ফিলিস্তিনের দুর্দশা সম্পূর্ণ মনুষ্যতার ব্যর্থতা
দিনের আলো এবং রাতের অন্ধকারে, ইসরায়েলি নৃশংসতা ক্রমাগত গাজা, ফিলিস্তিনের জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। তবে, পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্ব নীরব। এক চোখে, এটা অনাক্রম্য, অন্য চোখে সন্ত্রাসবাদ। এই বাস্তবতা বর্তমান মুহূর্তে প্রমাণিত। প্রতিদিনের ভিত্তিতে, নারী ও শিশুসহ ফিলিস্তিনিদের ক্রোধের বোমাবর্ষণে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো কোনো বিশ্বশক্তি, কোনো দেশ, কোনো নামধারী মানবতাবাদী সংগঠন পর্যাপ্ত দায় নিয়ে নিপীড়ক ইসরাইলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। বরং তারা বিভিন্ন উপায়ে উগ্র ঔপনিবেশিকদের সমর্থন করছে।
ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে এই দখলকৃত ভূমির নিঃস্ব মানুষের গৃহীত কার্যক্রম জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিধানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মানে তারা রক্ষাহীন এবং অনুপ্রবেশকারীরা সমর্থিত, সুরক্ষিত। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার কি হারিয়ে গেছে? তাহলে ন্যায় মর্মের প্রকৃত ধারক কারা?
সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি হামলার সংখ্যা প্রচন্ড মানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে অমানবিকভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় ধসে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়া ফিলিস্তিনিদের নির্যাতিত ও বিকৃত মুখের ছবিই পুরো বিশ্ব দেখছে। বাস্তবে, এটি সমগ্র মানবতার বিকৃতি।
অবশই, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলিরও অস্বাভাবিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তে, ইসরায়েলি প্রশাসন গণহত্যা চালাচ্ছে। ৭ অগাস্ট প্যালেস্টাইন লড়াকু হামাসের আকস্মিক আক্রমণ মনে হচ্ছে যেন ইসরাইলকে এর ক্লিন চিট দিয়ে দিয়েছে। তাহলে এখানে যথা ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘর্ষক্রমে আসল অপরাধী কে?
আসল অপরাধী কে?
৭ অগাস্ট প্রভাতে হামাস অবোধপূর্বভাবে অপারেশন আল-আকসা তুফান আরম্ভ করে। সুত্র অনুসারে আক্রমণে হামাস প্রায় পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে, ইসরায়েলের আয়রন ডোম অ্যান্টি-মিসাইল প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়ে যায়, এমনকি ফিলিস্তিনি লড়াকু দক্ষিণ ইসরাইলে প্রবেশ করে সোজাসুজি মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায় এবং কিছুটা অঞ্চল নিজ দখলে নেওয়ার সাথে সাথে কয়েক সংখ্যক সৈন্যকে প্রতিভূ হিসেবে ধরে রাখে। কয়েক দশকে প্রথমবার এরকম দুর্দান্ত এক প্রতিরোধ আক্রমণ প্রত্যক্ষ করে।
এই মুহূর্তকেই যুদ্ধের আদ্যস্থল বলে ইসরাইল আত্মরক্ষার নামে পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করে। আজ (১৩ অক্টোবর) প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো, যুদ্ধের বিরতি নাই। ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু সংখ্যা দেড় হাজার পেরিয়ে তো ইসরাইলে এক হাজার তিনশত। পরিসংখ্যানে জনসাধারণ, বাচ্চা, মহিলা, সবাই অন্তর্গত। পাশাপাশি, বিশেষ করে গাজা শহর ধ্বংসস্তূপে ঢাকা পড়ছে। হামাসের নামে আবাসিক ভবন, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনবহুল বেসামরিক অঞ্চল ইসরায়েলি বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তুত।
কিন্তু প্যালেসটিন-ইসরাইল হেডলাইন্সগুলিতে রীতিমতো দৃষ্টি রাখলে দেখা যাবে যে মূল কারণ দীর্ঘ ঐতিহাসিক পাতায় ১৯৪৮ সালের আগেও গুঁজে আছে। এত দূরে না ঘুরে, সাম্প্রতিক বর্তমানেও খুঁজে যায়। আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুসারে: “কিন্তু এই অপারেশন সম্পর্কে কিছুই বিস্ময়কর বা অপ্রীতিকর নয়। এটাও ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকের ফল নয়। এটি এমন একটি প্রতিক্রিয়া যা ফিলিস্তিনি জনগণের কাছ থেকে প্রত্যাশিত, যারা কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ঔপনিবেশিক শাসন ও দখলদারিত্বের মুখোমুখি হয়েছে।”
প্রতিবেদনটির লেখক অধ্যাপক সোমদীপ সেন আরও লেখেন: “আন্তর্জাতিক আইন রাজ্যগুলিকে ‘যেকোন সামরিক দখল, যদিও অস্থায়ী’ থেকে নিষিদ্ধ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন ৩৭/৪৩ এছাড়াও নিশ্চিত করে যে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সংগ্রামরত মানুষদের ‘সশস্ত্র সংগ্রাম সহ সমস্ত উপলব্ধ উপায়’ ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে। অন্য কথায়, অপারেশন আল-আকসা তুফান ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও উপনিবেশবাদ দ্বারা উস্কে দেওয়া সশস্ত্র ফিলিস্তিনি সংগ্রামের অংশ।”
ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ধীরে ধীরে আসল স্থানীয়দের তাড়িয়ে ফিলিস্তিনকে তাদের নিজস্ব উপনিবেশে পরিণত করেছে। ফিলিস্তিন বলতে গেলে শুধু এখন ওয়েস্ট ব্যাংক আর গাজা ছাড়া আর সেরকম কিছুই বাকি নেই। তবুও আবার, এগুলো উন্মুক্ত কারাগারের মতো, আকাশ থেকে ইসরায়েলি বোমা বর্ষণের আশঙ্কা শেষ হয় না। ২০ লাখেরও বেশি জনসংখ্যা নিয়ে গাজা বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে পরিচিত। এখানকার অধিবাসীরা ইসরাইল প্রশাসনের করা নিরাপত্তা নজরদারিতে।
এমনকি ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভূমিতে চলাফেরার পর্যন্ত স্বাধীনতা নেই। তাদের বিভিন্ন ইসরায়েলি সামরিক চৌকি দিয়ে যেতে হয়। বিশ্বের সমস্ত সংস্থা এই বাস্তবতাকে জানে এবং বর্ণবাদ বলে ঘোষণা করে, কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছুই করে না। বিষণ্নতায় উত্তপ্ত হয়ে যখন ফিলিস্তিনের জনগন নিজেদের স্বার্থে কিছু প্রতিরোধ প্রদর্শন করে তখন তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে নিরস্ত করা হয়। পশ্চিমা শক্তির সমর্থনে ইসরাইল দিনের পর দিনের তার উপনিবেশিক অত্যাচার বাড়িয়ে যাচ্ছে। তাহলে আসল অপরাধী কে?
কেন এই পক্ষপাতিত্ব?
আসল অপরাধের পরিচয় পাওয়া গেলেও শাস্তি পাচ্ছে এই যুদ্ধে জনসংখ্যার নিপীড়িত অংশ - আরব-ফিলিস্তিনিরা। স্বাধীনতা ও ডেমোক্রেসির তথাকথিত প্রবক্তারা তাদের দ্বৈততার জন্য উন্মোচিত। আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশ ফিলিস্তিনি হেতু মুছে ফেলে সোজাসুজি ইসরাইলকে সমর্থন দেখাচ্ছে। এসব দেশের ইতিহাস যেহেতু কলোনিয়ালিজম বা ঔপনিবেশিকতার কালো রঙে রঞ্জিত তাই ইসরাইলের আধুনিক নিউকলোনিয়ালিজম বা নব্য উপনিবেশবাদকে উস্কিয়ে দিচ্ছে যাতে ইসরাইলের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বর্তমানে সক্রিয় থাকে।
তাছাড়া, প্যালেস্টাইন-ইসরাইল সংঘর্ষে সব থেকে বড় ভূমিকা রয়েছে জাতিবাদী পশ্চিমা শক্তির। ইউরোপে ইহুদিদের নরসংহারের পর যখন তারা আশ্রয়হীন, একমাত্র ফিলিস্তিনিই তাদের ঠাঁই দেয়। অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ব্রিটেন তাদের ভবিষ্যৎ রাজ্যের প্রতিশ্রুতিতে লেলিয়ে তোলে। ক্রমগতভাবে উদ্বাস্তু ইহুদিদের প্লাবন ফিলিস্তিনকে বয়ে নিয়ে যায়। ঘর বাহির হয়ে যায় স্থায়ী ফিলিস্তিনি মানুষ। বারবার প্রতিরোধশক্তি জন্ম নেয়। আর আজ পরিনিতি সবার চোখের সামনে। সাদা রঙের আবরণে পশ্চিমার এই কালো কৃতিত্বকে আরো উস্কানি দিচ্ছে অধিকাংশ মিডিয়ার সংস্থা।
তাহলে পুরো আরব বিশ্ব এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে কেন সংঘটিত হতে পারছে না? সোজা কথাই - এরাও ইউরোপের নব্য উপনিবেশবাদের ফাঁদ ফেঁসে আছে তথাকথিত শান্তি চুক্তি, বাণিজ্য চুক্তি, জাতীয়তাবাদ, ইত্যাদির আবরণে।
কোনো সম্ভাব্য সমাধান?
তিন ধর্মের পবিত্র স্থান জেরুসলামে। মানুষ চাইলে শহরটিকে শান্তির রাজধানী করে গড়ে তুলতে পারতো। কিন্তু, হ্যায়! যুগের পর যুগ ধরে বার বার ফিলিস্তিনিরা অত্যাচারের, রাজনীতির শিকার হয়েছে। অবশ্যই সেই পবিত্র মাটিতে শায়িত মহত্ব মনীষীরা তা দেখছেন, শুনছেন এবং হয়তো আরও সহ্যের উপদেশ দিচ্ছেন।
ইতিহাস খুলে দেখা যায় এই অস্থিরতার মধ্যেও কখন প্যালেস্টাইনের মাটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সালাহউদ্দিন আয়ুবির অধিনস্তে তিন ধর্ম যথা খ্রিষ্টান, ইহুদী এবং ইসলাম জেরুসালেমকে কেন্দ্র করে শান্তি এবং সহনশীলতার সাথে ইতিহাসের মধ্যে এক যুগেই ছিল। ধর্মীয় সম্প্রীতির এই স্বর্ণযুগ আবার কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বর্তমানে সে সুদূরের মনে হচ্ছে - নির্মম মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত পথিকের কাছে মরীচিকার মত।
বর্তমান সমাধান হচ্ছে যুদ্ধের নির্মমতাকে শেষ করে শান্তির নিশান মেলে ধরা। তবে এতে দুই পক্ষকেই অগ্রসর হতে হবে। শান্তির ছদ্মবেশে দুর্নীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট উস্কানিমূলক ক্ষমতার অবসান ঘটাতে হবে। একই সাথে, বিশ্ব শান্তিপ্রিয়দের মানবতার স্বার্থে নিরপেক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। ইসরায়েলকে তার ভূমি দখল বন্ধ করতে হবে, ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজস্ব মাতৃভূমি সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্বের সাথে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং পশ্চিমা শক্তিগুলি তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থের জন্য বিভাজন চক্রান্ত থেকে দূরে থাকতে হবে। যদি তা না হয়, জেরুজালেম কখনই রক্তপাত বন্ধ করবে না যতক্ষণ না ভাগ্যের প্রতিশ্রুতি সংঘটিত হয়।