ইসলামী আইন কীভাবে গঠিত হয়: হিজাব নিয়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিতর্ক
ভূমিকা
একজন মুসলিম নারীর জন্য চুল ও দেহ আচ্ছাদনের বাধ্যতামূলক বিধান নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি প্রকাশ করেছেন—এই আদেশ কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করার জন্য, এই প্রবন্ধে ইসলামী আইনের বিধানগুলো সাধারণভাবে কীভাবে গঠিত হয়, তা আলোচনা করা হবে এবং নারী আচ্ছাদনের বিধানকে একটি কেস স্টাডি হিসেবে গ্রহণ করা হবে। আমরা দেখব, ফিকহ বিশেষজ্ঞদের সামনে কী কী উৎস থাকে এবং কীভাবে তারা বিভিন্ন পাঠ (টেক্সট) বিশ্লেষণ করে একটি আইনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
এই আলোচনায় প্রবেশ করতে গেলে, আমাদের প্রথমে "হিজাব" শব্দটি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। কেউ যখন হিজাব সংক্রান্ত আইনি বিধান জানার চেষ্টা করেন, তখন সাধারণত এই শব্দ থেকেই অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু দ্রুতই বোঝা যায় যে, এই অনুসন্ধান খুব ফলপ্রসূ নয়। কারণ, আমাদের সমকালীন সমাজে "হিজাব" শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়, তা প্রকৃত অর্থের চেয়ে বিভ্রান্তিকর।
হিজাব শব্দটি ভাষাগতভাবে এমন একটি পর্দা বা প্রতিবন্ধক বোঝায় যার ওপাশে দেখা যায় না। কুরআনে এই শব্দটি একাধিক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে—যেমন, জাহান্নামের লোকদের সঙ্গে জান্নাতবাসীদের মাঝে একটি বাস্তব পর্দা [সূরা আল-আ‘রাফ, ৪৪-৪৬]; আবার এমন একটি অদৃশ্য পর্দা যা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের অন্তরের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে [সূরা ফুস্যিলাত, আয়াত ৫; সূরা ইসরা, আয়াত ৪৫]।
আরেকটি প্রসঙ্গ হলো নবী ﷺ-এর স্ত্রীদের জন্য একটি বিশেষ বিধান, যেখানে তাদেরকে পরপুরুষদের থেকে একটি পর্দার আড়ালে থাকতে বলা হয়েছে [সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৫৩]। এটি তাদের জন্য শরীর ঢাকার বাধ্যবাধকতার অতিরিক্ত একটি নির্দেশ। সুতরাং এই হিজাব শব্দটি আমাদের পরিচিত অর্থে ব্যবহৃত নয়। আজকের দিনে "হিজাব" বলতে সাধারণত কেবল মাথার ওড়না বোঝানো হয়, কিন্তু কুরআনিক অর্থ এর থেকে অনেক ব্যাপক।
এই প্রবন্ধে, আমরা "হিজাব" বলতে মাথা ও শরীর ঢাকার সামগ্রিক ধারণাকে বুঝব। এই পর্দা ঢিলেঢালা এবং অস্বচ্ছ কাপড়ের মাধ্যমে হওয়া আবশ্যক, যা পুরুষ ও নারীর উভয়ের ক্ষেত্রেই শরীরের নির্দিষ্ট অংশ (আওরাহ) ঢাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে ‘আওরাহ’ ও ‘লজ্জাশীলতা’র পরিভাষা ও বিশদ আলোচনা এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে এবং পরবর্তী কোনো প্রবন্ধে তা আলোচনা করা হবে।
কুরআনিক উৎস
আমরা শুরু করব সেখান থেকেই যেখান থেকে সকল ফিকহবিদরা কোনো আইনি সমস্যার সমাধানে প্রথমে মুখ ফেরান—তা হলো কুরআন। ইসলামী আইনের প্রধান ও সর্বোচ্চ উৎস হলো কুরআন, কারণ এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত (কাতঈ আল-সুবুত)। সহজভাবে বললে, কুরআন বহুল পরিমাণে ও নিরবিচারে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হয়েছে, ফলে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, আমাদের কাছে যে পাঠ্যরূপে কুরআন রয়েছে, তা-ই নবী ﷺ-এর প্রতি অবতীর্ণ মূল পাঠ।
যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি যে কুরআন সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই কুরআনের মধ্যে থাকা বিধানগুলো নিঃসন্দেহে আল্লাহর আদেশ হিসেবে গণ্য হয়।
তবে, যদিও কুরআনের কোনো আয়াতে একটি স্পষ্ট আদেশ থাকতে পারে, সেই আদেশ বাস্তবে কীভাবে প্রয়োগ হবে, তা ব্যাখ্যার আওতাধীন হতে পারে (যেমন: যন্নি আদ-দালালাহ)।
উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা সূরা আল-মায়েদাহর ৬ নম্বর আয়াতে মুসলিমদেরকে নামাজের জন্য ওযু করার আদেশ দিয়েছেন:
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغْسِلُوا۟ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى ٱلْمَرَافِقِ وَٱمْسَحُوا۟ بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى ٱلْكَعْبَيْنِ ۚ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًۭا فَٱطَّهَّرُوا۟ ۚ وَإِن كُنتُم مَّرْضَىٰٓ أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ أَوْ جَآءَ أَحَدٌۭ مِّنكُم مِّنَ ٱلْغَآئِطِ أَوْ لَـٰمَسْتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَلَمْ تَجِدُوا۟ مَآءًۭ فَتَيَمَّمُوا۟ صَعِيدًۭا طَيِّبًۭا فَٱمْسَحُوا۟ بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُم مِّنْهُ ۚ مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍۢ وَلَـٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُۥ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ٦
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াও, তখন তোমাদের মুখমন্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করো, মাথা মাসেহ করো এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত করো। আর যদি তোমরা সম্পূর্ণরূপে নাপাক থাকো, তাহলে পূর্ণ গোসল করো। কিন্তু যদি তোমরা অসুস্থ হও, ভ্রমণে থাকো, অথবা মলত্যাগ করে থাকো, অথবা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করে থাকো এবং পানি না পাও, তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে নিজেদের পবিত্র করো, তোমাদের মুখমন্ডল ও হাত মুছে ফেলো। আল্লাহ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না, বরং তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের উপর তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো”। [সূরা আল-মায়েদাহ, ৫:৬]
এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, নামাজের আগে আমাদের শরীরের কিছু অঙ্গ ধুতে হবে। কিন্তু আয়াতটি কিভাবে এই কাজটি করতে হবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি।
প্রথমে আমরা একমত হতে পারি যে কোন কোন অঙ্গ ধোয়া দরকার, কিন্তু প্রশ্ন হলো—ওযু কি কেবল এই অঙ্গগুলো ধোয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? এগুলো কি কোনো নির্দিষ্ট ক্রম অনুযায়ী ধোয়া আবশ্যক?
এই ধরনের খোলা প্রশ্নগুলো দেখায় যে, যদিও কুরআনের আয়াতে একটি স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, তা পূর্ণভাবে বুঝতে গেলে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।
তবে কুরআনের তাফসির, হাদীসের দৃষ্টান্ত এবং অন্যান্য ফিকহি বিশ্লেষণের পদ্ধতির মাধ্যমে ফিকহবিদগণ ওযু করার নির্দিষ্ট অঙ্গ ও প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছেন।
একইভাবে, নারীদের পর্দার আদেশ কুরআনে রয়েছে, তবে সেটি এমনভাবে এসেছে যা প্রাথমিকভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে। সুতরাং, কী পরিমাণ ঢেকে রাখা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে, তা নির্ধারণের জন্য অন্যান্য উৎস যেমন হাদীস ও ব্যাখ্যামূলক পাঠ্যগুলো খতিয়ে দেখা জরুরি।
কুরআনে নারীদের পোশাক ও লজ্জাশীলতা নিয়ে কয়েকটি আয়াত রয়েছে, যার মধ্যে সূরা আন-নূরের ৩১ নম্বর আয়াতটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ:
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَـٰتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَـٰرِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ ءَابَآئِهِنَّ أَوْ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَآئِهِنَّ أَوْ أَبْنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوْ نِسَآئِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَـٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّـٰبِعِينَ غَيْرِ أُو۟لِى ٱلْإِرْبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفْلِ ٱلَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا۟ عَلَىٰ عَوْرَٰتِ ٱلنِّسَآءِ ۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوٓا۟ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ٣١
“আর মুমিন নারীদের বলো যেন তারা তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের সতীত্বের হেফাজত করে, এবং তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, যা সাধারণত দেখা যায়। তারা যেন তাদের বুকের উপর পর্দা টেনে নেয় এবং তাদের লুকানো সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, ৩ তাদের স্বামী, তাদের পিতা, তাদের শ্বশুর, তাদের পুত্র, তাদের সৎপুত্র, তাদের ভাই, তাদের ভাইয়ের ছেলে বা বোনের ছেলে, তাদের সহকর্মী নারী, তাদের মালিকানাধীন দাসী, কোন কামনা-বাসনাহীন পুরুষ দাসী, অথবা যারা এখনও নারীর নগ্নতা সম্পর্কে অবগত নয়, তাদের ছাড়া। তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে তাদের পায়ে আঘাত না করে। হে মুমিনগণ, সকলে মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো”। [সূরা আন-নূর, ২৪:৩১]
এই আয়াতে নারীদের জন্য দুটি প্রধান নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে:
১) তারা যেন নিজেদের যীনাহ (শরীরের সৌন্দর্য) প্রকাশ না করে, শুধুমাত্র যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় তা ছাড়া।
২) তারা যেন নিজেদের খিমার (ওড়না) দিয়ে বুক ঢাকে।
ফিকহবিদরা প্রথম নির্দেশনাটিকেই মূল আদেশ হিসেবে দেখেন, আর দ্বিতীয়টি এর ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেন।
যীনাহ বলতে কী বোঝায়, তা বুঝতে হলে কুরআনের তাফসিরের দিকে তাকাতে হয়। প্রখ্যাত সাহাবি ও তাফসিরবিশারদ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে "যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয়" বলতে মুখ ও হাত বোঝানো হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকেও অনুরূপ ব্যাখ্যা এসেছে।
এই ব্যতিক্রমগুলো জীবনযাপনের প্রয়োজন থেকেই অনুমোদিত—যেমন লেনদেনে মুখ দেখানো বা হাত ব্যবহার করা জরুরি। হানাফি মাজহাব অনুসারে, নারীদের পা-ও প্রকাশের অনুমতি আছে, কারণ হাঁটার সময় তা অনিচ্ছাকৃতভাবে দেখা যেতে পারে। কিছু মালিকি আলিমও এক মত পোষণ করেছেন, কারণ পা ঢেকে রাখা সবসময় কঠিন হতে পারে।
নবী ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টান্ত
কেউ যদি মনে করে কেবল কুরআনের আয়াত থেকে নারীদের পর্দার নির্দেশ ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে, তবে আমাদের ইসলামি আইনের দ্বিতীয় মূল উৎসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়—নবী করিম ﷺ-এর সুন্নাহর দিকে।
কুরআনের অনেক আয়াত নবী ﷺ-এর দৃষ্টান্ত ছাড়া বোঝা যায় না। যেমন, আমাদের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সংখ্যা বা সময়ের নির্দিষ্টতা কুরআনে নেই; বরং তা সুন্নাহ ও সাহাবিদের আমল থেকেই এসেছে। ইতিহাসে এটি কোনো সমস্যা হয়নি, কারণ ইসলামি আইন বোঝার জন্য কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা (আলিমদের ঐক্যমত) সবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর উদাহরণ পাওয়া যায় সাহীহ হাদীসে—যেখানে হযরত আনাস (রা.) বলেন, যখন মদ হারাম হওয়ার আয়াত নাজিল হয়, তখন তিনি সাহাবিদেরকে মদ পরিবেশন করছিলেন। কেউ এসে জানালে সঙ্গে সঙ্গেই মদ ফেলে দেন এবং সকল সাহাবাও তাই করেন। মদিনার রাস্তা তখন মদের স্রোতে ভিজে গিয়েছিল।
এই ঘটনা বোঝায়, কুরআনের নির্দেশ কিভাবে সাহাবিরা বাস্তবায়ন করতেন তা সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতিক্রিয়া থেকেই পরিষ্কার হয়।
তেমনি, যখন নারীদের পর্দার আয়াত নাজিল হলো—“তারা যেন নিজেদের খিমার দিয়ে বক্ষ ঢেকে রাখে”—তখন হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন:
“আল্লাহর কসম! আমি আনসার নারীদের চেয়ে ভালো ও বেশি ঈমানদার নারী আর দেখিনি। আয়াতটি নাজিল হতেই তারা নিজেদের কাপড় ছিঁড়ে ওড়না বানিয়ে পর্দা করলেন।”
এই হাদীস গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি বর্ণনা করেছেন আয়েশা (রা.)—একজন নারীবাদী চিন্তাধারাসম্পন্ন, দৃঢ়মতবতী, জ্ঞানে প্রগাঢ় সাহাবিয়া।নারীদের পর্দার বিধানকে কেবল পুরুষদের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত বলা হলে, এই হাদীস তা খণ্ডন করে। কারণ, সাহাবি নারীরাই আয়াত অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে শরীর ঢেকে আল্লাহর আদেশ মান্য করেছিলেন। কেউ যদি এই হাদীসকে তুচ্ছ করে, তবে মূলত নারী সাহাবিদের ইসলামি ব্যাখ্যায় ভূমিকা ও সক্রিয়তাকেই অস্বীকার করা হয়।
সংস্কৃতি না আইনি বিধান?
কিছু মানুষ মনে করে যে “খিমার (ওড়না) বক্ষে টেনে আনা” নির্দেশনার অর্থ শুধু বুক ঢাকা, চুল ঢাকার প্রয়োজন নেই। তারা বলেন, খিমার পরা তখনকার আরব সংস্কৃতি ছিল, ধর্মীয় ফরজ নয়।
তবে ইসলাম সংস্কৃতি মোকাবিলায় তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছে:
১) কোনো প্রচলিত রীতি হারাম ঘোষণা করেছে—যেমন কন্যাশিশু হত্যা।
২) সংস্কৃতিকে মেনে নিয়ে তাতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে—যেমন বহুবিবাহে সীমা নির্ধারণ।
৩) সংস্কৃতি গ্রহণ করে তাকে শরিয়তের অংশ বানিয়েছে—যেমন হত্যার ক্ষতিপূরণ (দিয়াহ)।
নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে, ইসলাম তৃতীয় পথ অনুসরণ করেছে। কুরআন ও সুন্নাহ দেখায় যে নারীরা তখন মাথা ঢাকতো, ইসলাম সেই রীতিকে অনুমোদন দিয়ে মাথা ও শরীর ঢাকাকে বাধ্যতামূলক করেছে, শুধু মুখ ও হাত ছাড়া। ফলে চুল ঢাকার বিষয়টি আর কেবল সংস্কৃতি নয়, বরং ধর্মীয় বিধান হয়ে যায়।
তবে সংস্কৃতি এখনো প্রভাব রাখে—কোন রঙ বা স্টাইলে হিজাব পরা হবে তা সংস্কৃতি নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু শরীর ঢাকার মূল ফরজ বিধানটি অপরিবর্তনীয়।
যারা হিজাবকে শুধু সংস্কৃতি মনে করে, তাদের ওপর প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায়। কারণ, কুরআন ও সুন্নাহ যেসব আদেশ দেয়, তা বাধ্যতামূলক ধরে নেওয়া হয়—যেমন পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার। একইভাবে, হিজাব সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসও স্পষ্ট ভাষায় এসেছে, তাই এগুলোও বাধ্যতামূলক ধর্মীয় বিধান.
আলেমদের ঐক্যমত ও শরঈ পদ্ধতি
নারীদের চুল ঢাকার ফরজ বিধান নিয়ে সবচেয়ে শক্ত প্রমাণগুলোর একটি হলো—আলেমদের ঐক্যমত (ইজমাʿ)। ইসলামি আইনের তৃতীয় মূল উৎস হলো ইজমাʿ, যার ভিত্তি হলো হাদীস: “আমার উম্মত ভুলের ওপর একমত হবে না।” অর্থাৎ, যদি সকল আলেম কোনো বিষয়কে ফরজ মনে করেন, তাহলে সেটা ভুল হওয়া অসম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, কুরআনের আয়াতে [৫:৬] বলা হয়েছে, ওযু করার সময় মাথা মোছা এবং পা পর্যন্ত ধোয়ার কথা। আয়াতে "পা" সম্পর্কে মোছা বোঝালেও সব মাযহাব একমত যে, পা ধোয়া ফরজ। কেননা, অন্যান্য হাদীস মিলিয়ে ফিকহবিদরা একমত হয়েছেন যে এখানে "ধোয়া" বোঝানো হয়েছে। এভাবেই ইজমাʿ শরীয়তের মান্য উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
হিজাব সম্পর্কেও সকল যুগের আলেম একমত—এটি ফরজ। যদিও অনেকে বলে থাকেন, এটি কেবল পুরুষশাসিত সমাজের ব্যাখ্যা। কিন্তু ফিকহে হিজাবের ফরজিয়ত ইজমাʿ দ্বারা প্রমাণিত, যা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে গঠিত, কেবল সংস্কৃতি বা পুরুষদের মত নয়।
উপসংহার
অনেকে ভাবতে পারেন—যদি নারীদের হিজাব ফরজ হতো, তাহলে তা কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত। কিন্তু আমরা দেখি, নামাজের পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ হওয়ার বিষয়টিও কুরআনে সরাসরি বলা হয়নি, তবুও তা নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। কেননা, নবী ﷺ ও সাহাবিদের প্রক্রিয়া এবং ইজমাʿ একে অকাট্য ফরজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যেমন নামাজ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে, তেমনি হিজাবও প্রাথমিক যুগ থেকেই ইসলামের অনিবার্য অনুশীলনের অংশ। এ কারণে ফিকহের বইগুলো নামাজের সংখ্যার প্রমাণ নয়, বরং নামাজের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। একইভাবে, নারীদের চুল ঢাকা ও শালীন পোশাক পরা কেবল কুরআনের আয়াত নয়, বরং নবীর সুন্নাহ ও সাহাবিদের বাস্তব উদাহরণ থেকে সুস্পষ্টভাবে ফরজ বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
ইতি: মহম্মদ রতিবুল সেখ