উস্তাদ সিএচ হাইদ্রস মুসলিইয়ার: শিক্ষা সেবা ও আন্তরিকতার এক অমূল্য আদর্শ

রাস্তার ধারে আঙ্গুল দেখিয়ে যে কোন গাড়ি ধরে কখনও চলে যান দূর গন্তব্যে, কখনও আবার একলা কোন এক মসজিদ কোণে ঘুমিয়ে। স্বনামধন্য শহর বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করে গ্রামীন পাঠশালা নির্মাণে ব্যস্ত। সমস্ত কিছু ত্যাগ করে সমাজসেবা, শিক্ষা প্রসার ধর্ম প্রচার এবং মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে পরিবেশ যাত্রায়… সমাজ নির্মাণে নিবেদিত এই নিষ্কাম কর্মীর নাম হল উস্তাদ সিএচ হাইদ্রস মুসলিইয়ার যাকে কেরালীয় মুসলিম আজও হৃদয় কুটিরে বিশেষ জাগা দিয়ে রেখেছে। জনসাধারণ সম্মানার্থে এই মনের মানুষকে সিএচ ওস্তাদ বলে আখ্যায়িত করে থাকে।

  ২৯ রজব ১৩৪৯ হিজরী মোতাবেক ডিসেম্বর ১৯৩৩ সালে মালাপ্পুরাম জেলার পুথুপারাম্বে জন্মগ্রহণ করেন সিএচ উস্তাদ। তাঁর মাতা-পিতা যথাক্রমে বিখ্যাত ইসলামিক পণ্ডিত সমস্ত কেরালা জামিয়াতুল উলামার এক প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ মুসলিয়ার এবং ফত্বিমা হাজুম্মা যিনি ওস্তাদের জন্মের একদিন পরেই ইন্তেকাল করেন। পরিবার খুব ধর্মীয় আদর্শপূর্ণ ছিল যা স্পষ্টভাবে সিএচ উস্তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। বাল্যকাল থেকেই সমস্তা-এর সঙ্গে যুক্ত সমসাময়িক বিভিন্ন সমাজসেবী, শিক্ষাবিদ ও আলিম-উলামাদের সংস্পর্শ পান যার ফলে তিনি অত্যন্ত দূরদর্শিকতা অর্জন করেন।

শিক্ষা-যাত্রা

বাড়ি থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা পেলেও, উস্তাদের জ্ঞান অর্জনের তৃষ্ণা খুব বেশি ছিল। পুথুপারাম্ব, ক্লারি, চেরুর ইত্যাদি স্থান থেকে কেরালা মুসলমানের অনন্য শিক্ষাব্যবস্থা দারস কোর্স শেষ করার পর ১৯৫৩ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারতের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তামিলনাড়ুর ভেলোর শহরে অবস্থিত বাকিয়াতুস স্বালিহাত প্রবেশিকা গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে ১৯৫৫-এর মধ্যে স্নাতক হয়ে যান। তিনি পড়াশোনা অবসরে সময়ের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভ করেছেন।

শিক্ষা-সেবা

শিক্ষা-যাত্রা সমাপ্ত হলে শিক্ষা-সেবায় উস্তাদ নিজেকে নিযুক্ত করেন। প্রথমে বিভিন্ন পল্লী দরসে মুদাররিস হয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁর গুরুদ্বারে অনেক মহৎ ব্যক্তি গড়ে ওঠেন। পরে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে সম্পূর্ণরূপে মুসলিম সমাজ সেবায় নেমে পড়েন। এক্ষেত্রে, শিক্ষার সেবায় তিনি বিশেষ অবদান রেখে গেছেন।

  তিনি ১৯৮০-৯০-এর দিকে মহল্লা ফেডারেশনের কার্যক্রমে সক্রিয় হন। কোন পদের লোভ ছাড়াই, মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা সম্বল করার উদ্দেশ্যে ভীত্তিমূলক কাজে অগ্রগামী হয়ে থাকতেন উস্তাদ। সুন্নি ইয়ুথ গ্রুপ, মহল ফেডারেশন, এসকেএসএসএফ, রেঞ্জ জমিয়াতুল মুআল্লিমিন, মহল কমিটি জেনারেল বডি, ধর্মীয় খুতবা ইত্যাদিতে অংশ নেওয়া উস্তাদের স্বাভাবিক অনুশীলন ছিল।

এসব ছাড়া, ১৯৮৪ সালে ড. ইউ বাপুটি হাজী এবং এম এম বাশীর মুসলিয়ার সহ ভিত্তি স্থাপন রাখেন ভবিষ্যৎ মুসলিম শিক্ষা ব্যাবস্থার বিরল সংস্থা দারুল হুদা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি।

  সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমস্ত-এর সাপ্তাহিক পত্রিকায় গভীর মানের লেখা প্রকাশ করতেন যার মধ্যে শুধুমাত্র দেখা যায় মুসলিম সমাজ সংস্কারের নিরলস চেষ্টা।

দায়িত্ববদ্ধতা

সুন্নি যুবদল সমস্তা মুশাওয়ারা নামে পুনর্গঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। পানাক্কাতে অনুষ্ঠিত প্রথম আলোচনা সভা ছিল সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে একটি সাপ্তাহিক শুরু করা নিয়ে। সভাপতি সৈয়দ উমরালী শিহাব থাঙ্গল বলেন: সপ্তাহ শুরুর আগে এই উদ্দেশ্যে এক লাখ টাকা সংগ্রহ করা উচিত। পাঁচ হাজার গ্রাহক খুঁজে পাওয়া উচিত।

  উস্তাদ সিএইচ, যিনি সাধারণ সম্পাদক নিজে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওস্তাদ কোটাক্কল কেটি মানু মুসলিয়ার, এমকেএ কুঞ্জু মুহাম্মদ মুসলিয়ার সহযাত্রী ছিলেন তিরুর এবং চাওয়াক্কাদ এলাকায় দুই দিন ভ্রমণ করে অনুদান সংগ্রহ করেন। ফলস্বরুপ, সুন্নি আফকার সাপ্তাহিক সাধারণের সামনে প্রকাশ পায়।

উদ্দেশ্য আল্লাহ

মুসলমান-সমাজ-শিক্ষা ছিল তাদের সমস্ত চিন্তাভাবনার বিষয়। বহু সংস্থা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েও কোনদিন কোন পদের দাবী করেননি। আন্তরিকতার সঙ্গে নিরলস কাজ করে গেছেন। বাস্তব উদাহরণ দেখিয়ে গেছেন করে গেছেন যে আসল সমাজসেবকের পরিচয় কি? বারবার বিভিন্ন অবসরে বিশেষ পদের জন্য তিনার নাম নির্বাচিত হলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনুরূপ নিষ্কামকর্মী প্রাণপুরুষের ছায়াতলে কোন সমাজ কেন উন্নত হবে না? জোরপূর্বক, একবার সমস্ত কেরলের জন্য উপসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

  সমাজের সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করে পরিবারের সবাইকে একত্রিত করে নামাজ আদায় করা ছিল তাঁর অভ্যাস। উস্তাদ ছিলেন একজন নিখুঁত সুফি যিনি তাঁর পোশাক ও খাবারের সামান্যতম বিলাসিতাও পছন্দ করতেন না। তাঁর দৈনন্দিন পালনীয় কর্ম অভ্যাস ভ্রমণ বা অন্য কিছু দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতো না। ভ্রমণের মধ্যে যানবাহনের উপরও তিনার ঠোঁট জিকিরে চলাফেরা করতো। সিএইচ উস্তাদ সবকিছু আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা। তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে ছেলে তৈয়্যিব ফয়েজী, যিনি সে সময় বিদেশে ছিলেন, তাঁর আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। জবাবে তিনি বলেন: আমার উস্তাদ শায়খ আদম হযরত বাকিয়াতে আমাকে যে উপদেশ দিয়েছেন তা হল - মান কানা লিল্লাহি কানাল্লাহু লাহু। যথা ভাগ্যের উপর ভরসা রাখ।

মহত্বের স্বীকারোক্তি

নিষ্কামকর্মী এই সমাজ সেবক, সুফি ২৬ যুল-কা'দা ১৪১৪ সালে পার্থিব জগৎ পরিত্যাগ করেন। মানুষের মধ্যে রেখে গেছেন শিক্ষা, সেবা, খোদাভীরতার এক অমূল্য উদাহরণ।

  শায়খুনা শামসুল উলামা তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন: "শ্রদ্ধেয় সিএচ হাইড্রোস মুসলিয়ার আমার খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি একজন আলেম এবং মুজাবুদ্দুআ সুফি ছিলেন। আমার এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। আমি তাঁকে অনেকবার দুআর অনুরোধ করেছি। সাথে সাথে উত্তর পেয়েছি।"

(এই প্রবন্ধের কিছু অংশ ইসলাম_ওয়ান_ওয়েব মালায়ালামে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter