরিভাষায় ওয়াকফ

আরবি শব্দ ‘ওয়াকফ’ (وقف)-এর অভিধানিক অর্থ হলো থামানো, রোধ করা বা আটকে রাখা। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে পরিভাষাগত অর্থে ‘ওয়াকফ’ বলতে বোঝায়: একটি মূল সম্পদ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করে তার উপকারিতা জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া। যদিও বিভিন্ন মাজহাবে ব্যাখ্যাগত কিছু পার্থক্য রয়েছে, হানাফী মতানুসারে ওয়াকফ বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তিকে আল্লাহর নামে স্থায়ীভাবে দান করে যা ধর্মীয়, দাতব্য বা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়, এবং সেই সম্পত্তির মালিকানা দানকারীর পরিবর্তে আল্লাহর হয়। 

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, ওয়াকফের চারটি মূল উপাদান রয়েছে: ১) ওয়াকফ প্রদানকারী ব্যক্তি যাকে ওয়াকিফ বলা হয়, ২) যার উদ্দেশ্যে ওয়াকফ করা হচ্ছে, ৩) ওয়াকফকৃত সম্পদ, ৪) এবং ওয়াকফ সম্পাদনের শব্দ বা ঘোষণাপত্র।  

ওয়াক করার শর্তাবলী ও কিছু জানার বিষয় 

শরীয়তের বিধান অনুসারে, কোনো কিছু ওয়াকফ করার জন্য কিছু মৌলিক শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি। যেমন প্রথমত, যিনি ওয়াকফ করবেন তিনি প্রাপ্তবয়স্ক (বালিগ), বুদ্ধিমান (আকিল) এবং স্বাধীন (আজাদ) হতে হবে। ওয়াকফ করার সময় সম্পদের মালিকানা ও হস্তান্তরের অধিকার থাকতে হবে। 

ওয়াকফের উদ্দেশ্য অবশ্যই বৈধ ও ধর্মসম্মত হতে হবে যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, গরিবদের সাহায্য কিংবা অন্যান্য নেক কাজে ব্যবহারের জন্য। কোনো অজানা বা অনির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে ওয়াকফ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ওয়াকফ সর্বদা স্থায়ী হতে হবে; কোনো শর্তযুক্ত বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওয়াকফ বৈধ নয়। কেউ চাইলে নিজের সন্তানদের জন্য ওয়াকফ করতে পারে এবং তাদের উত্তরসূরিরাও সেই সুবিধা পেতে পারে, যা শরীয়ত অনুযায়ী বৈধ। 

ব্যবস্থাপনা ও সীমাবদ্ধতা

ওয়াকফকৃত সম্পত্তি বিক্রি, উত্তরাধিকার বা দানযোগ্য নয় - না ওয়াকফ প্রদানকারীর জন্য, না অন্য কারোর জন্য। এটি আল্লাহর নামে একটি স্থায়ী বিনিয়োগ, যার উপকারিতার অংশ মানুষের নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে, ওয়াকফ প্রদানকারী কিছু নির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করতে পারেন, সেসব অবশ্যই শরিয়ত সম্মত হতে হবে। একই সঙ্গে, ওয়াকফের উপকার যাতে ওয়াকফের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

ওয়াকফ কখন শুরু হয়

ওয়াকফ ব্যবস্থা কখন শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত দেখা যায়। কেউ কেউ যুক্তি দেন যে মুসলিমরাই প্রথম ওয়াকফ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছিলেন, আবার কেউ কেউ মনে করেন মুসলিমরা পূর্ববর্তী বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক ব্যবস্থা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে রূপ দেন। এমনও বলা হয় যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমারা অটোমান যুগের ওয়াকফ অনুশীলনকে অনুকরণ করে নাগরিক সমাজ সংগঠনের রূপে তার প্রচলন ঘটায়। পরবর্তীতে, যখন খিলাফতের পতনের ফলে মুসলিম সমাজে ওয়াকফ ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়ে, তখন দেখা যায় পরে কিছু মুসলিম সমাজ ইউরোপের ধাঁচে ওয়াকফ পুনর্গঠনের চেষ্টা করে। (সূত্র: www.ar.m.wikipedia.org)

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ফারাওদের যুগে, প্রাচীন গ্রিসে এবং রোমান সাম্রাজ্যের মিশরে জনকল্যাণমূলক ভবন, সম্পত্তি ও সম্পদ উৎসর্গ করার রীতি বিদ্যমান ছিল। এই প্রথাগুলি মূলত উপাসনালয় ও ধর্মীয় কাজের সাথে যুক্ত ছিল। রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম গৃহীত হওয়ার পর, এই দান ও সম্পদের তত্ত্বাবধানের জন্য বিশেষ কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করা হয়।

প্রাচীন আরব সমাজেও এমন রীতির প্রমাণ মেলে। সাধারণত উপাসনালয় সংক্রান্ত মানত ও নৈবেদ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট গোষ্ঠী জড়িত থাকত, যার মাধ্যমে সেই আয় ভক্তদের কল্যাণে ব্যয় করা হত। কাবার আচ্ছাদন পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও এমন গোষ্ঠী বহন করত। কথিত আছে যে হিমিয়ার রাজা আসাদ আবদ কুরাইবই প্রথম ব্যক্তি যিনি কাবাকে পোশাক পরিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তির সূচনা করেন।

পশ্চিমা সমাজেও এ ধরনের সামাজিক গোষ্ঠী বিভিন্ন রূপে দীর্ঘকাল ধরে অস্তিত্বে ছিল, যা ফরাসি ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের পূর্ব পর্যন্ত বজায় ছিল। আধুনিক যুগে বিভিন্ন দেশে ওয়াকফসদৃশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। (সূত্র: https://awqafshj.gov.ae)

তবে ইতিহাসসচেতন কেউই অস্বীকার করবেন না যে মুসলমানরাই সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে সর্বাধিক সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈজ্ঞানিক অন্বেষণ, যোগাযোগ ও সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবা, উপাসনালয় রক্ষণাবেক্ষণ, দরগাসংক্রান্ত সেবামূলক কার্যক্রম এবং বৃহৎ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন।

ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজে ওয়াকফ

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামে ওয়াকফের ধারণা কুরআন, নবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ এবং ইজমা (সম্মিলিত ঐক্যমত্য) দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। যদিও কুরআনে ‘ওয়াকফ’ শব্দটি সরাসরি ব্যবহৃত হয়নি, তবুও দান ও সদকা সংক্রান্ত বহু আয়াত এর পক্ষে উৎসাহ জোগায়। কুরআনের দৃষ্টিতে, মানুষের ধন-সম্পদ আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত যার সদ্ব্যবহার ও বিতরণে সমাজের কল্যাণ নিহিত (সূরাহ আল-হাদীদ: ৭)। ইসলাম ধনী ও সম্পদশালীদের উদ্দেশ্যে এই সম্পদ দানের মাধ্যমে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার আহ্বান জানায়।

আলে ইমরান সূরার ৯২তম আয়াত (“তোমরা যা ভালোবাসো তা আল্লাহর পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনোই প্রকৃত নেককার হতে পারবে না”) নাজিল হওয়ার সময় আবু তালহা আনসারী (রাঃ) একজন বিশিষ্ট ও ধনী সাহাবী ছিলেন। তিনি এই আয়াতে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। তিনি নবী (ﷺ)-কে বলেন, “বাইরুহা আমার প্রিয় খেজুর বাগান। আমি এটি আপনার কাছে দান করছি, যাতে আপনি তা আল্লাহর পথে যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করতে পারেন।” নবী করীম (ﷺ) এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং নির্ধারণ করেন যে এই বাগানের উপকারিতা আবু তালহার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা পাবে। 

এই ঘটনা আনাস ইবন মালিক (রাঃ) বর্ণিত হাদিসসমূহ থেকে উদ্ধৃত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ইসলামে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক নিদর্শনগুলোর অন্যতম।

ওয়াকফের প্রাথমিক দৃষ্টান্ত 

নবী করীম (ﷺ)-এর জীবনে অনেক ঘটনা ও বাণী পাওয়া যায় যা দান, সদকা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে সম্পদ ব্যয়ের প্রতি উৎসাহ দেয়। তবে ইসলামে প্রথম ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয় মদিনায় হিজরতের পর নির্মিত কুবা মসজিদকে, যার পরেই আসে মসজিদে নববীর নাম। পাশাপাশি সাতটি বাগানকেও প্রথম দিককার ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয় যেগুলো নবী ﷺ() নিজে ওয়াকফ করেন যাতে সেগুলোর ফল জনসাধারণের উপকারে আসে।

মদিনার একজন ধনী ও সম্মানিত ইহুদি আলেম মুখাইরিক তাঁর ধর্মীয় জ্ঞানের ভিত্তিতে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-কে আল্লাহর সত্য রাসূল হিসেবে মানেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। উহুদের যুদ্ধের সময় তিনি অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে একটি অসিয়ত করেন যে যদি তিনি যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন, তবে তাঁর মালিকানাধীন সাতটি বাগান নবী (ﷺ)-এর জন্য হিবাহস্বরূপ থাকবে। যুদ্ধ শেষে মুখাইরিক শহীদ হন এবং বাগানসমূহ নবী (ﷺ)-এর তত্ত্বাবধানে আসে। তবে তিনি তা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেননি, বরং অবিলম্বে তা জনকল্যাণে ওয়াকফ ঘোষণা করেন।

পরবর্তী সময়ে অনেক সাহাবী তাদের সম্পত্তি নবী (ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসারে ওয়াকফ করেন। এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ হলো খায়বারে উমর ইবন খাত্তাব (রাঃ)-এর জায়গা।

আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, খায়বার বিজয়ের পর উমর (রাঃ)-এর একটি জমি প্রদান করা হয়। তিনি নবী (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে জানান যে ভূমিটি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে চান। 

নবী (ﷺ) বলেন যে চাইলে তিনি জমির মূলধন (আসল সম্পত্তি) অক্ষত রেখে এর ফল (উপকারিতা) দান করতে পারে। এরপর উমর (রাঃ) জমিটি ওয়াকফ করেন এবং নির্ধারণ করা হয় যে এর আয় দরিদ্র্য, আত্মীয়স্বজন, মুসাফির, দাস মুক্তকারী, ও অতিথিদের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। যারা এটি পরিচালনা করবে, তারা যুক্তিসঙ্গতভাবে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারে, কিন্তু সম্পত্তি বিক্রি, উত্তরাধিকার বা দান করতে পারবেন না।

উক্ত বর্ণনাটি ওয়াকফের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত এবং এটি সমস্ত প্রধান হাদিস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

ওয়াকফের চিরস্থায়ী প্রভাব

অনেক সাহাবী এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে তাঁদের সম্পদ উৎসর্গ করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত একটি প্রসিদ্ধ হাদিস:

“মানুষ মারা গেলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া (নিরন্তর দান), উপকারী জ্ঞান এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” (সহীহ মুসলিম)

যদিও উল্লিখিত হাদিসে তিনটি বিষয়কে মৃত্যুর পরও অব্যাহত নেকি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, অন্যান্য হাদিসে আরও কিছু কর্মের কথা দেখা যায় যেগুলোর সওয়াব মৃত্যুর পরও চলমান থাকে। যেমন ইবনে মাজাহর একটি হাদিসে বলা হয়েছে:  

“যে ব্যক্তি জ্ঞান প্রচার করেছেন, সৎকর্মশীল সন্তান রেখে গেছেন, মুসহাফ (কুরআন) রেখে গেছেন, মসজিদ নির্মাণ করেছেন, মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা স্থাপন করেছেন, সেচব্যবস্থার জন্য নদী খনন করেছেন এবং জীবদ্দশায় ও সুস্থাবস্থায় যে দান করেছেন যা মৃত্যুর পরও কার্যকর থাকে এসবই এমন সওয়াবের কাজ যা মৃত্যুর পরও ব্যক্তিকে উপকার করে।”

ওয়াকফের অফুরন্ত সম্ভাবনা

অন্যান্য হাদিসে ওয়াকফের বিভিন্ন দিক আরও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা হয়েছে। ইমাম সুয়ূতী এসব দিককে সংকলন করে ছন্দবদ্ধভাবে দশটি বিষয়ের তালিকা করেছেন। তবে বাস্তবে, ওয়াকফের কার্যক্রমের ক্ষেত্রগুলো নির্দিষ্ট করে শেষ করা যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ, পশু-পাখি বা প্রাণীর উপকারে আসা যেকোনো কাজই সওয়াবের কাজ এবং ওয়াকফের আওতায় আনা যেতে পারে। 

