দ্বীনের দাওয়াতী কাজে একাধিক ভাষাজ্ঞানের গুরুত্ব
সাম্প্রতিককালের বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রা, অর্থনৈতিক উন্নতি তথ্য অন্তহীন পার্থিব মোহাবিষ্টতা সত্বেও নাস্তিকতার তুলনায় এখনো আস্তিকতা ও ধর্মের প্রতি মানুষের স্বভাবসিদ্ধ অনুরাগ ও আকর্ষণ সত্য সত্যই অত্যাশ্চর্যজনক। পৃথিবীর প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই অনুরূপ ধর্মানুভূতির প্রবলতা পরিলক্ষিত হয়।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ প্রভৃতির পদস্খলনের অন্যতম কারণরূপে সংখ্যাগুরু জনতার দুর্দমনীয় ধর্মানুভূতির ব্যগ্রতাকেও চিহ্নিত করা চলে। ভেঙে পড়া রাশিয়ার ক্ষুদ্রাকার রাষ্ট্রগুলোতে দীর্ঘদিনের পর এখন আবার নতুনভাবে চেপে রাখা ধর্মানুভূতি মানবমনে উত্তাল তরঙ্গমালা সৃষ্টি করেছে। চীনের মতন ধর্ম-দুষমন দেশেও দুর্দমনীয় ধর্মানুভূতির সঙ্গে ইদানীং নাস্তিক্যবাদী সরকারকে অতিশয় সীমিত ক্ষেত্রে হলেও কতকটা শর্তসাপেক্ষ সমঝোতার নীতি অবলম্বন করে চলতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অনুভূতির বিস্তার: ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মের প্রভাব
গোটা এশিয়া মহাদেশে ইসলাম, হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী নর-নারীর স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মানুভূতির প্রবাল্য সত্যিই দেখার মতন। ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় খৃস্টান ধর্মেরই প্রাধান্য থাকলেও সেখানে ইসলামের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা উপেক্ষনীয় নয়। বরং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর হতে খৃস্টান জগতে নতুনভাবে ইসলামের প্রতি মনুষের অনুরাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি শতাব্দীতে তো সেই নিঃশব্দ অনুরাগ ও আকর্ষণ এক প্রকারের উয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। বিকৃতির আশ্রয়স্থল আফ্রিকা মহাদেশও প্রবল ধর্মবোধের অনিবার্য প্রভাবে উদ্বেলিত।
কথা এই যে, - এখনও পৃথিবীতে ধর্মের নামে মানুষের প্রকৃতিগত আবেগ ও অনুভূতি সোৎসাহে ও সানন্দে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। এই স্থায়ী আবেগ ও অনুভূতির কোনো তুলনা নেই পৃথিবীতে। রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রবাদ এবং বিভিন্ন মতবাদ সমস্ত কিছুই আজও করুণভাবে পরাজিত এই বিশ্বজোড়া ধর্মানুভূতির কাছে। কারণটা কি? সত্যই এ একটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন বটে।
এই চিরপুরাতন মজার প্রশ্নের বুঝিবা সর্বসম্মত জবাবটা এই যে, জন্মসূত্রেই মানুষ তার স্বভাবগত বিচারে আল্লাহ-ঈশ্বর- বিশ্বাসী। বিশ্বপ্রকৃতি তাকে তার জ্ঞান-বুদ্ধির ক্রমিক বিকাশের সাথে সাথে স্রষ্টাবিশ্বাসীও করে তোলে। আর ধর্মমাত্রই যে ঈশ্বরকেন্দ্রিক ব্যাপার সেকথা সর্বমান্য। পার্থিব জীবনের অর্থই হচ্ছে - হাসি ও কান্না। সম্ভবতঃ হাসির চেয়ে কান্নাই বেশী। মানুষ যখন দুঃখে পড়ে, তখন সে একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ও অবলম্বন খুঁজে। কারো কাছে সে যেন আত্মরক্ষার ফরীয়াদ জানাতে চায়। এক আল্লাহ ছাড়া প্রার্থনা শোনার ও সাহায্য করার আর কেই বা আছে? একমাত্র বিশ্বপ্রভুই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সাহায্যদাতা। এজন্যই মানুষ দ্বারস্থ হয় ধর্মের, অন্য কথায়- আল্লাহ্-ঈশ্বরের। আল্লাহতে অটল-অবিচল বিশ্বাসের কারণেই মানব মনে প্রবল ধর্মানুভূতি জন্মায়।
ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা এবং মুক্তির পথ
ধর্ম হিসাবে ইসলাম মনুষকে আল্লাহ তাআলার দরবারে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের শিক্ষা দেয়। ইসলামের দাবী যে সে বিশ্বের একমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা এবং এই ইসলামই হলো- মুক্তিলাভের একমাত্র অবলম্বন। ইসলামের এই দ্ব্যর্থহীন দাবিকে বিশ্বমানবমণ্ডলীর নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) তাঁর প্রত্যেক নিষ্ঠাবান অনুসরণকারীকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাঁর উম্মাতের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো কোটি। বিশ্বের সর্বত্রই তাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে যে, বিপুলা পৃথিবীতে ভাষা সাহিত্যের সংখ্যা যখন অগণিত, তখন জনৈক মুবাল্লীগের পক্ষে ইসলাম প্রচারের অভিপ্রায়ে একাধিক ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করা অপরিহার্য নয় কি?
ভাষা শিক্ষার সংকট: ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
আমাদের ভারতবর্ষেরই কথা ধরা যাক। বাংলাভাষী মুবাল্লিগ যদি হিন্দী, উর্দু, পাঞ্জাবী না জানেন, না বোঝেন, তবে তাঁর তাবলীগের দায়রা বাংলার ভালোভাবে হিন্দী ও ইংরেজি শিখে নিলে তাঁর পক্ষে সার্থকভাবে 'ভারতদর্শণ' সম্পূর্ণতা পেতে পারে। দুঃখের বিষয় যে, আমাদের ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে 'ভালো ভাবে' ইংরেজী ও হিন্দী শেখানোর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যেমন নেই ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, অঙ্ক এবং বিজ্ঞান শেখানোর সুনির্ভরযোগ্য ইন্তেজাম। কেন নেই? এগুলো কি ইসলামী জীবনবোধের অবিচ্ছেদ্য উপাদান নয়? অথচ কুরআনুল কারীমে এসবের বিস্তারিত বর্ণনা দেখা যায়। এসব বিষয়াদি সম্পর্কে ইসলামের যে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী আছে, একথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? স্বীকার করা ছাড়া যখন উপায়ান্তর নেই, তখন দ্বীনি মাদ্রাসার সিলেবাসের আধুনিকীকরণ অত্যাবশ্যক। আর এই অত্যাবশ্যকতায় হিন্দী-ইংরেজি ইত্যাদি ভাষার তথা ইতিহাস-ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞানার্জন অনস্বীকার্য।
ধর্মীয় দায়িত্ব পালন: একাধিক ভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের বিস্তার
ইসলামের বাণী দেশ-দুনিয়ার মানুষকে তাঁদেরই ভাষা-সাহিত্যযোগে পৌঁছিয়ে দেওয়া মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও ওলামায়ে দ্বীনের এক অপরিহার্য কর্তব্য। এই অর্থে প্রত্যেক শ্রেণীর নিষ্ঠাবান মুসলিম মাত্রই মুবাল্লিগ। সকলকেই আল্লাহ তাআলার দরবারে কমবেশী জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। ভারতের কোটি কোটি অমুসলিম নর-নারী আজ হিন্দী -ইংরেজি-তেলেগু-তামিল ভাষায় ইসলামের অমিয় বাণী শুনবার ও জানবার জন্য মুসলিম মুবাল্লিগদের কর্তব্য-জ্ঞানের প্রতি তাকিয়ে আছেন নিস্পলকে। সকলেই কি কুরআনের আরবী ভাষা, ইরানের ফারসি ভাষা অথবা আরবী-ফার্সি মিশ্রিত উর্দু ভাষায় ইসলামকে সম্যকভাবে বুঝবার ক্ষমতা রাখেন? যুগযুগান্তের দায়িত্বশীল প্রতিবেশী হিসাবে আমাদের কি দায়িত্ব নয় যে, আমরা ইংরেজি, হিন্দী ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর • আমানতকে জন্মগত ভাবে অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ পড়শীর কাছে পৌঁছিয়ে দিই? দ্বীন ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন যে মানব জাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার পরম আমানত ও নিয়ামত স্বরূপ, - সেকথার সন্ধান কুরআন মাজীদেই পাওয়া যায়।
এ-সবকে গোপন করা, প্রচার না করা ইত্যাদি মনোবৃত্তি যে মহাপাপ, সে-কথাও উচ্চারিত হয়েছে কুরআন-হাদীসে। রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) কে সম্বোধনপূর্বক আল্লাহ তাআলা সূরাহ মায়েদা'র ৬৭ নং আয়াতে বলেন-
يَأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغُ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلُ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَفِرِينَ.
অর্থাৎ “হে রাসূল! আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার ওপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, তা মানুষদের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। তুমি যদি তা না করো, তবে বুঝে নাও যে তুমি তোমার কর্তব্য পালন করলেনা। মানুষের ক্ষতি হতে আল্লাহই তোমাকে রক্ষা করবেন। বিশ্বাস করো, আল্লাহ কাফিরদেরকে সাফল্যের পথ দেখান না।"
প্রিয় নাবীর (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) চির বিদায়ের পরে উম্মাতের শিক্ষিত-বিজ্ঞ মানুষমাত্রই ছোট-বড়ো-মুবাল্লিগ। মুবাল্লিগের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য একাধিক ভাষাজ্ঞানের যোগ্যতা অর্জন করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর দায়িত্ব কর্তব্য নিঃসন্দেহে সর্বাধিক। প্রত্যেকটি দ্বীনি মাদ্রাসায় আরবী ছাড়াও বাংলা, হিন্দী, ইংরেজি, উর্দু তথা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষাকেও অনিবার্য করাই বাঞ্ছনীয়। মুকাররি (বক্তা), মুদাররিস (শিক্ষক), মুবাল্লিগ (ধর্মপ্রচারক) - এই শ্রেণীর মানুষদের একাধিক ভাষাজ্ঞানে বিজ্ঞতা অর্জন করা নিতান্তই জরুরী।