নমনীয়তা এবং অনমনীয়তা: ভারতীয় সংবিধানের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়, সংবিধানের দায়িত্ব নিয়ে ভারতীয় সরকার সরকারের প্রথম দুই স্তম্ভের মধ্যে আইনি যুদ্ধ দেখা গেছে - কোন সংস্থা সাংবিধানিক ব্যাখ্যার ক্ষমতার মালিক? বিভাগ না আইনসভা? সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয় এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। দেশ যখন সবে মাত্র ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করলো, যে দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ জানুয়ারী ১৯৫০-এ ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল, এই যুদ্ধের শান্তিকরণে একটি সিদ্ধান্তমূলক সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়াস হওয়া চায়। একটি সিদ্ধান্তমূলক সমাপ্তিতে, ইটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে সত্যিই কি সংবিধান কোনো ক্ষমতার আওতাধীন।  একটি সিদ্ধান্তমূলক সমাপ্তিতে, ইটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে সত্যিই কি সংবিধান কোনো ক্ষমতার আওতাধীন। 

 

বিচারপতি জে আর মুধোলকর, যিনি ৩ অক্টোবর ১৯৬০ থেকে ৩ জুলাই ১৯৬৬ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তিনি  একবার বলেন:

 

“এটিও বিবেচনার বিষয় যে সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন করাকে কেবল একটি সংশোধনী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে নাকি এটি বাস্তবে সংবিধানের একটি অংশ পুনর্লিখন হবে...?”

 

আবার বলা যাক, ভারত তার প্রজাতন্ত্র হওয়ার ৭৪তম উত্তিন্ন করে ফেলেছে। ধারাবাহিকভাবে ৭৩ বছর ধরে দেশটি দিবসটিকে সম্মান জানিয়ে আসছে। এটি জনগণের শাসনের দিন। প্রজাতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের গর্বের সাথে মুহূর্তটি উদযাপনের দিন এই ২৬-ই জানুয়ারি। প্রত্যেক নাগরিক উচ্ছ্বসিত চেতনার সঙ্গে বিশ্বে অদ্বিতীয়, হৃদয়-মূল্যের সংবিধানের জন্য শপথ নিয়ে একে অপরের সাথে দ্বায়িত্ববোধ ভাগ করে নেয়। ত্রিরঙ্গা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে বাতাস তার গতি বাড়িয়ে দেয়। হৃদয়ের স্পন্দনের সাথে মিশে যায় জাতীয় সঙ্গীত। এই বছরেও সংবিধানের জন্য আরও সুদৃঢ়তার সাথে এমন একটি আনন্দদায়ক মুহূর্ত অনুভব করতে হবে যেহেতু এখন ‘সংবিধান বাঁচাও’ ধ্বনি গুঁজে উঠেছে।

 

‘সংবিধান বাঁচাও’ আন্দোলনের দীর্ঘস্বর ও আকর্ষণ দুর্বল বা ভোঁতা হবে না। এটা সংবিধান সংরক্ষণের অনুভূতি - জনসাধারণের মৌলিক আইন। মৌলিক সাংবিধানিক কাঠামোর উস্কানির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর। সংবিধান রচিয়তারা এটিকে বর্তমান সময়ের গতিতে জাতি পরিচালনার সহজীকরণে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সংশোধনযোগ্য হিসাবে তৈরি করেছেন (অনুচ্ছেদ ৭৬৮)। উক্ত বিধানের পরিধির অধীনে, এর ‘মৌলিক কাঠামো’ (basic structure) ভাঙ্গন করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের অরাজনৈতিক রায় সংসদে রাজনৈতিক গতির অপ্রতিরোধ্য অনুমোদনের উপর প্রাধান্য পায়। এটি ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যে নাগরিকদের নিশ্চিত মৌলিক অধিকারগুলি কেন্দ্রীয় বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে না। এটা এক ধরনের নমনীয়তা (flexibility) এবং অনমনীয়তা (rigidity)। ভারত যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে এবং তার নিজস্ব সংবিধান প্রণয়ন করে, তখন নাগরিক প্রথম স্থান পায়। তাই বিশেষ শ্রেণীর অভিজাতদের কাছে তাদের ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (general will) অর্পণ করে দেশ আর কোনো স্বৈরাচারের যুগ ডাকবে না। ততদিন পর্যন্ত সাংবিধানিক মূল্যবোধে বিন্যস্ত দেশের অবকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য অমর হয়ে থাকবে।

 

সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর জন্য কোন সংজ্ঞায়িত বিষয়বস্তু নেই। বিভিন্ন বিচারকের দ্বারা পটভূমিকা এবং সময়ের প্রাসঙ্গিকতার সাথে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে মতামত বিনিময় করা হয়েছে। এক কোথায়, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলতে গেলে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয়তা, প্রস্তাবনার বিষয়বস্তু (contents and objectives of the preamble), এবং মৌলিক মূল্যবোধের (fundamental values) হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। একই ধারায় প্রজাতন্ত্র সরকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, ফেডারেল ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বাস্তবায়নও অন্তর্ভুক্ত। যাইহোক, সংবিধান সংসদীয় আধিপত্যের অধীনে নয়; বরং সংসদ নিজেই সংবিধানের ফল হওয়ায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের সীমিত ক্ষমতা ভোগ করে। এর উস্কানিকে অসাংবিধানিক বা অবৈধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত শুধুমাত্র মৌলিক কাঠামোর ব্যাখ্যাকারী হিসাবে বিবেচিত হয়।

 

সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে, আদালত এবং সংসদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চিত্রিত বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এটি মৌলিক অধিকার মামলা (Fundamental Right Case, ১৯৭৩) থেকে শুরু হয় যেখানে মৌলিক সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্যগুলি সংশোধন করার জন্য সংসদের সীমিত ক্ষমতা সীমাহীন হিসাবে নিশ্চিত করা হয়। মৌলিক কাঠামো নিয়ে তখন বিভিন্ন মতবাদের জন্ম হয়।

 

মৌলিক সাংবিধানিক কাঠামোর উপর হস্তক্ষেপ ভারতীয় ঐতিহ্য ও রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট কর। ফলস্বরূপ, দেশে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও ভাষা থাকা সত্ত্বেও গণপরিষদ এবং ডঃ বি.আর আম্বেদকরের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্য একটি কঠোর হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। এই কারণেই জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতাকেও (unity and integrity) ভারতীয় সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কোনওভাবে, বৈষম্যমূলক এবং বিভাজনমূলক শক্তি খেলার একটি মামলার বিরুদ্ধে একক নাগরিকত্ব বৈশিষ্ট্যের সুরক্ষার জন্য দেশ জুড়ে বিক্ষোভ বেশিরভাগই আইন প্রণেতা সহ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়।

 

ভারতের সংবিধান বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘতম লিখিত সংবিধান হিসাবে স্বীকৃত; যেহেতু এটি দেশের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি এবং ভাষার বিস্তৃত বৈচিত্র্য থেকে সমস্ত মানুষের সর্বোচ্চ আইন। এভাবে ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়। এটি একটি বিনা-মূল্যের খ্যাতি নয়; বরং এটা ভারতের পরিচয় এবং এর ঐতিহ্য যা এখনও ভারতীয় সংবিধানের ঢালে সংরক্ষিত। বিশুদ্ধ ঐতিহ্যের এই জনপ্রিয়তা রক্ষার দায়িত্ব দেশের প্রতিটি নাগরিক সংস্থার। যেকোন আঘাত এর ক্ষতি করতে পারে। সবার উচিত ‘আমরা, ভারতের জনগণ…’ ঘোষণা করা এবং হৃদয়-মূল্যের সংবিধানের জন্য ধারাবাহিকতার চেতনা প্রদান করা।

 

সরকার জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। জনগণের ইচ্ছাই জাতির সাধারণ ইচ্ছা। এটিই সত্যাগ্রহে জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর অন্যতম প্রধান শিক্ষা। অসত্যের আগে নীরবতা সব ভারতীয় নাগরিকের নৈতিক পাপ। এই গণনায়, সংবিধান সংরক্ষণ থেকে শুরু করে একক নাগরিত্বের মত সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং কৃষকদের বিক্ষোভ থেকে বিপক্ষের বিতর্ক নিছক মতবিরোধ নয়; বরং এগুলো দেশের স্বার্থে কণ্ঠস্বর। পরিবর্তন অস্বীকার করা হয় না; বরং পরবর্তী পরিণতি সম্পর্কে পূর্ব-নিবদ্ধ দেওয়া হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাধারণ নীতিগুলি সংশোধন করা যেতে পারে, তবে চিন্তাশীল এবং উত্পাদনশীল উপায়ে, কিছু ভুলের কারণে একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ যেন না হয়। তারপর ‘সকলের জন্য’ ঝাঁক টানার হাঁকটি সত্য হয়ে উঠুক। তবুও, যদি সাধারণ ইচ্ছা বিবেচনা করা না হয় এবং সবকিছু পাস ও অনুমোদিত হয়ে যেতে থাকে তাহলে কিন্তু সংবিধানের ‘পুনরায় লেখা’ হয়ে যায়; সুরক্ষা নয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter