মর্যাদাপূর্ণ মসজিদগুলির মহত্ত্ব এবং ইসলামে এটি নির্মাণের গুরুত্ব

ভমিকা

ইসলামে, মসজিদ নির্মাণকে একটি মহান পুণ্য এবং একটি চলমান দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি কেবল একটি উপাসনালয় নয়, বরং মুসলমানদের জন্য একটি সমাবেশ কেন্দ্র, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রও। ইতিহাস সাক্ষী যে, ইসলামী সভ্যতা বিকাশে মসজিদগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মসজিদ নির্মাণ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমই নয়, বরং এটি এমন একটি পরিবেশও তৈরি করে যেখানে ঈমান, জ্ঞান এবং নৈতিকতার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

কুরআনের আলোকে মসজিদের গুরুত্ব।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ এবং এর জনসংখ্যার ফজিলত সম্পর্কে জোর দিয়েছেন। সূরা আত-তাওবায় বলা হয়েছে:

“আল্লাহর মসজিদগুলো তারাই আবাদ করে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান আনে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। এরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।“

(সূরা আত-তাওবা: ১৮)

এই আয়াতটি স্পষ্ট করে দেয় যে মসজিদ নির্মাণ এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৃত মুমিনদের লক্ষণ। মসজিদ কেবল একটি ভবন নয়, বরং একটি পবিত্র স্থান যেখান থেকে আল্লাহর আশীর্বাদ নেমে আসে, হৃদয় শান্তি পায় এবং মানুষ ইবাদতের প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করে।

হাদিসের আলোকে মসজিদ নির্মাণের ফজিলত।

নবী মুহাম্মদ (সা.) অনেক হাদিসে মসজিদ নির্মাণের ফজিলত তুলে ধরেছেন। একটি হাদিসে এসেছে:

“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করে, যদিও তা একটি বাসার সমান ছোট হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।“

(সহীহ মুসলিম: ৫৩৩)

এই হাদিস থেকে জানা যায় যে, মসজিদ যত বড় বা ছোটই হোক না কেন, মহান আল্লাহ তাআলা তাকে বিরাট প্রতিদান দান করেন।

মসজিদের গুরুত্ব কেবল ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মুসলমানদের সকল সাম্প্রদায়িক বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো মসজিদে নববী নির্মাণ। মসজিদে নববী কেবল নামাজের স্থান ছিল না, বরং এটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী, যেখানে শিক্ষা, ন্যায়বিচার, সমাজকল্যাণ এবং অন্যান্য বিষয় পরিচালিত হত। ইসলামী ইতিহাসে এমন অনেক মসজিদ রয়েছে যা জ্ঞান ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, যেখান থেকে মহান মুসলিম পণ্ডিত এবং হাদিস পণ্ডিতরা ধর্মের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজও, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মসজিদগুলি ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।

মসজিদ নির্মাণ এবং চলমান দাতব্য কার্যক্রম।

ইসলাম এমন কিছু কাজের কথা উল্লেখ করেছে যার প্রতিদান মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার হলো মসজিদ নির্মাণ। একটি হাদিসে এসেছে:

“যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি জিনিস ছাড়া: চলমান দান, এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় এবং নেককার সন্তান যারা তার জন্য প্রার্থনা করে।“ (সহীহ মুসলিম: ১৬৩১)

একটি মসজিদকে একটি চলমান দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে নামাজ পড়া হয়, যিকির করা হয় এবং কুরআন পড়ানো এবং শেখানো হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এর সওয়াব অব্যাহত থাকে।

মসজিদ নির্মাণের অনেক পার্থিব ও পরকালীন সুবিধা রয়েছে:

১. জান্নাতে একটি ঘরের গ্যারান্টি – হাদিসে যেমন বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি একটি মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।

২. পাপ ক্ষমা – মসজিদ নির্মাণ এমন একটি কাজ যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার পাপ ক্ষমা করেন।

৩. আশীর্বাদ ও রহমত – মসজিদ এমন একটি স্থান যেখানে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়, যে কেউ সেখানে ইবাদত করে সে আল্লাহর আরও নৈকট্য লাভ করে।

৪. সমাজে ঐক্য – মসজিদ এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ বৈষম্য ছাড়াই একত্রিত হয়, একে অপরের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং একে অপরকে সাহায্য করে।

ঐতিহাসিকভাবে মহান মসজিদ :

মুসলিম ইতিহাসে এমন বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে যা ইসলামী সভ্যতার উত্থানের প্রতীক:

১. মসজিদুল হারাম (মক্কা) – পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র এবং প্রথম মসজিদ, যা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং হযরত ইসমাঈল (আঃ) দ্বারা নির্মিত।

২. নবীর মসজিদ (মদীনা) – নবী মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক নির্মিত মসজিদ যা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম কেন্দ্রে পরিণত হয়।

৩. আল-আকসা মসজিদ (বাইত আল-মাকদিস) – মুসলমানদের প্রথম কিবলা, যেখান থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে স্বর্গারোহণের রাতে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

৪. কর্ডোবা মসজিদ (স্পেন)- আন্দালুসিয়ায় মুসলিম শাসনামলে নির্মিত একটি দুর্দান্ত মসজিদ, এটি ইসলামী স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন।

৫. বাদশাহী মসজিদ (লাহোর) – মুঘল আমলে নির্মিত একটি দুর্দান্ত মসজিদ, এটি ইসলামী স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

মসজিদে জনবসতি স্থাপনের দায়িত্ব:

মসজিদ নির্মাণের পর এর বসতি স্থাপনও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কখনও কখনও মানুষ মসজিদ তৈরি করে এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখে, যদিও মসজিদের আসল উদ্দেশ্য হলো নামাজ, শিক্ষা এবং স্মরণের মাধ্যমে এটিকে জনবহুল করে তোলা। মসজিদের সেবা করা, এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, নামাজীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা এবং ধর্মীয় কার্যকলাপ প্রচার করাও পুরষ্কারজনক।

উপসংহার :

মসজিদ নির্মাণ একটি মহান পুণ্যের কাজ যা ঈমানের নিদর্শন এবং জান্নাত অর্জনের মাধ্যম। এটি কেবল উপাসনালয়ই নয় বরং ইসলামী সংস্কৃতি এবং মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রও। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তার সামর্থ্য অনুযায়ী মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণ করা এবং এর সেবা করাকে তার জীবনের লক্ষ্য করে তোলা। মহান আল্লাহ আমাদের এই মহান নেক কাজে অংশগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter