পাশ্চাত্য, ইসলাম ও নারী
ভূমিকা
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীদের ওপর প্রচুর পরিমাণে অত্যাচার করা হতো। জাহিলিয়াত যুগে একজন মহিলার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা উত্তরাধিকারের অংশ বলে কিছু ছিল না। সেই যুগে বহুবিবাহের প্রথা প্রচলন ছিল। একজন পুরুষ অনেক নারীকে বিয়ে করতে পারতো এবং তালাকের ক্ষেত্রেও তাদের কোনোরূপ বাধা ছিল না। একজন মহিলাকে বারবার তালাক দেওয়া হতো এবং বারবার সেইটি প্রত্যাখ্যান করা হতো। এইভাবে মহিলাটি সারা জীবন অত্যাচারিত ও পীড়িত হতো।
আরবে কিছু গোষ্ঠীতে কুসংস্কারের মাত্রা এতদূর চলে গিয়েছিল যে, একটি কন্যা শিশুকে জন্মের সাথে সাথে তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচা কম হয় এবং পিতামাতারা মেয়েদের লালন-পালনের ভার থেকে রেহাই পায়। মেয়েদের লালন-পালন শুধুমাত্র এইজন্য করা হতো যাতে তারা জীবিকা নির্বাহে পুরুষদের সহায়ক প্রমাণিত হয়। মেয়েদের জন্মকে অশুভ বলে মনে করা হতো কারণ তারা প্রাপ্তবয়সী না হওয়া পর্যন্ত তাদের লালন-পালন করতে হতো এবং তারপর তাদের বিয়ের খরচও বহন করতে হতো। কন্যাসন্তানদের জন্মকে কলঙ্ক বলে মনে করা হতো। আরবদের মধ্যে প্রথা ছিল যে গর্ভবতী মহিলার সামনে একটি গর্ত খনন করা হত যাতে কোন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে সেই সময় গর্তে পুঁতে দেওয়া হতো। মা বা পরিবারের সদস্যরা এতে রাজি না হলে মেয়েটিকে কয়েকদিন বড় করা হতো এবং পরে বাবা তাকে লুকিয়ে জঙ্গলে নির্জনে নিয়ে গিয়ে গর্তে পুঁতে দিত অথবা কূপে ফেলে দিত।
এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে জাহিলিয়াতের ঘটনা বর্ণনা করল। আগন্তুক ব্যাক্তিটি বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার একটি কন্যা সন্তান ছিল। সে আমার খুব স্নেহপূর্ণ ছিল। আমি তাকে ডাকলে সে আমার কাছে ছুটে চলে আসত। একদিন আমি তাকে আমার সাথে ডেকে নিয়ে চলে গেলাম। পথে যেতে যেতে, একটি কূপ দেখতে পেলাম। আমি তার হাত ধরে তাকে কূপে ঠেলে ফেলে দিলাম। অবশেষে আমার কানে তার যে আওয়াজটা ভেসে এল সে চিৎকার করছিল হায় আব্বু, হায় আব্বু '।
একথা শোনমাত্রই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেঁদে ফেললেন। তিনার চোখের জল বয়ে গেল। উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে একজন বললেন, তুমি আল্লাহর রাসূলকে দুঃখিত করেছো । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তাকে বাধা দিও না, তাকে তার মনের কথা বলতে দাও এবং তার প্রশ্ন করতে দাও । তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার ঘটনাটি পুনরায় বলতে বললেন। সেই ব্যাক্তি ঘটনাটি পুনরাবৃত্তি করল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এত অঝোর নয়নে কাঁদলেন যে অশ্রুতে আপনার দাড়ি মুবারক ভিজে গেল। এই ঘটনা থেকে আমরা সেই যুগের নারীদের সাথে আচরণের গুরুতরতা ও নিষ্ঠুরতা অনুমান করতে পারি।
যখন নারী নৃশংসতার তলে পিষে যাচ্ছিল। তখন ইসলাম তাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে আবির্ভাব হয়ে আসে। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই নির্যাতিতা নারীদের, লাঞ্ছনা ও অপমানের গ্লানি থেকে বের করে মর্যাদা ও মহানুভবতার উচ্চতার শিখরে পৌঁছে দেন। তাদেরকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার দেন, এবং তাদের উত্তরাধিকারের অধিকার দেন। তিনি মানবজাতিকে নারীদের সাথে উত্তম ব্যাবহারের জন্য পুরুস্কার ও প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দেন । স্ত্রীর কাছে উত্তম ব্যক্তিকে ইসলাম উত্তম মানুষ বলে ঘোষণা করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন,
(خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأهله وأنا من خيركم لأهلي)
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীদের কাছে উত্তম এবং আমি তোমাদের চেয়ে আমার স্ত্রীর কাছে উত্তম”।
তিনি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উল্লেখ করেন। তাদেরকে অস্বাভাবিক কাজ এবং পুরুষদের চাপ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি দেন। তাদেরকে আইনি অধিকারে সমান মর্যাদা দেন। শরীয়ত অনুসারে নারীর অধিকার পুরুষের উপর তেমনটি যেমনটি পুরুষের নারীর উপর। কেবলমাত্র শরীয়তি ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য পুরুষকে সামান্য এক স্তর বেশি মর্যাদা ও সুবিধা দেওয়া হয়েছে। (আল- কুরআন ২:২২৪)
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও নারী
আজ সারা বিশ্বে নারী স্বাধীনতার স্লোগান তোলা হচ্ছে, তাদের অধিকারের জন্য উচ্চস্বরে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে পশ্চিমা সভ্যতা স্বাধীনতার নামে নারীজাতির সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন, তার নারীত্ব ও শালীনতা কেড়ে নিয়েছে। নারী তার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে যন্ত্রের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমারা তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতায় একজন নারীকে ভারী দায়িত্ব পালন করতে হয়। একদিকে, তাদের বিবাহের অধিকারও পালন করতে হয় এবং শিশুদের জন্ম দেওয়া ও লালন-পালনের মতো ভারী দায়িত্ব পালন করতে হয়। অন্যদিকে, পুরুষদের মতো, তাঁরাও কলকারখানা, অফিস এবং স্কুলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করে। এখন পর্যন্ত নারীদের প্রতি যত নিষ্ঠুরতা করা হয়েছে তার মধ্যে এটাই হল সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং জঘন্যতম।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী
ইসলাম এ ধরনের সকল নৃশংসতার বিরোধিতা করে এবং নারীদের অধিকার নির্ধারণ করে তাদের অধিকারের ওপর জোর দেয়। ইসলামও নারীকে পুরুষের মতো সমাজের অংশ তৈরি করে সমাজের কর্মে তাদের অংশগ্রহণ করার অধিকার দিয়েছে কিন্তু তা একটি বিশেষ পরিধির মধ্যে। ইসলাম সমাজে অংশগ্রহণে নারী ও পুরুষ উভয়ের পরিধিকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছে। বাহ্যিক দায়ভার পুরুষের ওপর এবং গৃহস্থালির দায়িত্ব নারীদের ওপর দিয়েছে।
মহান আল্লাহর কর্তৃক নির্বাচিত ধর্ম ইসলাম, জীবনের প্রতিটি স্তরে নারীদের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার উপর জোর দিয়েছে। যখন একজন নারী জন্ম নেয় এবং সে কারো ঘরে কন্যা রূপে জন্ম নেয়, তখন তাকে লালন-পালনের জন্য নবীজি তার পিতামাতাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেন। একটি কন্যা যখন যৌবনে কারো স্ত্রী হয়, তখন আল্লাহর রাসূল তাকে সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে অভিহিত করেন যে তার স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করে। যখনই একজন নারী যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যায়ে পা রাখে এবং মা হয়, তখনই আল্লাহর রাসুল মায়ের পায়ের নীচে জান্নাত নির্দেশ করেন এবং তাকে তার সেবা করার আহ্বান জানান। এবং পিতামাতার অধিকার সম্পর্কে সন্তানদেরকে কুরআন নির্দেশ দেয় যে, ' তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে উফ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বল । তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন'। (আল কুরআন ১৭:২৩-২৪)
তাই শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য, এই তিনটি পর্যায়েই ইসলাম নারীকে সমাজে একটি বিশিষ্ট স্থান দেয়। ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কে দ্বীনী এবং দুনিয়ার কার্যাবলী বাস্তবায়নে অংশগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে।
নবীজীর জীবনে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যে একজন নারীরও সেই একই দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে যা একজন পুরুষের রয়েছে। মক্কা বিজয়ের বছরে নবী করীম (সা.)-এর খেদমতে একটি মহিলা হাজির হয়। এ সময় তিনি (সা.) গোসল করছিলেন এবং তিনার স্নেহের কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) তিনার সামনে পর্দা করেছিলেন। আগন্তুক মহিলটি বলেন, আমি সালাম দিলাম। নবীজি বললেন, কে? আমি বললাম, আমি, উম্মে হানী বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। তিনি বললেন, স্বাগতম উম্মে হানী। তিনি গোসল শেষ করলেন, এবং একটি কাপড় শরীরে দিয়ে তখনই আট রাকাত সালাত আদায় করলেন। তিনি নামায শেষ করলে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ইবনু হুবায়রা নামে এক ব্যক্তিকে আমার কুঠিরে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আমার ভাই বলে যে সে তাকে মেরে ফেলবে। একথা শুনে মহানবী (সা.) বললেন, “হে উম্মে হানি, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছ, আমরা তাকে আশ্রয় দিয়েছি”। (বুখারী)
দ্বীনী এবং দুনিয়ার কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ কাজ হল আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় জিহাদ করা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে সংঘটিত যুদ্ধসমূহে সাহাবায়ে কেরামের সাথে সহাবিয়াত্ কেরামের ইতিহাস কৃতিত্বে ভরপুর।
হজরত রুবায় বিনতে মুয়াওয়িজ নামে একজন বিখ্যাত সাহাবীয়া ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন যে, 'আমরা জিহাদে আল্লাহর রসূল (সা.)-এর সাথে জিহাদে অংশগ্রহন করতাম। আমরা যোদ্ধাদের পানি পান করাতাম, আহতদের চিকিৎসা এবং নিহতদের বহন করে মদীনায় নিয়ে আসতাম'।
একবার হজরত উমর (রা.) তিনার খিলাফতের কালে মদিনার নারীদেরকে কিছু চাদর বিতরণ করেন। বিতরণের শেষ পর্যায়ে একটি খুব সুন্দর চাদর বেচেঁ যাই। সাহাবীরা পরামর্শ দিল যে আপনি এই চাদরটি আপনার স্ত্রীকে দিয়ে দিন। কিন্তু হজরত উমর বললেন, উম্মে সালিত এর বেশি প্রাপ্য কেননা সে উহুদ যুদ্ধের দিন মশকে জল ভরে নিয়ে আসত।
হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন যে, 'আমি উহুদের যুদ্ধে হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত উম্মে সালেম (রা.)- উভয়কে মশকে পিঠের ওপর পানির বোঝা বহন করতে দেখেছি। তারা তৃষ্ণার্ত মানুষের মুখে জলের ফোঁটা দিত এবং সেইটি শেষ হয়ে গেলে আবার পুনরায় ফিরে গিয়ে সেইটি পূর্ণ করে নিয়ে আসত'।
সারমর্ম
এই ঘটনাগুলি থেকে বুঝা যাই যে কিভাবে নারীরাও পুরুষদের সাথে নিজের সামর্থ্য হিসেবে ও শরীয়তের পরিধির মধ্যে সমান ভাবে পুরুষদের সাথে জিহাদে এবং বিভিন্ন বিষয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমি এইটি বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, আজ মুসলিমরা যদি নারীদের দেওয়া অধিকার ও ক্ষমতাকে সম্মান করতে শুরু করে, তাহলে মুসলিম সমাজ একটি আদর্শ সমাজে পরিণত হবে এবং অভিযোগকারীদের এই অভিযোগ নিজ থেকেই শেষ হয়ে যাবে, যে ইসলামে নারীর কোন মর্যাদা নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, আজ পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের প্রতিটি অঙ্গে এমন ভাবে প্রবেশ করে ফেলেছে যে যা ছাড়া আমরা আজ নিষ্ক্রিয়।