শিক্ষায় গ্রন্থাগারের গুরুত্ব: ইসলামের দৃষ্টিকোণ
গ্রন্থাগার, অর্থাৎ জ্ঞানের ভান্ডার, শিক্ষা ও সমাজের অগ্রগতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘গ্রন্থাগার’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘লিবার’ থেকে, যার অর্থ ‘বই’। ইতিহাস বলে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিসে প্রথম ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের সৃষ্টি হয়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে কনস্টান্টিনোপল এবং আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভারতে ডক্টর এস.আর. রঙ্গনাথনকে (১৮৯২-১৯৭২) গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার ছোঁয়া দেন। ত্রিবান্দ্রম পাবলিক লাইব্রেরি (১৮৯২) ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম গ্রন্থাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, জ্ঞানার্জন একটি পবিত্র দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনের প্রথম প্রকাশিত আয়াত: ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَق (١)
অর্থাৎ: “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন” (সূরা আলাক: ৯৬:১) । মানুষের জন্য জ্ঞান অন্বেষণের গুরুত্বকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। আল্লাহ তাআলা কলমের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন ও সংরক্ষণের গুরুত্বও ব্যাখ্যা করেছেন:
ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِۙ (٤) عَلَّمَ ٱلْإِنسَـٰنَ مَا لَمْ يَعْلَمْ (٥)
অর্থাৎ: “তিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন যা মানুষ জানত না” (সূরা আলাক: ৯৬:৪-৫) ।
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব
ইসলাম শিক্ষাকে ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে ঘোষণা করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন:
"عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: "طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ"
অর্থাৎ: “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৪)।
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার তিনটি মূল স্তম্ভ রয়েছে:
শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এবং বই।
শিক্ষক: ‘গুরু’ শব্দটি এসেছে ‘গু’ (অন্ধকার) এবং ‘রু’ (আলো) থেকে। শিক্ষক সেই ব্যক্তি যিনি অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো জ্বালান। মহানবী (সা.) নিজেকে শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন:
"إِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا"
অর্থাৎ: “আমি শিক্ষকেরূপে প্রেরিত হয়েছি” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৯) । ইসলামের ইতিহাসে সাহাবিরা শিক্ষকের প্রতি অত্যন্ত সম্মান দেখিয়েছেন, কারণ তারা জানতেন, শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
শিক্ষার্থী: শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞান অর্জন শুধু একটি দায়িত্ব নয়, বরং এটি তাদের উন্নতির পথ। মহানবী (সা.) বলেছেন:
"مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ"
অর্থাৎ: “যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করেন” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ২৬৯৯)। শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই নয়, নৈতিকতা, সততা এবং দায়িত্বশীলতার শিক্ষা গ্রহণ করে।
বই: বই হলো জ্ঞানের ধারক এবং বাহক। পবিত্র কুরআনকে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন:
"تفكر ساعة خير من عبادة ليلة"
অর্থাৎ: “জ্ঞান অর্জনের জন্য চিন্তা করা এক রাতের ইবাদত থেকে উত্তম” (তাবরানি, আল-মুজাম আল-কবীর)। বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জীবনের নানা দিক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।
গ্রন্থাগারের ভূমিকা
গ্রন্থাগার শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র। এটি শুধু জ্ঞান সংগ্রহের স্থান নয়, বরং এটি সমাজের জ্ঞানচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার: বিদ্যালয়গুলোতে লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। এখানে তারা নৈতিকতা, সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারে। স্কুলের লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলে, যা তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।
গ্রামীণ গ্রন্থাগার: গ্রামীণ এলাকায় ছোট ছোট গ্রন্থাগার গড়ে তোলা সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা কুরান শরিফে বলেন:
فَاسْأَلُوا۟ أَهْلَ ٱلذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (٤٣)
অর্থাৎ: “তোমরা জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান” (সূরা আন-নাহল: ১৬:৪৩)। গ্রামীণ গ্রন্থাগার এই জ্ঞান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
সরকারি উদ্যোগ: সরকারি উদ্যোগে গ্রন্থাগারের উন্নতি এবং নতুন বই সংগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে একটি ন্যায়পরায়ণ ও শিক্ষিত সমাজ গঠনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَرْفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مِنكُمْ وَٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْعِلْمَ دَرَجَـٰتٍۢ ۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (١١)
অর্থাৎ: “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং জ্ঞান অর্জন করেছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন” (সূরা মুজাদালাহ: ৫৮:১১)।
ইসলামে গ্রন্থাগার ব্যবস্থার গুরুত্ব
ইসলামের স্বর্ণযুগে গ্রন্থাগার ব্যবস্থার উত্থান ছিল বিস্ময়কর। খলিফা হারুন আল-রশীদের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত ‘বাইতুল হিকমা’ বা জ্ঞানকোষ ছিল সেই সময়ের জ্ঞানের কেন্দ্র। এই গ্রন্থাগারে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার বই সংরক্ষণ করা হতো এবং সেগুলো অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করা হতো। মসজিদগুলোতেও লাইব্রেরির মতো ব্যবস্থা ছিল, যেখানে মানুষ কুরআন এবং হাদিস অধ্যয়ন করত। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) যখন খলিফা ছিলেন, তিনি শিক্ষার প্রসারের জন্য বড় বড় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে মানুষ জ্ঞানচর্চার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
গ্রন্থাগারের প্রভাব
গ্রন্থাগার শুধুমাত্র বইয়ের ভান্ডার নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার। একটি জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার শিক্ষার মানের ওপর। ইসলামে জ্ঞানার্জনকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেছেন:
اطلبوا العلم ولو كان في الصين.
অর্থাৎ: “জ্ঞান অন্বেষণের জন্য প্রয়োজন হলে চীন দেশে যেতে হলেও যাও” (বাইহাকি)। তাই গ্রন্থাগারের অভাব একটি জাতির উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করে।
উপসংহার
গ্রন্থাগার শিক্ষার এক অমূল্য সম্পদ। এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের স্থান নয়, বরং এটি নৈতিকতা ও মানসিক বিকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানার্জন ইবাদতের একটি বিশেষ অংশ। মহানবী (সা.) বলেছেন:
إِنَّ حِبْرَ الْعَالِمِ أَفْضَلُ مِنْ دَمِ الشَّهِيدِ
অর্থাৎ: “জ্ঞানী ব্যক্তির কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও ভারী” (তিরমিজি)। সুতরাং, গ্রন্থাগার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
আজকের সমাজে গ্রন্থাগার শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, প্রতিটি গ্রামে এবং শহরে থাকা উচিত। এটি মানুষের মধ্যে জ্ঞানচর্চার আগ্রহ বাড়াবে এবং একটি ন্যায়পরায়ণ ও শিক্ষিত সমাজ গঠনে সহায়তা করবে। ইসলামী শিক্ষার আলোকে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সমৃদ্ধ ও কার্যকর করতে হবে।