সেক্ষেত্রে ওয়াকফের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে পারে (যদিও তা সীমিত নয়) —

মসজিদ, কুরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন, গবেষণা ও বিতরণ কেন্দ্র; মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; হজ ও ওমরার সুবিধার্থে স্থাপনাগুলি; দ্বীনি দাওয়াহ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; পাবলিক স্কুল, লাইব্রেরি, ছাপাখানা, প্রকাশনা কেন্দ্র; বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; হাসপাতাল, মুসাফিরখানা; বাগান, অ্যাম্বুলেন্স, গণপরিবহন ব্যবস্থা, সেতু, কূপ, হ্রদ, খাল এবং অন্যান্য জল সরবরাহ প্রকল্প।

এছাড়াও, এতিম, গরিব, বিধবা ও অসহায়দের জন্য আশ্রয়স্থল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র প্রভৃতি সবকিছুই ওয়াকফের আওতাভুক্ত হতে পারে। কোন খাতে দান করা হবে তা নির্ধারণ করবেন সংশ্লিষ্ট ওয়াকিফ। পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের উচিত ওয়াকিফের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী এসব সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

এই তালিকাটি কল্পনাপ্রসূত নয়; বরং বাস্তবেই ইতিহাস খুলে দেখা যায় যে নবী (ﷺ)-এর যুগ থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ পর্যন্ত ওয়াকফের বহু কার্যকর উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। স্থান সংকুলানের কারণে বিস্তারিত বর্ণনা এখানে দেওয়া হলো না।

প্রসার ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

ইসলামের প্রাথমিক যুগে, অন্যান্য বিষয়ের মতো ওয়াকফও সীমিত কিছু খাতে সীমাবদ্ধ ছিল যেমন মসজিদ ও বাগান। কিন্তু উমাইয়া যুগে ইসলামী শাসনের বিস্তার ও জনসেবামূলক কার্যক্রমের পরিধি বাড়ার ফলে প্রশাসনে ওয়াকফ ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা পদ সৃষ্টি করা হয় এবং বিচার বিভাগীয় সুরক্ষাও নিশ্চিত করা হয়।

আব্বাসীয় যুগে ওয়াকফের ব্যপক প্রসার ঘটে। ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ে হাসপাতাল, লাইব্রেরি, অনুবাদ কেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিচালিত হতো। ‘সাদারুল ওয়াকফ’ নামে একজন তত্ত্বাবধায়ক ওয়াকফ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকতেন। মামলুক আমলে ওয়াকফ আরও বিস্তৃত হয় এবং তখন এটি তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়: ১. মসজিদের তত্ত্বাবধানে এক ‘দীওয়ান’, ২. দুই হারামের কার্যক্রমের জন্য আরেক ‘দীওয়ান’, ৩. এবং আত্মীয়স্বজনের ওয়াকফ ব্যবস্থাপনার জন্য তৃতীয় ‘দীওয়ান’। Sঅটোমান শাসনামলে ওয়াকফের আওতায় মেডিকেল কলেজ, অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধা এবং তৎকালীন উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্রগুলো গড়ে ওঠে ও কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।

ওয়াকফের সুবিধাভোগী

ওয়াকফ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।  

প্রথমটি হলো পারিবারিক ওয়াকফ যা কেবল ভালো আর্থিক সামর্থ্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের বংশধরদের জন্য নির্ধারিত। এতে তার সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এই ধরনের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে কারও নামে হস্তান্তর করা যায় না, তবে সম্পত্তির সুবিধা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবিরামভাবে ভোগ করতে পারে। নির্দিষ্ট আত্মীয়দের উপকারে আসে এমন সম্পত্তি উত্তরাধিকারের বিধি ছাড়াও বংশপরম্পরায় ব্যবহৃত হয়।

দ্বিতীয়টি হলো সাধারণ ওয়াকফ যার আওতায় সামাজিক, ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পড়ে। মুসলিম শাসনামলে এই ধরনের ওয়াকফ বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মুসলিম শাসক ও ব্যবসায়ী নেতারা ওয়াকফ সম্পত্তি দান করে সমাজের কল্যাণ ও জ্ঞানচর্চা প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

ওয়াকফ সম্পত্তির সুরক্ষা

শুধু মুসলিম সরকারই নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনামলেও ওয়াকফ সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। সৈয়দ সুলাইমান নদভী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্দো-আরব রিলেশনস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে বিশেষত ভারত ও অন্যান্য এশীয় দেশে তৎকালীন বহু অমুসলিম সরকার মুসলিম সমাজে বিরোধ নিষ্পত্তি ও ওয়াকফসহ অন্যান্য সম্পত্তি সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিশেষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে এবং বিশেষ পরিষদ গঠন করে।

ভারতের প্রেক্ষাপটে

ব্রিটিশ ভারতে এই ধরনের উদ্যোগ উপেক্ষিত হলেও, বিভিন্ন প্রমাণ থেকে জানা যায় যে সরকার ও বিচার বিভাগ মুসলিম সমাজের ইচ্ছা অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও এই ধারা অব্যাহত থাকে।

২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুধুমাত্র ভারতে প্রায় ৫ লক্ষ নিবন্ধিত ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে যার পরিমাণ প্রায় ৬ লক্ষ একর (অর্থাৎ ২৪০০ বর্গকিলোমিটার)। এর বাজারমূল্য নির্ধারিত হয়েছিল প্রায় ৬০ বিলিয়ন টাকার কাছাকাছি।

তবে, ব্যবহারিক বাস্তবতায় প্রশ্ন দেখা দেয় যে এই সম্পত্তিগুলো ওয়াকিফদের ইচ্ছা অনুযায়ী যথাযথভাবে সংরক্ষিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রণীত আইনের সুযোগে কিংবা সরকারের যোগসাজশ ছাড়া অনেক ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। কেরালার ভূমি সংস্কার আইনের ফলে বহু একর ওয়াকফ জমি হারিয়ে গেছে এবং ব্যক্তিমালিকানায় স্থানান্তরিত হয়েছে।

অবশ্যই এটা ভুলে যাওয়া যাবে না যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সম্পত্তির হস্তান্তরের পথও প্রশস্ত করা হয়েছে।

বর্তমানে, বিভিন্ন কুশক্তি অবশিষ্ট ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো দক্ষতার সাথে বাজেয়াপ্ত করার গোপন উদ্দেশ্যে নতুন নতুন আইন প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত। অন্যদিকে, অনেকই যারা ওয়াকফের গুরুত্ব কিংবা পবিত্রতা বোঝে না, তারাই আজ এসব সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করছে এবং এর আয় ও সম্পদ এমনভাবে ব্যয় করছে যা ওয়াকফ দানকারীদের উদ্দেশ্য ও স্বার্থের পরিপন্থী…। 

ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো ভালো করেই জানে - ওয়াকফ সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক অগ্রগতির চালিকা শক্তি। তারা হিসাব করে বুঝে নিয়েছে, যদি এই সংযোগ বন্ধ করা যায় মুসলমানের বিশ্বাসের চেতনা নিভৃত হয়ে যাবে এবং ধীরে ধীরে পুরো সম্প্রদায়ই নিঃশেষ হয়ে পড়বে। এই জন্যই তারা বাঁকানো পথ ধরে এই কাজগুলো সুচারুভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

যদি আমরা আমাদের প্রতিপক্ষকে সঠিকভাবে চিনতে ব্যর্থ হই এবং তাদের গোপন এজেন্ডা অনুধাবন না করি, তাহলে কেবল ভবিষ্যতে দুঃখ প্রকাশ করে লাভ হবে না। ধর্ম প্রদত্ত আমাদের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থাগুলি আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলে আমাদের অস্তিত্বেরও নিশ্চয়তা থাকবে না। 

(এই প্রবন্ধটি মূলত ইসলামঅনওয়েব মালায়ালাম-এ প্রকাশিত সিদ্দীক নদবী চেরুরের একটি লেখার ভিত্তিতে রচিত। মূল প্রবন্ধটির লিংক: https://islamonweb.net/ml/Waqf-History-and-Present)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter