ইসলামে পর্বত পরিচিতি: বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে কুরআনের শিক্ষা
মানবজাতির জন্য পর্বতমালা সবসময়ই প্রশংসা এবং বিস্ময়ের বিষয়। বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে এগুলোর কেবল বাহ্যিক গুরুত্বই নয়, গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে। ইসলাম ধর্মে, পবিত্র কুরআনে প্রায় পঞ্চাশবার পর্বতমালার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা তাদের শারীরিক, পরিবেশগত এবং আধ্যাত্মিক ভূমিকার ওপর জোর দেয়। এই উল্লেখগুলোতে পর্বতকে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী, জীবনধারণের উপকরণ এবং ঐশ্বরিক জ্ঞানের নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে—যা একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে মনকে ভাবতে শেখায়। পাহাড় হলো সেই উপাদানগুলির মধ্যে একটি যা আল্লাহ মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন, ঠিক যেমন আকাশ এবং সমুদ্র, যাতে তারা ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে, খুঁজে পেতে পারে এবং হাকীকত অন্বেষণ করতে পারে।
আধুনিক ভূতাত্ত্বিক গবেষণা, বিশেষ করে উনিশ শতক থেকে, পর্বতমালার অনেক ভৌত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছে, যা কুরআনে বর্ণিত বিষয়গুলোকে সমর্থন করে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো কুরআনের শিক্ষা, নবীর বাণী এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিকে একসাথে তুলে ধরা, যেখানে জীবন ধারণে, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে এবং আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন প্রকাশে পর্বতমালার ভূমিকা তুলে ধরা হবে।
কুরআনে পর্বত: পৃথিবীর ঐশ্বরিক নোঙ্গর
কুরআনে পর্বতকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো ‘জিবাল’ (جبال) এবং ‘রাওয়াসী’ (رواسي)। ‘জাবাল’ শব্দটি সাধারণভাবে পর্বতকে বোঝায়, আর ‘রাওয়াসী’ শব্দটি বিশেষভাবে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী বা “নোঙ্গর” হিসেবে এর কাজকে তুলে ধরে। আল্লাহ বলেন:
وَأَلْقَىٰ فِى ٱلْأَرْضِ رَوَٰسِىَ أَن تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَـٰرًۭا وَسُبُلًۭا لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
“এবং তিনি পৃথিবীতে পাহাড় স্থাপন করেছেন যাতে এটি তোমাদের নিয়ে ঢলে না পড়ে, এবং তিনি নদ-নদী ও পথ তৈরি করেছেন যাতে তোমরা সঠিক পথ খুঁজে পাও।” (সূরা আন-নাহল ১৬:১৫)
এই বর্ণনাটি আধুনিক বিজ্ঞানের ‘আইসোস্ট্যাসি’ (Isostasy) ধারণার সাথে মিলে যায়, যেখানে পর্বতমালা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে পৃথিবীর ভূ-ত্বককে স্থিতিশীল রাখতে ভারসাম্যের কাজ করে।
অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন:
أَلَمْ نَجْعَلِ ٱلْأَرْضَ مِهَـٰدًۭا وَٱلْجِبَالَ أَوْتَادًۭا
“আমি কি পৃথিবীকে বিছানা ও পর্বতমালাকে পেরেকস্বরূপ সৃষ্টি করিনি?” (সূরা আন-নাবা ৭৮:৬-৭)
এখানে ‘পেরেক’ শব্দটি গভীরতা এবং স্থিতিশীলতা উভয়ই বোঝায়। আধুনিক ভূতত্ত্ব দেখিয়েছে যে পর্বতমালার শিকড় পৃথিবীর ভূ-ত্বকের গভীরে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে, যা এর দৃশ্যমান উচ্চতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি—এই জ্ঞান কুরআন চৌদ্দশ বছরেরও বেশি আগে দিয়েছে। এর মানে হল, আমরা যেমন কোনও পৃষ্ঠে কাঁটা ছিঁড়ে ফেলি, যেখানে কেবল উপরের অংশটি দৃশ্যমান হয় এবং পুরো কাঁটাটি পৃষ্ঠের নীচে চলে যায়, তেমনি পাহাড়ের ক্ষেত্রেও ঘটে। আমরা দেখতে পাই যে মাউন্ট এভারেস্ট ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার (২৯,০৩১.৭ ফুট) উঁচু কিন্তু এর মূল এই উচ্চতার চেয়ে ১০ গুণ গভীর।
কুরআন পর্বতকে জীবিকা ও জীবনধারণের উপকরণের সাথেও যুক্ত করে:
وَجَعَلْنَا فِيهَا رَوَٰسِىَ شَـٰمِخَـٰتٍۢ وَأَسْقَيْنَـٰكُم مَّآءًۭ فُرَاتًۭا
“এবং আমি সেখানে উঁচু ও দৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তোমাদেরকে সুপেয় পানি পান করিয়েছি।” (সূরা আল-মুরসালাত ৭৭:২৭)
পর্বতমালাকে একইভাবে বৈচিত্র্য এবং ঐশ্বরিক শিল্পের প্রতীক হিসেবেও চিত্রিত করা হয়েছে:
أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءًۭ فَأَخْرَجْنَا بِهِۦ ثَمَرَٰتٍۢ مُّخْتَلِفًا أَلْوَٰنُهَا ۚ وَمِنَ ٱلْجِبَالِ جُدَدٌۢ بِيضٌۭ وَحُمْرٌۭ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَٰنُهَا وَغَرَابِيبُ سُودٌۭ
“তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যার মাধ্যমে আমি বিভিন্ন রঙের ফল উৎপন্ন করি? এবং পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে সাদা, লাল ও কালো বিভিন্ন রঙের স্তর।” (সূরা ফাতির ৩৫:২৭)
এই আয়াতটি আশ্চর্যজনকভাবে প্রকৃতির ভূতাত্ত্বিক ঘটনা, যেমন বহুরঙা পর্বতমালার প্রতিফলন ঘটায়, যেখানে খনিজ জমার কারণে শ্বাসরুদ্ধকর রঙের সৃষ্টি হয়। এই ধরনের চিত্র ঈমানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক কৌতুহলকেও অনুপ্রাণিত করে।
কুরআন ধারাবাহিকভাবে এই প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলোকে ‘আয়াত’ বা স্রষ্টার নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করে—যা মানবজাতিকে তাঁর অস্তিত্ব, প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তা করার দিকে পরিচালিত করে।
পর্বতের গঠন ও কাজ
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পর্বত প্রধানত টেকটোনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়, বিশেষ করে যখন মহাদেশীয় প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই প্রক্রিয়া, যা ‘অরোজেনি’ (Orogeny) নামে পরিচিত, ভাঁজ পর্বতমালার জন্ম দেয়। কুরআন বিভিন্ন জায়গায় ‘আলকা’ (ألقى) শব্দটি ব্যবহার করেছে—যার অর্থ “নিক্ষেপ করা” বা “স্থাপন করা”—পৃথিবীর উপর পর্বত স্থাপনের ঐশ্বরিক কাজ বর্ণনা করতে (১৫:১৯; ৩১:১০)। এই শব্দের ব্যবহার একটি ইচ্ছাকৃত এবং গতিশীল কাজকে নির্দেশ করে, যা থেকে বোঝা যায় যে, পর্বত নিষ্ক্রিয়ভাবে ভাবে তৈরি হয়নি, বরং একটি জটিল ভূ-পদার্থিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছে।
ধর্মগ্রন্থ ও বিজ্ঞানে বর্ণিত পর্বতমালার কাজগুলো বহুমাত্রিক। এগুলো পৃথিবীর ভূ-ত্বককে স্থিতিশীল করে, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এবং হিমবাহ ও নদীর মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, হিমালয় পর্বতমালা দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনধারণকারী প্রধান নদীগুলোকে টিকিয়ে রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পর্বতমালা মানুষ এবং প্রাণী উভয়ের জন্যই বাসস্থান এবং প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল সরবরাহ করে, যেমনটি কুরআন বর্ণনা করে:
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّمَّا خَلَقَ ظِلَـٰلًۭا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلْجِبَالِ أَكْنَـٰنًۭا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَٰبِيلَ تَقِيكُمُ ٱلْحَرَّ وَسَرَٰبِيلَ تَقِيكُم بَأْسَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُۥ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ
“এবং আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তা থেকে তোমাদের জন্য ছায়া তৈরি করেছেন, এবং পাহাড়ের মধ্যে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করেছেন, এবং তোমাদের জন্য পোশাক তৈরি করেছেন যা তোমাদের গরম থেকে রক্ষা করে এবং পোশাক যা তোমাদের যুদ্ধে রক্ষা করে। এভাবেই তিনি তোমাদের উপর তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ করতে পারো।” (সূরা আন-নাহল ১৬:৮১)
নবী মুহাম্মদ (ﷺ)ও পর্বতের প্রতি স্নেহ ও শ্রদ্ধার সাথে কথা বলেছেন। উহুদ পর্বত সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন:
“উহুদ এমন একটি পর্বত যা আমাদের ভালোবাসে, এবং আমরাও তাকে ভালোবাসি।” (সহীহ আল-বুখারী)
এই হাদীসটি পর্বতের সাথে মানুষের সম্পর্কের একটি আধ্যাত্মিক মাত্রা যোগ করে, এগুলোকে কেবল ভূতাত্ত্বিক গঠন হিসেবে নয়, বরং সৃষ্টির একটি অংশ হিসেবে চিত্রিত করে যা মানুষের সাথে একটি অর্থপূর্ণ বন্ধন ভাগ করে নেয়।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং কুরআনের শিক্ষা
আধুনিক ভূতত্ত্ব পর্বতমালার এমন কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করেছে যা কুরআনে আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। পর্বতমালার যে মাটির নিচে গভীর “শিকড়” রয়েছে—যা তাদের দৃশ্যমান অংশের চেয়ে অনেক বড়—এই আবিষ্কারটি কুরআনের “পেরেক” হিসেবে স্থিতিশীল করার বর্ণনার সাথে মিলে যায়। একইভাবে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলফ্রেড ওয়েগনারের প্রবর্তিত কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট তত্ত্ব প্রমাণ করেছে যে পর্বতগুলো স্থির নয়, বরং গতিশীল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটি কুরআনের এই আয়াতের সাথে অনুরণিত হয়:
وَتَرَى ٱلْجِبَالَ تَحْسَبُهَا جَامِدَةًۭ وَهِىَ تَمُرُّ مَرَّ ٱلسَّحَابِ ۚ صُنْعَ ٱللَّهِ ٱلذِىٓ أَتْقَنَ كُلَّ شَىْءٍ ۚ إِنَّهُۥ خَبِيرٌۢ بِمَا تَفْعَلُونَ
“এবং তুমি পর্বতগুলোকে দেখবে, সেগুলোকে স্থির মনে করবে, অথচ সেগুলো মেঘের মতো চলমান। এটা আল্লাহর কাজ, যিনি সবকিছুকে নিখুঁত করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো সে সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবগত।” (সূরা আন-নামল ২৭:৮৮)
এমন এক সময়ে যখন মানুষ পর্বতকে চিরস্থায়ী এবং অটল স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করত, তখন তাদের চলাচল সম্পর্কে কুরআনের এই জ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞান প্লেট টেকটোনিক্সের মাধ্যমে যা নিশ্চিত করেছে তার পূর্বাভাস দিয়েছিল।
তাদের ভূ-পদার্থিক কার্যাবলী ছাড়াও, পর্বতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত নিয়ন্ত্রকও। তারা বরফ এবং হিমবাহ আকারে পানি ধারণ ও সঞ্চয় করে—যা হিমালয়ের মতো অঞ্চলে একটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাকে প্রায়শই “এশিয়ার জলের টাওয়ার” বলা হয়। পর্বতমালা বায়ুমণ্ডলীয় সঞ্চালন, মৌসুমী বায়ুর ধরণ এবং জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে, যা সমগ্র অঞ্চলের জন্য জীবন-সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। এই ধরনের জটিল পরিবেশগত কাজ আল্লাহর প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটায়:
وَسَخَّرَ لَكُم مَّا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًۭا مِّنْهُ ۗ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَـَٔايَـٰتٍۢ لِّقَوْمٍۢ يَتَفَكَّرُونَ
“এবং তিনি তোমাদের জন্য যা কিছু আকাশে এবং পৃথিবীতে আছে তা সবই নিজের পক্ষ থেকে অধীন করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা আল-জাথিয়া ৪৫:১৩)
উপসংহার
কুরআনে বর্ণিত এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে অন্বেষিত পর্বতমালা মহিমা এবং উপযোগিতা উভয়েরই প্রতীক। এগুলো পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী নোঙ্গর, পানি ও খাদ্যের উৎস, জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক এবং ঐশ্বরিক শিল্পের প্রকাশ। পর্বতমালার কুরআনিক বর্ণনা—তা পেরেক, স্থিতিশীলকারী বা সৌন্দর্যের উৎস হিসেবে হোক—কেবল রূপক নয়, বরং গভীর অন্তর্দৃষ্টি যা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে মিলে যায়, প্রায়শই মানুষের জ্ঞানের দ্বারা সেগুলো প্রকাশ করার বহু শতাব্দী আগে।
তাদের শারীরিক গুরুত্বের বাইরে, ইসলামে পর্বতমালার একটি আধ্যাত্মিক অনুরণন রয়েছে। এগুলো বিশ্বাসীদেরকে ঐশ্বরিক শক্তি, স্থিতিশীলতা এবং ধৈর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানবজাতি যখন বৈজ্ঞানিকভাবে পর্বত নিয়ে অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছে, তখন কুরআনের চিত্রায়ন ধর্মগ্রন্থ এবং যুক্তির মধ্যে একটি অসাধারণ সেতু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যা প্রকৃতি এবং ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার মধ্যে সম্প্রীতির ওপর চিন্তা করার জন্য আহ্বান জানায়।