হজ পালনের জন্য ঘোড়ায় চড়ে সৌদি আরবে পৌঁছেছেন চার ইউরোপীয় হজযাত্রীরা

ইসলাম একটি জীবনব্যাপী সাধনার নাম, যার প্রতিটি স্তম্ভ মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ ও মানবিক মূল্যবোধকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম, যা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতির এক চূড়ান্ত পরীক্ষার নাম। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে যেখানে কয়েক ঘণ্টার ফ্লাইটেই মানুষ সৌদি আরবে পৌঁছে যেতে পারে, সেখানে ইউরোপের চার তরুণ মুসলমান ঘোড়ায় চড়ে হজে যাওয়ার অদ্ভুত, কঠিন কিন্তু ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। আধুনিকতার হাত ছুঁয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের পথে ফিরে গিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে ঘোড়ায় চড়ে সৌদি আরবে পৌঁছেছেন চার সাহসী ইউরোপীয় মুসলমান। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে মরুভূমি, পাহাড় আর বিভিন্ন দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মক্কার পবিত্র যাত্রাপথে পা রেখেছেন তারা। এই চারজনের মধ্যে একজন মরক্কো এবং চারজন স্পেনের নাগরিক।এই সাহসী পদক্ষেপ শুধুমাত্র এক ভ্রমণের গল্প নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে বিশ্বাস, ত্যাগ, ঐতিহ্য আর নতুন করে আত্মস্মরণ করার এক মহান দৃষ্টান্ত।

চারজন বন্ধু স্পেন থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত ঘোড়ায় চড়ে হজ পালন করতে রওনা দেন, একটি তীর্থযাত্রার পথকে পুনরুজ্জীবিত করে যা আন্দালুসীয় মুসলিমরা শেষবার ব্যবহার করেছিলেন ৫০০ বছরেরও বেশি আগে। তারা ৮,০০০ কিলোমিটার (৪,৯৭০ মাইল) পথ পাড়ি দিয়ে স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া এবং জর্দান অতিক্রম করে গত সপ্তাহে সৌদি আরবের উত্তরের সীমান্ত অঞ্চলে পৌঁছান, ঠিক হজের সময়ের আগেই।

এই চার স্প্যানিশ মুসলিম—আবদেলকাদার হারকাসি, বৌচিব জাদিল, আবদাল্লাহ হারনান্দেজ ও তারিক রদ্রিগেজ—৩৫ বছর আগে ইসলাম গ্রহণের পর তাদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করছেন।

তাদের সঙ্গে আছেন বোচাইব জাদিল নামের এক নির্মাণকর্মী, যিনি স্পেনে বসবাস করেন। তিনি একটি গাড়িতে দলের সামনে থেকে পথ দেখিয়ে তাদেরকে লজিস্টিক সহায়তা দিচ্ছেন। সবকিছুর শুরু হয়েছিল যখন আবদাল্লাহ হারনান্দেজ ৩৫ বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেন।

পটভূমি ও উদ্দেশ্য:

এই চার তরুণ মুসলমানের একজন জার্মানি থেকে, অন্যরা ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও বসনিয়া থেকে। তারা সকলেই পশ্চিমা সমাজে বসবাসরত দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের মুসলিম। ইউরোপীয় আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যে বেড়ে ওঠা এই যুবকরা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন, তারা হজ পালন করবেন নবীজি (সা.)-এর যুগের আদলে—ঘোড়ায় চড়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল দুটি মূল উদ্দেশ্য: একদিকে হজের প্রকৃত ত্যাগ ও ধৈর্যের অনুভূতি অর্জন করা, অপরদিকে আধুনিক মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন চেতনার জাগরণ ঘটানো—যাতে তারা ইসলামের প্রাথমিক আত্মাকে নতুন করে চিনে নিতে পারে।

তাদের এই ঐতিহাসিক যাত্রার মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন আবদুল্লাহ হার্নান্দেজ, যিনি ২৪ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে কোরআনের আয়াত তার হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, পরীক্ষায় পাশ করলে ইসলাম গ্রহণ করবেন এবং প্রাচীন আন্দালুসীয় মুসলিমদের মতো ঘোড়ায় চড়ে হজে যাবেন। যেমন ভাবে তারিক বিন জিয়াদ ঘোড়াই চড়ে আন্দোলুস (Spain) বিজয় করেছেন।

ভ্রমণের সময়কাল ও পথরেখা:

এই দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু হয় ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটিতে। প্রথমে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে একটি দলে রূপ নেন। এরপর তারা দীর্ঘ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন: ঘোড়া নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ভিসা ও অনুমতিপত্র সংগ্রহ, এবং সর্বোপরি মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি।

তাদের যাত্রাপথ বিস্তৃত ছিল কয়েক হাজার কিলোমিটার জুড়ে—জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডান, তারপর সৌদি আরব। আল কুরাইয়াত অঞ্চলের আল হাদিথাহ সীমান্তে পৌঁছালে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সৌদি কফি, রিফ্রেশমেন্ট ও ফুল দিয়ে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান সৌদি কর্মকর্তারা।পথে অনেক স্থানেই মুসলিমদের আতিথেয়তা ও সাহায্য তাদের সাহস জুগিয়েছে। প্রায় ৯ মাস থেকে ১ বছরের মতো দীর্ঘ এ সফর ছিল ক্লান্তিকর, কিন্তু প্রতিটি ধাপ ছিল অনন্য অভিজ্ঞতায় ভরা।

চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা:

এই যাত্রা কেবল দূরত্ব ও শারীরিক পরিশ্রমের কারণে কঠিন ছিল না, বরং নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সীমান্ত পারাপারে দেরি, কিছু অঞ্চলে যুদ্ধ বা অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ও পানির সংকট, ঘোড়ার পরিচর্যা, মাঝে মাঝে আর্থিক সংকট—সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল এক নতুন সংগ্রাম।

তবে এই সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা হাল ছাড়েননি। তারা প্রতিটি প্রতিকূলতাকে আল্লাহর এক পরীক্ষা হিসেবে দেখেছেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছেন। প্রতিটি জায়গায় তারা মুসলমানদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন, মসজিদে নামাজ পড়েছেন, ইসলামের শিক্ষা ছড়িয়েছেন এবং দুনিয়াকে দেখিয়েছেন যে, প্রকৃত ঈমান থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়।

সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার দুই বন্ধু আবদেলকাদের হারকাসি ও তারিক রদ্রিগেজ তার সঙ্গে যুক্ত হন। তারা প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই হজযাত্রায় অংশ নিয়েছেন, যা প্রায় সাড়ে চার মাসের অধিক সময় ধরে চলেছে। এ অভিযানে তারা ইতিহাস ও বিশ্বাসের এক অনন্য সংমিশ্রণ তুলে ধরেছেন। তাদের যাত্রা শুধু হজ নয়, বরং পাঁচশত বছর আগের আন্দালুসিয়ান মুসলিম ঐতিহ্য পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিমান, নৌপথ বা এমনকি ঘোড়ায় করেই হোক—প্রত্যেক হাজির জন্যই সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা হবে। ২০২৫ সালে যেখানে প্রায় আঠারো লাখ হাজি হজ পালন করবেন, সেখানে এই চারজনের ব্যতিক্রমধর্মী যাত্রা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে।

ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য:

এই যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, হজ শুধু একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধির এক পরম সুযোগ। এই চার তরুণ মুসলমান প্রমাণ করেছেন যে হজের প্রকৃত শিক্ষা শুধু পোশাক পাল্টানো নয়, বরং অন্তর পাল্টানো। তারা যে ত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, তা আধুনিক মুসলিম তরুণদের সামনে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।

তাদের এই পদক্ষেপ মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী ঐতিহ্য, সংযম ও সত্যিকারের তাকওয়ার চেতনা নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াতে তারা ‘Peace Riders’ বা ‘Modern Nomads’ নামেও পরিচিতি পেয়েছেন। তারা শান্তির দূত হিসেবে একটি ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন—ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, বরং তা এক জীবনপদ্ধতি, যা বিশ্বমানবতার জন্য কল্যাণকর।

সমাজে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

তাদের যাত্রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও ইউটিউব চ্যানেল তাদের নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অনেক মুসলিম তরুণ এই চারজনকে নিজেদের আদর্শ মনে করে আত্মজিজ্ঞাসার পথে অগ্রসর হচ্ছে। তারা নিজেদের জীবন, হালাল-হারাম, আত্মশুদ্ধি এবং ইবাদতের গুরুত্ব নতুন করে ভাবতে শিখছে।

তাদের মক্কায় পৌঁছানোর ভিডিও ও ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকেই এই কর্মকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাচ্ছেন। এই যাত্রা প্রমাণ করেছে, ইচ্ছা ও ঈমান থাকলে পথ কোনো বাধাই নয় এমনকি এই ভ্রমণ ইসলামী পর্যটন ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছে—ইতিহাস, ভ্রমণ ও আত্মিকতা মিশিয়ে এক নতুন ধারার চিন্তাচর্চা।

উপসংহার:

“হজ করতে ঘোড়ায় চড়ে সৌদিতে ইউরোপের চার মুসলিম” কাহিনী কেবল একটি ভিন্নধর্মী ভ্রমণ নয়, বরং এটি ইসলামের গভীর শিক্ষাকে জীবন্ত করে তোলার এক অনন্য প্রয়াস। তারা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন যে, আধুনিক জীবনের আরামে ডুবে না গিয়ে, আমরা যদি একটু কষ্ট সহ্য করি, তাহলে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা সম্ভব।

এই গল্প সকল মুসলমানের জন্য এক আত্মপ্রবঞ্চনার আয়না—আমরা কতটা সহজে সবকিছু চাই, অথচ প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে কষ্টের মাঝেই। তাদের সাহসিকতা, ত্যাগ ও ঈমান আমাদের অনুপ্রাণিত করুক, যেন আমরা নিজেরাও আমাদের জীবনে হজের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়ন করতে পারি—চলনে, বলনে, ও অন্তরে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter