মুহাররম: তাওবার মাস না কি তাজিয়ার উৎসব?

ভূমিকা

হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস হলো মুহাররম। এই মাস ইসলামী ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ এবং ফজিলতপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। এ মাসে মহান আল্লাহ বহু নবীকে বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছেন এবং তাঁদের দুআ কবুল করেছেন। মুহাররম হলো আত্মসংশোধন, গুনাহ থেকে মাফ চাওয়ার এবং ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের অঙ্গীকার করার মাস। এই মাস সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বহু সহিহ হাদিস রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এর গুরুত্ব আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই মাসেই আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এই মাসেই কেয়ামত সংঘটিত হবেন। একই মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রাঃ) কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছিলেন—ইসলামী ইতিহাসের এক বেদনাবিধুর অধ্যায়।

এই মাস আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আত্মজিজ্ঞাসার সময়। প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি এ মাসের মর্যাদা অনুযায়ী আমল করি? নাকি এর ফজিলত থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ি? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা অনেকেই এ মাসে নেক আমল করার পরিবর্তে নানা গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ি। নবীজি (সা.) আশুরার (১০ মুহাররম) দিনে রোজা রাখতেন এবং মুসলিম উম্মাহকে সে রোজার আদেশ দিয়েছিলেন, এমনকি তাসুয়া (৯ মুহাররম) এর রোজা রাখারও নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আমরা এ শিক্ষা গ্রহণ না করে শরিয়তের বিরুদ্ধাচরণে মেতে উঠি—তাজিয়া, মর্সিয়া, লাঠি খেলা প্রভৃতি বিদ‘আতি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ি। তাহলে আমাদের কী করা উচিত? কী করা উচিত নয়? সে বিষয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

মুহাররম মাসে আমাদের করণীয়

মুহাররম মাস আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ও বরকতময় মাস। এ মাসের ফজিলতের বিবেচনায় কিছু নির্দিষ্ট আমল রয়েছে, যেগুলো পালন করলে মুমিন আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠতে পারে। নিচে সেসব করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হলো—

১. আশুরা ও তাসুয়ার রোজা পালন

মুহাররম মাসে রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদিস শরিফে এর বহু বিবরণ পাওয়া যায়, যা মুহাররম মাসের রোজার গুরুত্ব প্রমাণ করে। আমরা জানি, রমজান মাসের রোজার তুলনা হয় না—কিন্তু রমজানের পর সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ রোজা হলো মুহাররম মাসের রোজা।

একটি হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত—রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

أفضل الصِّيام، بعد رمضان، شَهر الله المُحَّرم، وأفضل الصلاة، بعد الفَريضة، صلاة الليل

“রমজানের রোজার পর আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম রোজা হলো মুহাররম মাসের রোজা; এবং ফরজ নামাজের পর সর্বাধিক মর্যাদার নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।” (সহিহ মুসলিম)

আরেকটি সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ

“যদি আমি আগামী বছর পর্যন্ত জীবিত থাকি, তবে অবশ্যই তাসুয়া (৯ মুহাররম)-এর রোজাও রাখব।”

এই হাদিস থেকে সুস্পষ্ট যে, ৯ ও ১০ মুহাররম রোজা রাখা সুন্নাত ও ফজিলতপূর্ণ আমল। মুসলিমদের উচিত নিজে এই রোজা রাখা এবং অন্যদেরও এই রোজার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।

২. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদেশ ও সাহাবাদের আমল

হজরত আয়িশা (রাঃ) বলেন,

“রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় অবস্থানকালে আশুরার দিন রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদেরও তা রাখার নির্দেশ দিতেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩৭)

অতএব, এই দিনটি আমাদের জন্য একটি বিশেষ ইবাদতের সুযোগ। মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত এই মহিমান্বিত দিনে রোজা পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।

৩. রোজার ফজিলত ও গুনাহ মাফের সম্ভাবনা

হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত—

“যে ব্যক্তি আশুরার দিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তাকে এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।”

এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হাদিস। আল্লাহর অসীম রহমত আমাদের প্রতি বর্ষিত হতে পারে, যদি আমরা এই রোজা রাখার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করি।

তওবা ও দুআ করা

এই পবিত্র মুহাররম মাসে আল্লাহ তাআলা বহু নবী ও রাসূলের তওবা কবুল করেছেন। যেমন, হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)—যাঁদেরকে আল্লাহ জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করান—তাঁরা অনুশোচনাপূর্ণ দুআ ও তওবা করেন এবং মুহাররম মাসের ১০ তারিখে তাঁদের সেই দুআ আল্লাহ কবুল করেন।

তেমনি, এই মাসের দশম দিনেই হজরত ইউনুস (আ.)-এর দুআ কবুল করে আল্লাহ তাঁকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দেন। হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নামরুদের জ্বালানো অগ্নি থেকে নিরাপদে রক্ষা করেন। হজরত মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর অনুসারীদের সমুদ্র পার করান এবং ফেরাউন ও তাঁর বাহিনীকে সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করেন। এইসব গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাসবিধৌত ঘটনাগুলো ঘটেছে মুহাররম মাসেই।

সুতরাং, আমাদের উচিত হবে নিজের গোনাহের জন্য এ মাসে তওবা করা, আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে দুআ করা। নিঃসন্দেহে, আল্লাহ আমাদের হাত খালি ফিরিয়ে দেবেন না। আমাদের সামনে এটি এক বিরাট সুযোগ—নিজের গোনাহ মোচনের এবং জীবনকে সুখ ও শান্তিময় করার জন্য দুআ করার। আমাদের কামনা হওয়া উচিত যেন আমরা নবীদের দেখানো পথ অনুসরণ করে জীবন গঠন করতে পারি এবং মৃত্যুর পর জান্নাত লাভ করি।

মৃত্যুর জন্য চিন্তা-ভাবনা

বিশ্বাস করা হয়, এই মুহাররম মাসের ১০ তারিখেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। তাই আমাদের কর্তব্য, নিজেদের জীবনকে পর্যালোচনা করা—যেন হাশরের ময়দানে আমলনামা আমাদের ডান হাতে দেওয়া হয় এবং যেন আমরা আফসোস না করি। এইজন্য দরকার—আমরা নিজের হিসাব নিজে আগে করে নিই, নিজের অবস্থান ও আমল চিন্তা করি এবং সে অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হই।

কার কখন, কীভাবে মৃত্যু আসবে—তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সুতরাং এখন থেকেই ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। বিশেষত মুহাররম মাস এলে আরও মনোযোগ সহকারে রোজা, দুআ ও নফল ইবাদতে মশগুল হওয়া জরুরি।

বর্তমানে মুসলিমদের আচরণ

বর্তমানে অনেক ডিজিটাল যুগের মুসলিম এই বরকতময় মাসে যথাযথ আমল করতে পারছে না। বরং আগুন যেভাবে কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়, সেভাবেই তাদের কৃত গুনাহ এই মাসে তাদের আমলনামা থেকে নেক আমলগুলো মুছে দিচ্ছে। কারণ তারা শরিয়তবিরোধী ও ইসলামবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

তাজিয়ার মাধ্যমে শোক পালন

আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কাঠ, কাপড় ও অন্যান্য বস্তু দিয়ে গম্বুজ আকৃতির কাঠামো নির্মাণ করে—যা তাঁরা হজরত হুসাইন (রাঃ)-এর কবর বলে মনে করেন—সেই কাঠামোটি শোক প্রকাশের নামে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরান।

কিন্তু শরিয়তের দৃষ্টিতে এভাবে শোক পালন করার কোনো অনুমতি নেই। বরং এটা বিদ‘আত এবং গুনাহের কাজ।

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ৯০-এ বলেন:

“হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা ও ভাগ্য নির্ধারক তীর-সব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব, তোমরা এসব থেকে দূরে থাকো যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পারো”

এই আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাজিয়া বা শির্ক-বিদ‘আতের মতো কাজ থেকে দূরে থাকা মুমিনদের জন্য অপরিহার্য, কারণ এসব কাজে শয়তান আমাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করতে চায়।

শয়তান আমাদের প্রকৃত শত্রু—তাকে পরাজিত করতে হলে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।

লাঠিখেলা, মর্সিয়া ও নিজের শরীরে আঘাত করা

কিছু লোক আছেন, যাঁরা মুহাররম মাসে মর্সিয়া (কারবালার শোকগাথা নিয়ে রচিত কবিতা বা গান) পাঠ করেন এবং সেই পাঠের সময় বুক চাপড়ান, কেঁদে চিত্কার করেন, এমনকি কখনও নিজেদের শরীর কেটে রক্তপাত করেন। এই আচরণগুলো শিয়াদের সংস্কৃতি থেকে আগত, শরিয়তের দৃষ্টিতে যেগুলোর কোনো অনুমোদন নেই।

আমরা যদি তাদের মতো আচরণ করি, তবে কিয়ামতের দিনে তাদের সাথেই উঠতে হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

"যে ব্যক্তি শোক প্রকাশের জন্য নিজের শরীরে আঘাত করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।"

সুতরাং, এ ধরনের গর্হিত ও বিদ‘আতিপূর্ণ কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

উপসংহার

আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি অসীম দয়া করে মুহাররম মাসের মতো মর্যাদাসম্পন্ন একটি মাস দান করেছেন। কিন্তু আমরা অনেকেই এই মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন না করে শরিয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেদের জন্য গোনাহ জমা করছি।

ভেবে দেখা উচিত—আল্লাহ আমাদের কেন সৃষ্টি করেছেন? আমাদের জীবন কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত?

শয়তান সর্বদা ফাঁদ পেতে আমাদের পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। সে আমাদের প্রকাশ্য শত্রু—এ কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন। তাই আমাদেরও তার সাথে শত্রুতা বজায় রেখে সতর্ক থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে শয়তানের প্ররোচনা ও গোমরাহি থেকে হেফাজত করুন এবং এই পবিত্র মাসে উত্তম আমল করার তাওফিক দান করুন-আমীন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter