আগে অর্ডার নিয়ে পরে অন্যত্র থেকে পণ্য ক্রয় করে বিক্রি করে উপার্জন করা কি হালাল?

প্রশ্ন

আমরা কয়েকজন মিলে একটা কাজ করি। কাজটা হল-কেউ যদি বালি কিনে পুকুর ভরাট করার জন্য বা অন্য কোন কাজ করার জন্য তাহলে সে আমাদের কাছে এসে বলে। অথবা আমরা তার কাছে গিয়ে বলি: “আপনার বালির ফালানোর কাজটা আমাদের মাধ্যমে করাবেন?”

যদি সে রাজি হয় তাহলে তার কাছ থেকে নির্দিষ্ট একটা রেটে চুক্তি করি। এবং আসল বিক্রেতা আর্থৎ বালির ড্রেজারের মালিকের সাথে তার থেকে কিছু কম রেটে ঠিক করি।

ধরেন ক্রেতার কাছ থেকে প্রতি ফুট বালি ৬ টাকা করে ঠিক করে বিক্রেতার কাছে ৪ টাকা দিয়ে বাকি যে ২ টাকা থাকে সেই টাকাটা লাভ হিসেবে রেখে দেই।

ক্রেতা জানতে পারেনা আমরা বিক্রেতাকে কয় টাকা দিয়েছি আর বিক্রেতাও জানতে পারেনা আমরা ক্রেতার থেকে কয় টাকা নিয়েছি।

অথবা ক্রেতা বিক্রেতা জানাজানিও হয়ে যায়।

আমাদের ক্রেতাকে মাঝে মাঝে মিথ্যা কথা বলতে হয় হাতে রাখার জন্য। ধরেন আমরা বলি ২ দিন পরে আপনার মাল পরবো, কিন্তু আমরা জানি ২ দিনে পারবো না। হাতে রাখার জন্য এই কথা বলতে হয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ওয়াদা দিয়ে রাখতে পারি না।

ধরেন আমরা ক্রেতার কাছ থেকে বানা টাকা নেওয়ার সময় বলি ২ দিন পরে আপনার বালি পরবে কিন্তু দেখা জায় ৮/১০ দিন লেগে যায় তাতে মাঝে মাঝে ক্রেতা অসন্তুষ্টও হয়। এখন প্রশ্ন হল-

(ক) লাভের যে টাকাটা আসে তা কি হালাল হবে?

(খ) যে কাজটাতে এরকম মিথ্যা কথা বলা হহয় ওয়াদা ভংগ করা হয় ক্রেতা অসন্তুষ্ট হয় সে কাজটার লাভ্যংশ কি হারাম হয়ে যাবে?

(গ) ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতে কি কোন সমস্যা আছে?

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

উপরোক্ত পদ্ধতিতে ব্যবসা করে উপার্জন করা জায়েজ আছে। কিন্তু মিথ্যা কথা বলা জায়েজ নেই। তাই যতদিনে পারবেন বলে প্রবল ধারণা হয়, ততোদিনের কথাই বলবেন। পরে যদি দেরী হয়, তাহলে ক্রেতার কাছ থেকে সময় চেয়ে নিবেন।

কিন্তু জেনেশুনে মিথ্যা বলা জায়েজ নেই। বাকি এসব কারণে ব্যবসার উপার্জনের টাকা হারাম হবে না। কিন্তু মিথ্যা বলার গোনাহ হবে।

আর অগ্রিম টাকা নিতেও কোন সমস্যা নেই।

لَّعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ [٣:٦١

তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি যারা মিথ্যাবাদী। {সূর আলেইমরান-৬১}

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-২৩১৪৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৪, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৫৮৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২২২৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪৯০৫}

إنما جاز الاستصناع فيما للناس فيه تعامل، إذا بين وصفا على وجه يحصل التعريف (الفتاوى الهندية-3/207، جديد-3/195)

أما صورة الاصتصناع فهى أن يقول إنسان لصانع من خفاف أو صفار أو غيرهما: إعمل لى خفا، أو آنية من أديم، أو نحاس من عندك بثمن كذا، ويبين نوع ما يعمل، وقدره، وصفته،  فيقول الصانع: نعم (بدائع الصنائع، زكريا-4/93، كرتاشى-5/2)

أما شرائط جوازه: فيمنها: بيان جنس المصنوع، ونوعه،  وقدره، وصفته، لأنه لا يصير معلوما بدونه (بدائع الصنائع، زكريا-4/94)

أما الاستصناع: فللإجماع الثابت بالتعامل من لدن النبى صلى الله عليه وسلم إلى يومنا هذا، وهو من أقوى الحجج (تبيين الحقائق، زكريا-4/526، امدادية ملتان-4/123)

صح الاستصناع بيعا لاعدة على الصحيح (رد المحتار، زكريا-7/475، كرتاشى-5/224)

اختلف المشئخ فيه، فقال بعضهم: هو مواعدة وليس ببيع، وقال بعضهم: هو بيع لكن للمشترى فيه خيار، وهو الصحيح (الموسوعة الفقهية الكويتية-3/326

ইস্তিসনার গুরুত্ব ও তার বিধান

ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পুরাতন চুক্তির ধরন হলো ইস্তিসনা (الاستصناع)। ইস্তিসনা শব্দটি আরবি ভাষার "সানা’আ" (صنع) ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "তৈরি করা" বা "উৎপাদন করা"। শরীয়তের পরিভাষায় ইস্তিসনা এমন এক চুক্তিকে বলা হয়, যেখানে একজন ব্যক্তি (মুস্তাসনিঅ) কোনো কারিগর (সানিঅ)-এর সাথে নির্দিষ্ট ধরণের একটি বস্তু বা সামগ্রী নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে তৈরি করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী উভয়ের মধ্যে দাম, পরিমাণ, গুণাগুণ প্রভৃতি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ স্পষ্টতা থাকে। এই চুক্তি ইসলামী ফিকহের এক গৌরবময় অধ্যায়, যা মানবসমাজের দৈনন্দিন প্রয়োজনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে।

ইস্তিসনার বৈধতার প্রমাণ ও প্রাচীন রেওয়াজ

ইস্তিসনা চুক্তির বৈধতার মূলে রয়েছে সুদীর্ঘকালের ইজমা (إجماع)। বহু ফকীহ একমত হয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে ইস্তিসনার মাধ্যমে লেনদেন চলমান রয়েছে। সুতরাং এটি একটি শক্তিশালী শরঈ দলীলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহগ্রন্থ "তبيين الحقائق" (তাবয়ীনুল হাকায়েক)-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ ধরনের চুক্তির বৈধতা 'তাওতুর' বা সুপ্রতিষ্ঠিত রেওয়াজের দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে।

ইস্তিসনার সংজ্ঞা ও চিত্র

ফকীহগণ ইস্তিসনার সুনির্দিষ্ট চিত্র বর্ণনা করেছেন। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুচির কাছে গিয়ে বলে: "আমার জন্য একটি জুতা তৈরি করে দাও" অথবা কোনো কামারের কাছে বলে: "আমার জন্য নির্দিষ্ট ধরণের একটি তামার পাত্র বানিয়ে দাও", এবং এ বিষয়ে বস্তুটির ধরণ, পরিমাণ, আকার, ও গুণাগুণ ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে, এবং উভয় পক্ষ সম্মত হয়, তবে এ ধরনের চুক্তি ইস্তিসনা হিসেবে গণ্য হবে। "بدائع الصنائع" (বদায়েউস সানায়ে)-এ এই চিত্রকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ইস্তিসনার বৈধতার শর্তসমূহ

ইস্তিসনা বৈধ হওয়ার জন্য কয়েকটি মৌলিক শর্ত অপরিহার্য:

১. বস্তুর প্রকৃতি ও ধরণ নির্ধারণ: পণ্যের জাত, ধরন ও বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে, যাতে পরবর্তীতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে।

২. পরিমাণ নির্ধারণ: বানাতে হবে কতটুকু, তা নির্দিষ্ট করতে হবে।

৩. মূল্য নির্ধারণ: নির্দিষ্ট মূল্য ঠিক করা অপরিহার্য, যাতে বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না ঘটে।

৪. গুণাগুণের বিবরণ: পণ্যের গুণগত মান, রং, আকার, মাপ ইত্যাদি স্পষ্টভাবে বলা আবশ্যক।

৫. সাধারণত প্রচলিত হওয়া: যে ধরণের পণ্যের উপর ইস্তিসনা করা হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষের ব্যবহারে থাকা আবশ্যক।

উপরোক্ত শর্তগুলো ব্যতিরেকে ইস্তিসনা চুক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বিবেচিত হবে না। "الفتاوى الهندية" (আল ফাতাওয়াল হিন্দিয়া) ও "بدائع الصنائع" প্রভৃতি কিতাবে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

ইস্তিসনা: বিক্রয় নাকি প্রতিশ্রুতি?

ফিকহবিদদের মধ্যে ইস্তিসনার প্রকৃতি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিছু উলামা একে বিক্রয় নয় বরং একটি পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি (মুআয়াদা) হিসেবে গণ্য করেছেন। অপরদিকে, অধিকাংশ ফকীহ বলেছেন, ইস্তিসনা মূলত বিক্রয় চুক্তি, তবে এতে ক্রেতার জন্য নির্দিষ্ট শর্তে বিকল্প বা বাতিল করার অধিকার (খিয়ার) থাকবে। এটাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ মত। "رد المحتار" (রাদ্দুল মুহতার) এবং "الموسوعة الفقهية الكويتية" (আল মাওসূআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যা) প্রভৃতি আধুনিক গবেষণামূলক গ্রন্থে এ আলোচনা বিস্তারিতভাবে বিদ্যমান।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে ইস্তিসনার গুরুত্ব

আজকের আধুনিক বানিজ্যিক ও শিল্পজগতেও ইস্তিসনা চুক্তির বিশেষ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প, বিশেষ প্রকৌশল সামগ্রী তৈরি, যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইস্তিসনার শরঈ বিধান প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স ব্যবস্থায় ইস্তিসনা চুক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের অর্থায়ন করা হয়, যা ইসলামী শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক ব্যবসায়িক চাহিদা পূরণ করে।

উপসংহার

ইস্তিসনা ইসলামী অর্থনীতির একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, যা বাস্তব জীবনের ব্যবসায়িক চাহিদার সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ এবং স্বচ্ছ ও সুবিন্যস্তভাবে নির্দিষ্ট শর্তে সম্পাদিত হলে তা দুই পক্ষের জন্য কল্যাণকর হয়। আজকের আধুনিক ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলেও ইস্তিসনার বিধান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়, যা ইসলামী অর্থনীতির প্রজ্ঞা ও গতিশীলতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে।





Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter