গাজা, ফিলিস্তিন, ও মুসলিম দুনিয়া: এক অবিচারিত যন্ত্রণার দলিল
ভূমিকা:
ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড আজকের দুনিয়ার এক নিষ্ঠুরতম মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরছে। যেভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মাধ্যমে শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, তা ইতিহাসে বিরল। এ যুদ্ধ কেবল ভূখণ্ড দখলের নয়, বরং এটি এক সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও মুসলিম জাতিসত্তার উপর ধারাবাহিক আঘাত। মুসলিম উম্মাহর প্রতি এখন সময়ের দাবি—এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি:
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ জন শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৬৪ জন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই ধ্বংসযজ্ঞে মোট শহীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০,৯৩৩ জন এবং আহতের সংখ্যা ১,১৬,০৪৫ জন। শুধু ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্তই ১,৫৬৩ জন শহীদ এবং ৪,০০৪ জন আহত হয়েছেন।
এই পরিসংখ্যান কোনো সংখ্যা নয়, বরং প্রতিটি শহীদের পেছনে রয়েছে একটি করে পরিবার, একটি করে কাহিনি, এক একটি জীবন—যা নির্মমভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র:
গাজার মধ্যাঞ্চলের নসিরাত শরণার্থী শিবিরে বৃদ্ধ নারী ও শিশুরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শুধু একমুঠো খাবারের আশায় অপেক্ষা করছেন। এই ছবি বিশ্ব বিবেককে কাঁপিয়ে তোলার মতো, যদি সেই বিবেক সত্যিই জীবিত থাকে। একদিকে গাজার আকাশে বারুদের গন্ধ, আরেকদিকে ক্ষুধার্ত শিশুদের চিৎকার—এই হলো একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার প্রতিচ্ছবি।
ভ্রান্ত প্রচার ও প্রযুক্তির ফাঁদ:
এদিকে সামাজিক মাধ্যমে চলছে এক ভিন্ন যুদ্ধ—মিথ্যা প্রচার ও বিভ্রান্তির। কেউ বলছে, এ সময়টাই দাজ্জালের আগমনের সময়, কেউ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-র তৈরি ভিডিও ও ছবি দিয়ে মানুষের মনে ভয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। অথচ এমন সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সতর্কতা ও সঠিক তথ্য যাচাই। যে কোনো কিছু শেয়ার করার আগে বারবার ভাবা দরকার—তা সত্য কিনা, প্রয়োজনীয় কিনা, কার ক্ষতি হতে পারে।
মুসলিম নারীদের প্রতিবাদ ও জাগরণ:
এই অন্ধকার সময়েও আশার আলো হয়ে উঠেছে মুসলিম উম্মাহর নারীরা। ভারতের গুজরাট রাজ্য থেকে উঠে এসেছে কিছু সাহসিনী, যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, শ্লোগান তুলেছেন, এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের এই উদ্যোগ কেবল স্থানীয় নয়—এটি একটি বার্তা যে, মুসলিম উম্মাহ ঘুমিয়ে থাকলেও তার মেয়েরা জেগে আছে।
ইসরায়েলি পণ্যের বর্জন: দায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা:
একটি অন্যতম কার্যকর প্রতিরোধের পথ হলো—ইসরায়েলি পণ্য সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা। কিন্তু অনেকেই সাময়িক আবেগে উত্তেজিত হয়ে কিছুদিন বর্জন করেই আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে যান। মনে রাখতে হবে, বর্জন একটি দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম, এবং আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। যে দোকানদার এসব পণ্য সরাতে রাজি নয়, তার দোকানও বর্জনের আওতায় আনা উচিত।
ভারতের সাম্প্রতিক আইনি জয়:
এদিকে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ‘ওয়াকফ সংশোধনী আইন’ নিয়ে অনুষ্ঠিত শুনানিতে মুসলিম সমাজের পক্ষে এক ইতিবাচক দিক উন্মোচিত হয়েছে। সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবী বিরোধী দল থেকে এই আইনটির অসঙ্গতি ও মুসলিম স্বার্থবিরোধী দিকগুলো তুলে ধরেন। অপরদিকে, সরকার পক্ষের তিনজন আইনজীবী তাদের অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হন।
সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ তিনটি নির্দেশনা:
১. আগে থেকে ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃত সম্পত্তিগুলো আর চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
২. কালেক্টর তদন্ত চালাতে পারবে, তবে নতুন আইনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না।
৩. ওয়াকফ বোর্ডে ৮ জন মুসলিম সদস্য ছাড়া বাকি সদস্যরাও মুসলিম হতে হবে—অমুসলিমদের সংখ্যাধিক্য গ্রহণযোগ্য নয়।
এই সিদ্ধান্তগুলি শুধু আইনি নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর তাৎপর্য বহন করে। এটি বর্তমান সরকারের মুসলিম স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক ধাক্কা।
উপসংহার:
ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস, গাজার মানুষদের অসহায়তা, মুসলিম নারীদের প্রতিবাদ, ও ভারতীয় মুসলিমদের আইনি সংগ্রাম—সব মিলিয়ে এক নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে। এই সময় আমাদের নীরব থাকার সময় নয়, বরং সোচ্চার হয়ে দাঁড়ানোর সময়।
আমরা যদি সত্যিই ফিলিস্তিনের পাশে থাকতে চাই, তবে আমাদের বর্জন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে, মিডিয়ার বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পেতে হবে, মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সর্বোপরি, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এই যুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।