সংখ্যালঘু জনসংখ্যার ওপর ইএসি-র প্রতিবেদন এবং তার বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনা
সংখ্যালঘু জনসংখ্যার ওপর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিল (পিএম-ইএসি)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদদের হাতে বর্তমান নির্বাচন আবহাওয়ায় একটি মজার উপদ্রব্য হিসেবে তুলে দিয়েছে। মুসলমানরা বিজেপি মুখপত্র ও মন্তব্যে আবার মিথ্যা প্রপাগান্ডার লক্ষ্য হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র দেশের নির্বাচনে উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাদ দিয়ে মিথ্যা সংখ্যালঘু জনসংখ্যা শ্রুতি শুরু হয়েছে। আবারও এই দুর্ভাবনা স্থাপিত করা হচ্ছে যে ১৪.২% শতাংশ দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমান ৭৯.৮% (২০১৯ সেনসাস অনুসারে) নিয়ে গঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়কে অতিক্রম করতে যাচ্ছে। আর প্রজাতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যম এই প্রচারণা দাবানল ঝরে ছড়াচ্ছে।
তথ্য বিশ্লেষণ
১৬৭টি দেশে গত ছয় দশকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যার পরিবর্তনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ (PM-EAC) দ্বারা 'ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভাগ: এক আন্তঃদেশীয় বিশ্লেষণ (১৯৫০-২০১৫)' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়।
মুসলিম মিরর এই রিপোর্টের এক বিশ্লেষণে পেয়েছে - এই প্রতিবেদন আশ্চর্যভাবে দাবি করে যে ভারতের এই সময়ের মধ্যে মুসলমানদের জনসংখ্যার অংশ ৪৩.১৫% বৃদ্ধি, হিন্দুদের জনসংখ্যা ৭.৮২% হ্রাস পেয়েছে। ফলতঃ ১৯৫০ সালে যে হিন্দুদের জনসংখ্যায় অংশীদারিত্ব ছিল ৮৪.৫৮%, তা ২০১৫ সালে ৭৮.০৬%-এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে, জনসংখ্যায় মুসলমানদের অংশ ৯.৮৪% থেকে বেড়ে ১৪.০৯% হয়েছে।
অধ্যায়নে ক্রুটি
এই সরকারি অধ্যয়নে বিভিন্ন ত্রুটি রয়েছে যা লেখক ফাইজান আহমদ তাঁর ওই দ্যা হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যথেষ্ট বর্ণনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দশক প্রানো তথ্যের ভিত্তিতে অধ্যায়নটি রচিত; মুসলিম ছাড়াও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেরকম বুদ্ধ ধর্মাবলীদের হার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তা সেরকমভাবে উপস্থাপন করা হয়নি; হিন্দুর তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ উর্বরতা হার (Total Fertility Rate - TFR) হার্স পেয়েছে, ইত্যাদি তথ্য যথেষ্ট তুলে ধরা হয়নি যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং দেশের শান্ত পরিবেশে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়।
এক উদ্দেশ্যমূলক সারাংশ
সাংবিধান বিশেষজ্ঞ ফাইজান আহমদ আরও বলেন: প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যমূলক। তাছাড়া, কীভাবে ভারতের সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে মুসলমানরা একেবারে নিরাপদ এবং কোন প্রকার বৈষম্য বা নিপীড়নের সম্মুখীন হয় না তার উপস্থাপনাই হচ্ছে এই অধ্যয়নের সারাংশ।
কিন্তু জনসংখ্যার হার দেখে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের জীবন অবস্থা তুলনা করা ব্যাপক ভ্রম। অনেক সময় স্বল্প সদস্যের সংগঠনও বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর ভারী করে আবার কখনো কখনো তার বিপরীতও দেখা যায় হয়। বর্তমান সরকার মিথ্যার কৃতিত্ব দিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর বেড়ে যাওয়া অবিচার ঢাকবার চেষ্টা করছে।
উন্নয়নের পরামিতি?
অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ক্ষেত্রে দেশের সরকারকে বেশ কয়েক উন্নয়নের পরামিতি দেখা উচিত; সাম্প্রদায়িকতা নয়। যেমন তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং শিক্ষার দিকটা কত সচ্ছল? আরও কত কোন কোন ক্ষেত্রে বিকাশের প্রয়োজন? ক্ষমতা কাঠামোতে তাদের অংশগ্রহণ কেমন? কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনই রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়া মাধ্যমের এইসব আলোচনা বিষয় নয়। বরং, পুরাকথা এবং প্রপাগান্ডার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে জনসংখ্যার প্রশ্ন।
বিতর্কে মুসলমান
জনসংখ্যার আলোচনা যখন আসে, অপরিহার্য ভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মুসলিম জনসংখ্যার চর্চা। সাম্প্রদায়িকতার সমীকরণে গঠিত রাজনেতারা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর টানতে থাকে - জনসংখ্যা জিহাদ হেঁকে। জনসংখ্যার তুষ্টিকরণে তারা ভাষণ দেয়: মুসলমানরা নাকি এই সংগ্রামে হিন্দুদের পরাজিত করে দেশকে মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করবে। মুসলমানরা বহুবিবাহ এবং বহু সন্তান কর্মপন্থা নিয়ে চলছে। স্বয়ং দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই নোংরা রাজনীতিতে যুক্ত আছেন।
তবে এইসব অভিযোগ কোন তথ্য দিয়ে প্রমাণিত নয়; মিথ্যা আর হিংসার ওপর ভিত্তি। এইভাবে তারা কোন এক সাম্প্রদায়কে নয় বরং দেশের সমগ্র নাগরিককে বিভ্রান্ত করছে। আসলে জন জন দেশের এক এক অমূল্য রত্ন, যদি একে যথাযথ যত্ন করা হয়।