মিলাদ উদযাপনে কেরালা মুসলমানদের কিছু বিশেষ ক্রিয়াকলাপ
প্রেমের মাস রবিউল আউয়াল। প্রেম উদযাপন উপায় হয় মনে মনে ভিন্ন ভিন্ন। বেক্তি থেকে সমাজ যুগ থেকে যুগে মাধ্যম বা অছিলার বদল হতে পারে কিন্তু আবেগ ও অনুভব পরিবর্তন হয় না। হৃদয়ে মন ও মান থাকলে সব পন্থায় সম্পূর্ণতা দেখা যায়। মহা স্রষ্টা-প্রিয় বিশ্বনবীর পৃথিবী-বুকে আগমন এই মাসে। অনেকে অনেক উপায়ে এই মাস, বিশেষ দিন, নির্দিষ্ট সময়কে প্রেম উদযাপন ও ভালোবাসার রঙে সাজিয়েছেন। ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে, আরব ও প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে, এক দিগন্তে হেজাজ ও হাজরামাউত নজরে উপস্থিত ঈশ্বর রাজ্য কেরালায় নবীজির জন্মদিবস ও মাস উপলক্ষে বিভিন্ন আমল ও উদযাপন লক্ষ্য করা যায়। সবই প্রেমের প্রমান ও তা বহিঃপ্রকাশের প্রয়াস।
মালা-মাওলিদ আবৃত্তি
কেরালা রাজ্যজুড়ে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত তীরবর্তী মালাবার অঞ্চলের মালাপ্পুরম, কালিকট, কান্নুর ও কাসরগোদ্ জেলায় রবিউল আউয়াল মাস আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ উদযাপন প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। আধ্যাত্মিক পরিশোধনের উদ্দেশ্যে মসজিদে মসজিদে কখনও বাড়ি বাড়িতে আল্লাহর নিমিত্তে জিকির মজলিস ও নবী স্মরণে দরুদ-সালামের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
অলি-আউলিয়াদের প্রেম সংগীত পাঠ রবিউল আউয়াল বলে নয় কেরালা মুসলমানের একটি নিত্য অভ্যাস যেখানে বিশেষ কোনো অবসরে কয়েক লোক মিলে এক আবৃত্তিকারীকে অনুসরণ করে স্বস্বরে গায় গাওয়া হয়। ওই সকল প্রেম সঙ্গীতকে মালা-মাওলীদ বলে।
মাওলীদ মাহফিলে আবৃত্তি করা হয় দুটি জনপ্রিয় মালার মধ্যে প্রথমটি কাসিদা আল-বুরদা যা বুরদা নামে পরিচিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেম ও প্রশংসায় এটি রচিত। সেরা সৃষ্টির প্রশংসায় এই কবিতাগুচ্ছ হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে ইমাম আল-বুসিরি (রহ:) রচনা করেন এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক আবৃত্তিকৃত ও মুখস্থ কবিতাগুলির মধ্যে একটি। কবিতাটির আসল শিরোনাম হল - আল কাওয়াকিব আয-যুররিয়াহ ফি মাদহি খাইর আল-বারিয়াহ।
বুরদা দশটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত। ইমাম আল-বুসিরি (রহ:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর নিজের ভালবাসা প্রকাশ করে শুরু করেন এবং তারপরে অতীতের ত্রুটির জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন। দশটি অধ্যায়ের (ফসল) মধ্যে চতুর্থ অধ্যায়ে বিশ্বনবীর মাওলিদ (জন্ম স্থান ও দিবস) সম্পর্কিত আলোচনা মুক্তা শব্দে বর্ণনা করেন। এই প্রেম কবিতার একটি অত্যান্ত জনপ্রিয় শ্লোক -
فَإِنَّ مِنْ جُودِكَ الدُّنْيَا وَضَرَّتَهَا
وَمِنْ عُلُومِكَ عِلْمَ اللَّوْحِ وَالقَلَمِ
"তোমার নিমিত্তেই এই পৃথিবী এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী (আখিরাহ),/ আর তোমার জ্ঞান লাওহ ও কলমের থেকে।"
দ্বিতীয় প্রেম (মাদহ) কবিতাগুচ্ছের নাম হল মানকুস মাওলিদ। রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম থেকে শেষ তারিখ পর্যন্ত প্রত্যেক রাত্রে এক একটি কবিতা অধ্যায় পাঠ করা হয়। মানকুস মাওলিদ কোন নির্দিষ্ট কবির ও সময়ের লেখা নয় বরং পরম্পরাগত বহু অতীত থেকে চলে আসছে। তবে প্রায় ৫০০ বছর আগে মালাবার অধিবাসী শেখ জয়নুদ্দিন মখদুম প্রথম রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে আরব এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটি একটি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম-এর জীবনী, জন্ম ইতিহাস, মনোরম চরিত্র ইত্যাদি বৈশিষ্টাবলী সংক্ষেপে প্রেমের ভাষায় স্মরণ করা হয়।
ডাফ মুট্টু
মক্কা থেকে পত্যাগমন বা হিজরতের সময় মদিনাবাসীরা তাদের প্রচলিত অভ্যাসে যেরকম নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বাগতম করেছিলেন, ঠিক অনুরূপ এক প্রতীকী প্রচেষ্টা দেখা যায় কেরালা মুসলিম সংস্কৃতিতে। এক গুড়তম অভিব্যক্তির সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চারা দফ বাজিয়ে বিভিন্ন স্বাগতমূলক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। কেরলে এই অভ্যাসকে দফ মুট্টু বলা হয়। আরবি এবং স্থানীয় ভাষা মালিয়ালামেও অনেক কবিতাছন্দ আছে যা প্রেম প্রকাশে এই কলা কীর্তিতে আবৃত্তি করা হয়।
মাওলিদ মাহফিল
বিশেষ করে ১২ই রবিউল আউয়ালের প্রভাত পূর্বে এক মাওলিদ মজলিস অনুষ্ঠিত হয় মসজিদের মধ্যে। এই বৈঠকে সম্পূর্ণ মাংকুস পাঠ করা হয়। ছন্দে ছন্দে নবীজির সুস্বাগতম তরঙ্গ পরিবেশকে মুগ্ধ করে তোল।
মাগরিব নামাজ পর একটি সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এইসব আয়োজন দিয়ে বিভিন্ন কলা কৌশলের মাধ্যমে কচি কচি বাচ্চাদের মধ্যে নবী চেতনা দৃঢ় করে তোলার এই মহা উদ্যোগ দেখা যায়। কবিতা, বক্তব্য, গল্প, কথোপকথন ইত্যাদি কলা সংস্কৃতি প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত থাকে এই অনুষ্ঠানে। হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হয়ে দর্শন করে এবং মন ও হস্ত ভরে সকল প্রদর্শককে পুরস্কৃত করে। সবই প্রেমের প্রমাণ ও বহিঃপ্রকাশের প্রয়াস।
লেখক: মো. সোহেল মন্ডল ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা এবং বর্তমানে কেরালার দারুল হুদা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। তিনি নিয়মিতভাবে ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ইংরেজি এবং বাংলা উভয় ভাষায় লেখালেখি করেন। লেখকের বই - ১৫ ক্যারেক্টারিস্টিক্স অফ দ্য প্রফেট মুহাম্মাদ (স:)।