খাঁটি ভালোবাসার খোঁজে: হালাল পথের নির্বাচন

ভালোবাসা— এমন একটি শব্দ যা আজকের তরুণদের হৃদয়কে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি আন্দোলিত করে। এটি আনন্দ এনে দিতে পারে, আবার তাড়াহুড়া, গোপনীয়তা আর মানসিক কষ্টের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। ইসলাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভালোবাসা নিজে কোনো পাপ নয়; এটি মানুষের স্বাভাবিক একটি অনুভূতি, আল্লাহ মানুষের হৃদয়ে যে অনুগ্রহ হিসেবে দিয়েছেন। আসল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনুভূতিটা নয়— এর পর আমরা কী সিদ্ধান্ত নিই, সেটাই মূল কথা।

রাসুলুল্লাহ বলেছেন:

“দুই জন যারা একে অপরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য বিয়ের মতো কিছুই নেই।” (ইবন মাজাহ)

বিয়ের আগে ভালোবাসা— যদি তা হারাম মেলামেশা ছাড়া হৃদয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে— তবে এতে কোনো পাপ নেই। ইবন হাজম তাঁর তাওকুল হামামা গ্রন্থে এটি ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে তিনি স্বপ্নে দেখা, বর্ণনা শুনে ভালো লাগা, কিংবা এক নজরে ভালোবাসার মতো উদাহরণ তুলে ধরেছেন।

তবে তিনি একথাও স্পষ্ট করেছেন যে, প্রকৃত ও স্থায়ী ভালোবাসা আসলে বিকশিত হয় বিবাহ-পরবর্তী জীবনেই— সহচর্য, পরিচিতি, এবং একসাথে সুন্দরভাবে জীবনযাপনের মাধ্যমে। এমন একটি সম্পর্কই সময়ের স্রোত, জীবনের পরীক্ষায় টিকে থাকে এবং আরও দৃঢ় হয়।

বিয়ের মাধ্যমে ইসলাম ভালোবাসাকে মর্যাদা দেয় এবং তাকে রূপান্তরিত করে দয়া, সহচর্য ও ইবাদতে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে চারপাশে ফিতনা ছড়িয়ে আছে, আর লজ্জাশীলতা অনেক সময় উপেক্ষিত হয়। অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে হালাল পথ হারাম পথের চেয়ে কঠিন মনে হয়। তখন প্রশ্ন জাগে— কীভাবে আমরা নিজেদের হৃদয়কে রক্ষা করব, আল্লাহর প্রতি আন্তরিক থাকব, আর তবুও জীবনসঙ্গীর খোঁজ করব?

হালাল পথের পথে বাধাগুলো:

যার মনে সত্যিকারের অনুভূতি আছে, তার জন্য সেগুলো হালালভাবে প্রকাশ করা অনেক সময় কঠিন মনে হয়। সাংস্কৃতিক বাধা, পরিবারের দ্বিধা, এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়— এগুলো তরুণ-তরুণীদেরকে হালাল পথ বেছে নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে। অনেক সমাজে বিয়ে নিয়ে আলোচনা বয়সের বেশ পরে গিয়ে হয়। বাবা–মা অনেক সময় তরুণ বয়সের অনুভূতিকে অপরিপক্বতা বলে মনে করেন, আর যুবক-যুবতীরা মনে করেন— তাদের কাছে এমন কোনো নিরাপদ পরিবেশ নেই যেখানে তারা সম্মানজনকভাবে নিজেদের উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে পারে।

খোলামেলা ও সৎ হওয়ার পথে সহায়তা করার বদলে সমাজ অনেক সময় তাদেরকে গোপনীয়তার দিকে ঠেলে দেয়। আর গোপনীয়তার জায়গাতেই হৃদয়গুলো সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে।

সবকিছু শুরু হয় নির্দোষভাবে— অনলাইনে এক সাধারণ “সালাম”, বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হালকা আলাপ, কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো মিল পাওয়া আগ্রহ। প্রথমে এগুলো নিরীহই মনে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই যোগাযোগগুলো দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়। অভ্যাস থেকে জন্ম নেয় মানসিক নির্ভরতা, আর তখন বিবেচনাবোধ ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করে।

যা শুরু হয়েছিল একটি সাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে, তা পরে এমন এক আসক্তিতে রূপ নিতে পারে যা আমাদের শক্তি, সময়— এমনকি ঈমানকেও ক্ষয় করতে থাকে। শয়তান ঠিক এভাবেই কাজ করে: হঠাৎ বড় পাপে ফেলতে নয়, বরং ধীরে ধীরে, ছোট ছোট ধাপে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে।

আল্লাহ কুরআনে আমাদের সতর্ক করেছেন:

“হে ঈমানদাররা! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে — সে তাকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজে প্ররোচিত করবে।” (সূরা আন-নূর ২৪:২১)

যখন সমাজ তরুণদের জন্য নিরাপদ হালাল পথ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তখন শয়তান হারাম পথে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়।

রাসুলুল্লাহ বলেছেন: “আদমের সন্তান তার নির্ধারিত পরিমাণ জিনার অংশ অবশ্যই পাবে। চোখের জিনা হলো তাকানো, জিহ্বার জিনা হলো বলা, আর আত্মা কামনা ও বাসনা করে। এরপর গোপনাঙ্গ তা নিশ্চিত করে বা অস্বীকার করে।” ( বুখারি, মুসলিম)

একটি মাত্র দৃষ্টি প্রথমে নিরীহ মনে হতে পারে, কিন্তু সেই দৃষ্টিই হৃদয়ে আসক্তির বীজ বপন করে। এরপর কল্পনার মাধ্যমে হৃদয় তা লালন করে, যতক্ষণ না মানুষ হারাম কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।

এ কারণেই চোখকে সংযত রাখা পবিত্রতার প্রথম ঢাল। যখন এই ঢাল উপেক্ষিত হয়, তখন হৃদয় শয়তানের কুমন্ত্রণা গ্রহণের জন্য আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হালাল পথ থেকে সরে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

হারাম সম্পর্কের পরিণতি:

যখন সম্পর্ক ইসলামের নির্ধারিত কাঠামোর বাইরে গড়ে ওঠে, তখন সেগুলো টিকে থাকতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হয় — এমনকি পরে বিয়ে পর্যন্ত গড়ালেও। বাস্তব জীবনের বহু উদাহরণ দেখা যায়, যে সব বিয়ে গোপন সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি হয়, সেগুলোতে বরকত (আল্লাহর অনুগ্রহ) কম থাকে।

এর পেছনে দুটি মূল কারণ রয়েছে:

  1. সেগুলোর ভিত্তি হারামের ওপর দাঁড়ানো থাকে, আর পাপ কখনো স্থায়ী শান্তি এনে দিতে পারে না।
  2. আল্লাহর উপর ভরসা করার বদলে যুগল নিজেরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যার ফলে সম্পর্ক থেকে সুকিয়াম, সততা ও প্রশান্তি হারিয়ে যায়।

গোপনীয়তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক থেকে জন্ম নেয় অবিশ্বাস। সম্পর্কের শুরুতেই যখন বাবা–মার কাছ থেকে আড়াল করা, মিথ্যা বলা, বা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় লুকিয়ে থাকে — তখন হৃদয় গোপনতার মধ্যেই চলতে শেখে।

পরে বিয়ে হলেও সেই একই অবিশ্বাস অনেক সময় থেকে যায়। দুর্বল ভিত্তির ওপর কোনো শক্তিশালী ভবন দাঁড় করানো যায় না — তেমনি গোপন সম্পর্কের ভিত্তিতে স্থায়ী, সুন্দর বৈবাহিক জীবনও দুর্বল হয়ে পড়ে।

এই কারণেই বিয়ের আগে গোপন বা হারাম সম্পর্কের প্রভাব থাকা বহু দাম্পত্য জীবন চাপের মুখে ভেঙে পড়ে। যে ভালোবাসা আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে দাঁড়ায় না, তা সাময়িক আনন্দ দিতে পারে— কিন্তু খুব কমই আজীবন স্থিতি, শান্তি ও স্থায়িত্ব এনে দিতে সক্ষম হয়।

পবিত্র ভালোবাসা সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি:

কুরআন বিয়েকে শুধু একটি চুক্তি হিসেবে নয়, বরং আল্লাহর নিদর্শনগুলোর একটি হিসেবে উপস্থাপন করে। আল্লাহ বলেন:

“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি হলো— তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও; এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা আর-রূম ৩০:২১)

এই আয়াত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়। ইসলামে ভালোবাসা কেবল একটি অনুভূতি নয়— এটি সাকীনা (প্রশান্তি), মাওয়াদ্দা (গভীর স্নেহ) এবং রহমা (দয়া) অর্জনের পথ। যখন ভালোবাসাকে হালাল পথে অনুসরণ করা হয়, তখন তা ক্ষণস্থায়ী আকাঙ্ক্ষা থেকে উন্নীত হয়ে আল্লাহর হিকমতের (দিব্য প্রজ্ঞা) প্রতিফলনে পরিণত হয়।

তখন সহচর্য হয়ে যায় ইবাদত, আর বিবাহ হয়ে ওঠে আল্লাহর রহমতের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। যা সমাজ অনেক সময় “সীমাবদ্ধতা” হিসেবে দেখায়, বাস্তবে তা-ই মুক্তির পথ। কারণ হালাল সম্পর্ক ভয়, গোপনীয়তা বা লজ্জা থেকে মুক্ত— বরং তা গড়ে ওঠে সম্মান, স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসের উপর।

হালাল পথ বেছে নিতে সাহস লাগে, কিন্তু এর বরকত অত্যন্ত গভীর ও মূল্যবান:

  • হৃদয়ের শান্তি — অপরাধবোধ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি।
  • পাপ থেকে সুরক্ষা — শয়তানের ফাঁদ থেকে নিরাপত্তা।
  • বিয়েতে বরকত — আল্লাহর অনুগ্রহে দৃঢ় বন্ধন।
  • সমাজে সম্মান — গোপনীয়তা বা লজ্জার প্রয়োজন নেই।
  • নির্মল বিবেক — আনুগত্যের মাধুর্য অনুভব করা।
  • আল্লাহর সহায়তা — পরীক্ষায় ও কঠিন সময়ে দয়া ও সাহায্য।

ইসলাম বঞ্চনার ধর্ম নয়; এটি সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যের ধর্ম। ভালোবাসা হারাম নয়— গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা কোন পথ দিয়ে সেই ভালোবাসাকে সম্মানিত করি।

ভালোবাসায় আল্লাহর উপর ভরসা: 

তাহলে কারো প্রতি হৃদয় ঝুঁকে গেলে কী করা উচিত? এর উত্তর নিহিত আছে তাওয়াক্কুলে — আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতায়। যদি অনুভূতিগুলো সত্যিকারের হয়, তবে প্রথম পদক্ষেপ কোনো গোপন বার্তা নয়— বরং নামাজ। দুই রাকাআত সালাত পড়ুন, হাত তুলে দোয়া করুন, আর আপনার হৃদয়কে সেই একমাত্র রবের কাছে সোপর্দ করুন—
যিনি কখনো কারো ভরসা নষ্ট করেন না।

আল্লাহ কুরআনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন:

“আর যে আল্লাহকে ভয় করে — আল্লাহ তার জন্য এক বের হওয়ার পথ তৈরি করে দেবেন, এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দেবেন, যেখানে তার ধারণাও থাকবে না।” (সূরা আত-তালাক ৬৫:২–৩)

এই আয়াত শুধু রিজিক বা উপার্জনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়— হৃদয়ের বিষয়েও সমানভাবে প্রযোজ্য। যদি সেই ব্যক্তি সত্যিই আপনার জন্য ভালো হয়, আল্লাহ এমন পথ তৈরি করবেন, যা আপনি কখনও কল্পনাও করেননি। আর যদি তিনি আপনার জন্য কল্যাণকর না হন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করবেন। যখন আমরা বিষয়গুলো আল্লাহর হাতে তুলে দিই, তখন হৃদয় প্রশান্তি পায়। কিন্তু যখন সবকিছু মানুষের পরিকল্পনার উপর ছেড়ে দিই, তখন শান্তি খুব কমই মেলে।

খাঁটি ভালোবাসার কালজয়ী উদাহরণ:

কুরআন আমাদেরকে নবী ইউসুফ (আঃ)-এর অনন্য উদাহরণ দেখায়— এক তরুণ, যিনি কামনার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

এক ক্ষমতাবান শাসকের স্ত্রী— আকর্ষণীয়, প্রভাবশালী এবং একনিষ্ঠভাবে প্রলুব্ধকারী— যখন তাকে পাপে ডেকেছিল, তখন ইউসুফ (আঃ) তাঁর অন্তর থেকে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন:

“হে আমার প্রতিপালক, তারা আমাকে যে দিকে ডাকছে, তার চেয়ে আমার কাছে কারাগারই বেশি প্রিয়।” (সূরা ইউসুফ ১২:৩৩)

তরুণ, একা এবং অসহায় অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও ইউসুফ (আঃ) পাপের চেয়ে কারাগারকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না— কিন্তু ছিল অত্যন্ত পবিত্র।

তিনি কামনার উপর আল্লাহকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, আর আল্লাহ তাঁকে সম্মান, স্বাধীনতা এবং নেতৃত্বের মর্যাদা দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন। তাঁর ঘটনাটি আমাদের শেখায়— প্রলোভন থেকে বিরত থাকা দুর্বলতা নয়; বরং এটি প্রকৃত শক্তি।

ভালোবাসা বা আকর্ষণ নিজে কোনো পাপ নয়; পরীক্ষা হলো— সেই অনুভূতির সঙ্গে আমরা কী আচরণ করি।

ইউসুফ (আঃ) যখন এত ভয়ঙ্কর চাপের মুহূর্তেও দৃঢ় থাকতে পেরেছিলেন, তাহলে আজকের তরুণরাও শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রলোভনের মুখোমুখি হলে আল্লাহর কাছ থেকে শক্তি ও স্থিরতা চাইতে পারে।

ধৈর্য্য: সবচেয়ে কঠিন কিন্তু পবিত্র পথ

হালাল পথ বেছে নেওয়ার পর, সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো ধৈর্য্য। শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়— “এখন আর কেউ এটা করে না” অথবা “তুমি সুযোগ হারাবে”। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ভয়কে আরও বাড়িয়ে দেয়— চমৎকার সম্পর্কের ছবি দেখিয়ে ধৈর্য্যকে পুরনো ও অপ্রাসঙ্গিক মনে করায়।

কিন্তু একজন ঈমানদার জানে, ধৈর্য্য হারানো নয়— এটি আল্লাহর সময়ের উপর পূর্ণ বিশ্বাস।

আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই, কঠিনতার সঙ্গে সহজতা আসে।” (সূরা আশ-শরহ ৯৪:৬)

ধৈর্যের প্রতিটি মুহূর্তে অদৃশ্য পুরস্কার লুকিয়ে থাকে। এটি হৃদয়কে দৃঢ় করে এবং সত্যিই যে ভালোবাসা উত্তম, তার জন্য প্রস্তুত করে। যা মনে হয় দেরি, তা প্রকৃতপক্ষে হলো প্রস্তুতি— আল্লাহ আপনার হৃদয়কে এমন একটি ভালোবাসার জন্য তৈরি করছেন, যা খাঁটি এবং স্থায়ী হবে।

পিতা-মাতা ও সমাজের ভূমিকা:

এই সংগ্রামে তরুণ-তরুণী একা নয়; পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়, আন্তরিক উদ্দেশ্যগুলো চাপা পড়ে যায়— কারণ পিতা-মাতা শুনতে বা বোঝার চেষ্টা করেন না।

একজন যুবক বা যুবতী সম্মানের সঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করলেও, তারা অনেক সময় এই ধরনের কথায় নীরব হয়ে যায়— “এখন নয়” বা “তুমি এখন খুবই ছোট”

ইসলাম গোপনীয়তা বা বিদ্রোহ নয়, খোলামেলা ভাব ও সম্মানকে উৎসাহিত করে। পিতা-মাতাকে শেখা উচিত বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতির সঙ্গে পথনির্দেশ করতে, মনে রেখে যে নবী কখনো তরুণদের সংগ্রামকে অবমূল্যায়ন করেননি। বরং, তিনি তাদের শুদ্ধতার জন্য বাস্তবসম্মত পথ দেখাতেন। যদি পরিবারগুলো প্রারম্ভিক বিয়েকে সমর্থন করে, হালাল প্রস্তাবকে সম্মান দেয়, এবং স্বাস্থ্যকর আলোচনার জন্য জায়গা তৈরি করে, তাহলে অসংখ্য হৃদয়ভঙ্গ (heartbreak) প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সমাজকেও উচিত তরুণদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা লজ্জার ভয় ছাড়া পরামর্শ চাইতে পারে। এখন সময় এসেছে— সমাজকে ভয় না করে, পাপকে ভয় করা শুরু করার।

রাসুলুল্লাহ বলেছেন: “যে দুইজন একে অপরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য বিয়ের মতো কিছুই নেই।”

এই নীতি বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। ‘আব্দুল-রায্জাক আল-সান‘আনী’ বর্ণনা করেন, যখন এক যুবক এমন এক মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেন যিনি তাকে ভালোবাসতো, কিন্তু তার পরিবার তা অস্বীকার করে।
এ বিষয়ে তাউসকে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি নবী -এর উক্তি মনে করলেন— “যে দুইজন একে অপরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য বিয়ের মতো কিছুই নেই।” এরপর তিনি বিয়েটি সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। (আল-মুসন্নফ, ৬/১৭৩)

তদ্রূপ, জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে ঘটনা আছে— একজন ব্যক্তি নবী -কে জানালেন যে তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা এক মেয়েকে দুইজন প্রার্থী প্রস্তাব দিয়েছিল— একজন ধনী এবং অন্যজন গরীব। মেয়েটি গরীবের প্রতি ঝুঁকে থাকলেও, তার অভিভাবকরা ধনীর প্রতি পক্ষপাত দেখালেন।

নবী প্রতিউত্তরে বললেন: “যে দুইজন একে অপরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য বিয়ের মতো কিছুই নেই।” (কানযুল উম্মাল)

এই ধরনের হাদিসগুলো পিতামাতাদের নির্দেশ দেয় যে, ভালোবাসার আন্তরিকতা ও মানসিক মিলকে আর্থিক সুবিধার উপরে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে ভালোবাসা হালাল নিকাহের বন্ধনে সংরক্ষিত থাকে এবং সামাজিক হিসাব-নিকাশে দমন না হয়।

ইবন আল-কাইয়িম ব্যাখ্যা করেছেন যে, আল্লাহ প্রতিটি রোগের জন্য একটি ঔষধ রেখেছেন, আর কামনার ঔষধ হলো যে হালাল পথ তিনি নির্ধারণ করেছেন তা অনুসরণ করা। যদি কেউ আকর্ষণ অনুভব করে, নবী নির্দেশ দিয়েছেন: “যদি তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং হৃদয়ে সেই অনুভূতি জন্মায়, তবে সে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে তার প্রয়োজন মিটাক, কারণ এতে তার হৃদয়ের প্রলুব্ধতা দূর হবে।” (সাহিহ মুসলিম, ৪/১৩০)

এভাবে, যেমন তিনি প্রেমিক জুটিকে বিয়ের দিকে পরিচালিত করেছিলেন, তেমনি তিনি বিবাহিতদেরও প্রলুব্ধতার মোকাবিলার জন্য তাদের স্ত্রী বা স্বামী-এর দিকে মনোযোগ দিতে বলেছেন।

উপসংহার:

খাঁটি ভালোবাসা হারায় না। এটি থাকে — তবে এর জন্য প্রয়োজন সাহস, ধৈর্য্য, এবং আল্লাহর উপর ভরসা। আনুগত্যের পথ অনেক সময় কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এটি এমন এক গন্তব্যে পৌঁছে দেয় যা শান্তিতে পরিপূর্ণ। হারামের পথ সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু তা শেষ হয় পশ্চাতাপে। যখন আমরা আমাদের হৃদয় আল্লাহর কাছে সমর্পণ করি, তিনি আমাদের সেই পথে পরিচালনা করেন যা সবচেয়ে উত্তম, যদিও আমরা তা দেখতে পারি না। প্রকৃত ভালোবাসা হলো যা আমরা চাই তা পিছনে ছুটে চলা নয়; এটি হলো তার উপর ভরসা রাখা, যিনি জানেন আমরা কী সত্যিই প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদের প্রজন্মকে আন্তরিকতা, খাঁটি উদ্দেশ্য এবং হালাল ভালোবাসার পথে পরিচালনা করুন। তিনি আমাদের হৃদয়কে শান্তি দিন, ধৈর্য্য ধরে থাকার শক্তি দিন, এবং হারামের ফাঁদ থেকে সুরক্ষা করুন। আমাদের বিয়েতে সাকীনা, মাওয়াদ্দা এবং রহমা পূর্ণ করুন। এবং আমাদের তাঁর প্রতি ভালোবাসা যেন সব সৃষ্টি থেকে অনুভূত ভালোবাসার চেয়ে সর্বদা বেশি হয়। আমীন

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter