আল্লাহ তাআলাকে দেখা কি সম্ভব? আহ্লে সুন্নাহ ও মু’তাযিলার মতামত

পৃথিবীর সমস্ত মুসলমান এই বিষয়ে এক যে আল্লাহ তাআলা আমাদের একমাত্র প্রভু ও সৃষ্টিকর্তা কিন্তু আল্লাহ তাআলাকে কি কেও দেখেছে বা আল্লাহ তাআলাকে দেখা সম্ভব যদি সম্ভব হয় তাহলে তা কিভাবে সম্ভব আর যদি না হয় তাহলে তার পেছনে কারণ কি। এই বিষয়ে আহ্লে সুন্নাহ ও মু’তাযিলাদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। মু’তাযিলা দলের মত ও বিশ্বাস হচ্ছে আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব আর আহ্লে সুন্নাহ –এর ইমামগণের বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলাকে দেখা সম্ভব, এই দুই দলের কাছে তাদের নিজের মতামতের পেছনে কুরান ও হাদিসের প্রমাণ রয়েছে এবং সেই দলিল ও মতামত নিয়ে আল্লাহ তাআলাকে দেখার বিষয়ে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল- 

আল্লাহ তাআলাকে দেখা নিয়ে মস্তিষ্কের বিচার  

মু’তাযিলার বক্তব্য হচ্ছে যুক্তি দিয়ে ভাবতে গেলে আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব কারন তারা বলছে যে একজন মানুষ কে কোন জিনিস দেখতে হলে সে তার চোখের ব্যবহার করে আর চোখ দিয়ে সেই সব জিনিসই দেখা যায় যে জিনিসের আছে নির্দিষ্ট আয়ত্ত্ব, পরিধি, দৈর্ঘ্য ও ওজন প্রভৃতি কিন্তু আমরা জানি ও মানি যে আল্লাহ তাআলা এইসব জিনিস থেকে পাক ও পবিত্র। এবং এইসব জিনিসের আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কোন ধরনের মিল নেই। অর্থাৎ মু’তাযিলার কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে আল্লাহ যুক্তির দিক দিয়ে দেখতে গেলে আল্লাহ তাআলাকে দেখা মানুষের দৃষ্টির ক্ষমতার বাইরে, তাই মানুষের পক্ষে আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব।   

আহ্লে সুন্নাতের উলামাগণ মু’তাযিলাদের আল্লাহ তাআলাকে দেখা নিয়ে এই মতে কঠোর বিরোধিতা করেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মু’তাযিলার আলেমরা যে মানুষের দৃষ্টির নির্দিষ্ট ক্ষমতার কারণে আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব দাবি করেছে তা একেবারেই ভিত্তিহীন কারণ চোখের এই ক্ষমতার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং মহান আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কেও নয়, তথা আল্লাহ তাআলাই মানুষের দৃষ্টির এই সীমিত ক্ষমতা সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি চাইলে সেই ক্ষমতাকে পাল্টাতে বা বাড়াতেও পারেন এতে আমাদের তথা আহ্লে সুন্নাহদের কোন সন্দেহ নেই। আর মু’তাযিলার দাবীকে বাতিল করার আরেক যুক্তিগত কারন হচ্ছে মানুষের যে সীমিত দৃষ্টিশক্তি আছে সেটা শুধু এই পৃথিবীর জন্যই নির্দিষ্ট এবং হয়ত পরকালের সেই দৃষ্টিশক্তির অন্যরূপ হবে। আর তাছাড়া হাদিসে বর্ণিত আছে যে আল্লাহ তাআলার মুমিন বান্দারা পরকালে আল্লাহ তাআলাকে এরূপ পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবে যেমন পূর্ণিমার রাত্রে সকল পৃথিবীবাসী আকাশে চাঁদ পরিষ্কার দেখতে পায়। 

আল্লাহ তাআলাকে দেখা নিয়ে কুরান ও হাদিসের প্রমাণ   

মু’তাযিলার মতে কুরান ও হাদিসে এমন কোন বর্ণনা নেই যা আল্লাহ তাআলাকে দেখার সম্ভাবনা প্রমাণ করে। বরং তাদের মতে কুরান ও হাদিসে এমন বর্ণনা রয়েছে যা আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব প্রমাণ করে। সেই সব দলিলের মধ্যে তারা যেটিকে সবথেকে উত্তম মনে করে তা হল- 

(ربّ أرني أنظر إليك, قال لن تراني ولكن انظر إلى الجبل فإن استقرّ مكانه فسوف تراني, فلمّا تجلّى ربّه للجبل جعله دكّا و خرّ موسى صعقًا) –سورة الأعراف : 142 

আয়াতটির অর্থ- হযরত মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলাকে বলছেন “হে প্রভু আমাকে দেখা দাও আমি তোমাকে দেখবো, (আল্লাহ তাআলা) বললেন, ‘নিশ্চয় তুমি আমাকে দেখতে পাবে না তবে তুমি ওই পাহাড়ের দিকে তাকাও (আমি আমার নুরের কিরণ এক ঝলক ওখানে প্রকাশ করবো) যদি ওই পাহাড়টি তার স্থানে স্থির থাকে তবে তুমি আমাকে দেখতে পার, তারপর যখন তার প্রভু সেই পাহাড়ের ওপর নিজের রশ্মি প্রকাশ করেন (সেই রশ্মি) পাহাড়টিকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয় এবং মুসা (আঃ) সেখানেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে যান। (আল-আ’রাফঃ ১৪২) 

মু’তাযিলার আলেমগন বলেন আল্লাহ তাআলা মুসা (আঃ) –এর আল্লাহকে দেখার প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন যে তুমি আমাকে দেখতে পারবে না, তথা তারা এই আয়াত থেকে এই প্রমাণ করতে চায় যে আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব। তারা আরও এক দিক দিয়ে এটা প্রমাণ করতে চায় যে আল্লাহ তাআলাকে দেখা অসম্ভব, তা হল আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে বলেছেন যে তুমি ওই পাহাড়টির দিকে দেখো সেটি যদি নিজের স্থানে স্থির থাকে তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। আর আল্লাহ তাআলা জানতেন যে পাহাড়টি নিজের স্থানে স্থির থাকবে না অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার এরকম বলার উদ্দ্যেশ্য যে মুসা (আঃ) তাকে দেখতে পাবে না যেহেতু এটা অসম্ভব। 

আহ্লে সুন্নাতের উলামাগণ বলেন যে আল্লাহ তাআলাকে দেখা যাবে এটা নিশ্চিতভাবে কুরান ও হাদিসে প্রমাণিত এবং অনেক আয়াত এমন আছে যা আল্লাহ তাআলাকে দেখার সম্ভবানা প্রমাণ করে যেমন এই আয়াতটি- 

وجوه يومئذ ناضرة إلى ربها ناظرة (القيامة : 22,23) 

 অর্থাৎ- সেইদিন কিছু আলোকিত চেহারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে। 

আল্লাহ তাআলা কুরানে আরও বলেন-

كلّا إنهم عن ربهم يومئذ لمحجوبون (المطففين : 15)

অর্থাৎ- নিশ্চয় তারা সেদিন তাদের রবের থেকে লুকায়িত থাকবে (অর্থাৎ তারা তাদের রবকে সেদিন দেখতে পাবে না)। এই আয়াতের তাফসির আহ্লে সুন্নাহের উলামাগণ এরূপ করেন যে আখেরাতে যারা গুনাহগার এবং কাফের ও মুশ্রিক তারা আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবে না অর্থাৎ তারা তাদের গুনাহ বা পাপ করার কারণে আল্লাহ তাআলার দৃষ্টির নিয়ামত থেকে বঞ্ছিত হবে। এবং যারা সৎ বা সালেহিন মুমিন বান্দা তারা একটি পুরস্কার ও একটি নিয়ামত রূপে আল্লাহ তাআলার দৃষ্টির সুযোগ পাবেন। 

এরকম আরেকটি উত্তম দলিল এই যে হাদিসে নবি পাক (স) বলেছেন যে “তোমরা (আখেরাতে) তোমাদের রবকে এমনভাবে দেখবে যেমন তোমরা পূর্ণিমার রাত্রে পূর্ণিমার চাঁদকে দেখতে পাও”। এই হাদিসটির আলোকে এই বিষয়টি স্বচ্ছভাবে প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ তাআলাকে দেখা সম্ভব এবং নিশ্চয় আল্লাহর সৎ ও নিষ্ঠাবান মুমিন বান্দারা আল্লাহ তাআলাকে খুব ভালোভাবে দেখতে পাবে। কারণ নবী ও রসুলেরা সকল সকল প্রকারের অসৎ আচরণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র তাই তারা কোনদিনও মিথ্যে সংবাদ প্রচার করবেন না। এটা আহ্লে সুন্নাহ তথা আমাদের বিশ্বাস তাই আমরা তাদের সকল সঠিক বর্ণনাকেও নিশ্চিত সত্য বলে মানি তাই আমাদের বিশ্বাস আল্লাহ তাআলাকে দেখা সম্ভব এবং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। 

তথ্যসূত্র: كبرى اليقينيات الكونية للشيخ سعيد رمضان بوتي 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter