মহারাষ্ট্রে মসজিদ ভাংচুর; ধর্মীয় বিদ্বেষের আরেকটি নমুনা

প্রেক্ষাপট:

ভারতের মতো এক বৈচিত্রময় এবং নানা সংস্কৃতির এই দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণগুলির উদ্বেগজনক বৃদ্ধি দেখা দিচ্ছে। ১৯৯২ সালে ৬০০ বছর পুরোনো বাবরি মসজিদকে রাম জন্মভূমীতে স্থাপিত করার অভিযোগে তা সহিংসভাবে ধ্বংস করা হয় এবং অবশেষে সেখানে এই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে রাম মন্দিরের উদ্বোধন করা হয়। জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে এখন আরো একটি কেস চলছে এবং ব্রাহ্মসমাজের দাবি যে সেখানে এক মন্দির ছিল যা ভেঙে উক্ত মসজিদটি বানানো হয়।  ইহবছরের নির্বাচনের অভিযানে আসামের মুখমন্ত্রী ভোট সমর্থনের নিমিত্তে এই ইস্যুকেও তুলে ধরে বলেন যে বিজেপি কে ৪০০ টি সিট্ আপনারা দিন আমরা আপনাদের জন্য জ্ঞানবাপীর মসিজদ হটিয়ে মন্দির বানিয়ে  দেব।  

দেশে ধর্মের অপব্যবহার:

২০১৭'র রাজস্থানের পেহলু  খান এর উপর অত্যাচার থেকে নিয়ে ২০১৯ এর তাবরেজ আনসারীর উপর নির্মম অত্যাচারের দৃশ্যগুলি ভারতের ধর্মীয় বিদ্বেষের এক হিংস্র প্রকৃতির পরিচয়ই দেয়। সত্যি বলতে ভারত হচ্ছে এমন এক দেশ যে দেশে আজকের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্ম এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  মুসলিম সমাজকে সংখ্যালঘু ভেবে তাদের উপরে বিভিন্ন ধরণের অত্যাচার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চালানো হয়।  ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা হয় এমন দেশের এক প্রকাশ্য এবং উদীয়মান দেশ হলো আমাদেরই ভারতবর্ষ। এমনকি গত বছর উত্তর প্রদেশের হালাল ব্র্যান্ডিং এর দোকানগুলি কে বেআইনি ঘোষিত করা হয়।  এসব ষড়যন্ত্রের পিছনে তাদের একটাই উদ্বেগ ছিল এবং তা হলো মুসলিম পুঁজিবাদীদের বিনাশ। কোনো দেশের রাজনীতি এতটাও খারাপ এবং নির্লজ্জ হতে পারে তা আমাদের কল্পনাতীত। মুসলিম অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে এদের ষড়যন্ত্র এতটাই নিচ যে এরা এতেও ধর্মকে টেনে আনে। 

মুসলিম পুঁজিবাদীকে পঙ্গু করার প্রয়াস:

গত সপ্তাহে উত্তর প্রদেশে কন্বর যাত্রা তে যোগী আদিত্যনাথ একটি সার্কুলার জারি করেন যে প্রতিটি মন্দিরের সামনে যতগুলি দোকান রয়েছে সবগুলির সামনে মালিকের নাম লিখতে এবং তা থেকে যতগুলি মুসলিম দোকান থাকে সবগুলিকে উঠিয়ে ফেলা হয়।  এর কারণ জানতে চাইলে বলা হয় যে মুসলমানরা খাবারে থুতু ফেলে যাতে খাবারের পবিত্রতা নষ্ট হয়।  যদিও এই সংক্রান্তে একটি সত্যি ঘটনা আছে যে মীরাট এ সোহাইল নাম এক ব্যাক্তি রুটিতে থুতু করতে দেখা যায়।  কিন্তু এটার মানে এই হয়না যে পুরো মুসলিম সমাজ রুটিতে থুতু ফেলে।  আর যদি এমনটাই হতো তাহলে এরকম হিন্দুদের ও অনেক রিপোর্ট রয়েছে যা সাংঘাতিকভাবে অপবিত্র। যেমন গত মার্চ মাসের ১৪ তারিখ কালুরাম কুঁৱৰীয়া নামের এক ব্যাক্তি তেলেঙ্গানায় আইস ক্রিম এ হস্তমৈথুন করতে দেখা যায় যা ক্যামেরায় ধরা পড়ে।  ২০১৭ সালে ৯ ফেব্রুয়ারী চেতন মারবাদী নামক এক ব্যাক্তি ফুচকা তে টয়লেট ক্লিনার এর কেমিকাল ব্যবহার করতে দেখা যায়।  ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে রাজদেব লক্ষণ চৌহান নামের এক হিন্দু ব্যাক্তি পানিপুরির লোটাতে মূত্রত্যাগ করতে দেখা যায়।  এদের সবাইকেই ফুড সেফটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট গ্রেফতার করে।  এতজন হিন্দু ব্যাক্তি এরকম জঘন্য কাজ করা সত্ত্বেও আমি এবং আমার মতো লক্ষ্য লক্ষ্য ভারতীয় মুসলিম এটা মানিনা যে সব হিন্দুই এরকম করে থাকে। তাদের জন্য আমি আমার এই মেসেজ দিতে চাই যে মুসলিম সমাজ শুধু আতঙ্কবাদী হয়না, বরং আমি এবং আমার মতো এমন অনেক মুসলমান আছে যারা আমাদের সমবয়স্ক এবং বয়ঃকনিষ্ঠ হিন্দুদের নিজের ভাই মানি এবং বয়জোষ্ঠদের গুরুজন মানি।  

বেআইনি মুসলিম যুবহত্যা:

২০১৩'র মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গায় অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী ৬০ জনের মৃত্যু হয় এবং ৫০,০০০ এর বেশি মানুষ গুরুতরভাবে জখম হয় যাদের অধিকাংশ ছিল মুসলিম।  এবং তাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়।  উক্ত ঘটনায় শাহনাওয়াজ কুরেশী নামক এক মুসলমান ব্যাক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ২০১৭'র এপ্রিল মাসে হরিয়ানার দুগ্ধখামারি পেহলু খান রাজস্থানে গবাদি পশু পরিবহন করাকালীন  গরু পাচারের অভিযোগে হিন্দুত্ববাদী গোরক্ষকরা তার উপর হামলা চালায়। বৈধ নথিপত্র না থাকা সত্বেও তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয় যার কারণে সে মারা যায়।  তার মার্ডার কেস এর তদন্তটি বিলম্ব এবং অসঙ্গতির শিকার হয় যার কারণে অবশেষে অভিযুক্তদের প্রমানের অভাবে বেল দিয়ে দেয়া হয়।  ২০১৯ সালের জুন মাসে তাবরেজ আনসারী, এক ২৪ বছর বয়সী মুসলিম যুবক কে ঝাড়খণ্ডে একদল হিন্দু গোষ্ঠী দ্বারা নির্মমভাবে আক্রমণ করা হয়।  তাকে চুরির অভিযোগে গাছে বাধা হয়, ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে পেটানো হয় এবং জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা হয়। গুরুতর আহত হওয়া সত্ত্বেও, তাকে অবিলম্বে চিকিৎসা না দিয়ে পুলিশ হেফাজতে দেয়া হয়।  চার দিন পরে গুরুতর আঘাতের চোটে সে মারা যায়। এই ঘটনাটি ভিডিওতে ধরা পড়ে এবং সারাদেশে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং ভারতে জনতা হত্যার সমস্যাটির উপর আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে।  

মহারাষ্ট্রে মসজিদ ভাংচুর:

মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর জেলায়, ঐতিহাসিক বিশালগড় দুর্গকে "অধিগ্রহণ" থেকে মুক্ত করার জন্য হিন্দু ডানপন্থী দলগুলির মাসব্যাপী প্রচারাভিযান রবিবার হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং একটি হিন্দুত্ববাদী জনতা মুসলমানদের একটি মসজিদ, বাড়িঘর এবং দোকান ভাংচুর করে ফেলে। সম্ভাজিরাজে ছত্রপতি, প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ এবং ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের বংশধর, হাজার হাজার সমর্থকের সাথে দুর্গের দিকে যাত্রা করছিলেন যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রকাশ করে। সকাল 9:40 টার দিকে সম্ভাজিরাজের দুর্গে আগমনের আগে, সমর্থকরা মসজিদে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে এবং আশেপাশের স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দাদের উপর হামলা চালায়।

মসজিদটি বিশালগড়ের পথে ছিল কিন্তু দুর্গ থেকে 6 কিমি দূরে, এবং দুর্গের জমিতে এর অবস্থানের দাবিগুলি ছিল উদ্ভট এবং জাল, স্থানীয়দের অভিযোগ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলাটি পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটেছে, ভিডিওগুলিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী জনতাকে থামাতে বিশাল মোতায়েনের দাবি সত্ত্বেও জায়গাটি পাহারা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত কয়েকজন পুলিশ কর্মীকে নীরবে সেই সহিংসতা দেখতে দেখা যায়। অত্রদিবসেই বিকেলে হিন্দুত্ববাদীরা গাজাপুরে মুসলমানদের বাড়িতে হামলা অব্যাহত রাখে। একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেখানে কোনও পুলিশ ছিল না। 

অথচ এদিকে, মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলিকে আশ্বাস দিয়েছেন যে তারা সোমবার কাঠামোগুলি ভেঙে ফেলবে, রিপোর্টে বলা হয়েছে। গত বছর, জেলা প্রশাসন দুর্গের একটি জরিপ চালিয়েছে এবং দাবি করেছে যে তারা একটি মসজিদ, বাড়ি এবং দোকান সহ 160টি ভবন খুঁজে পেয়েছে, যা অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। এ ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ৪০ জন মুসলমান হামলার শিকার হয়েছেন।

এআইএমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এমপি মহারাষ্ট্রের মহাযুতি সরকারকে আক্রমণ করেছেন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতোই। ওয়াইসি তার অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি শেয়ার করেছেন এবং বলেছেন, “6 December continues” @mieknathshinde @Dev_Fadnavis  under your government a Masjid is attacked by a Mob, this is an attack on Rule of Law but your government is not concerned.” 

উপসংহার:

ভারত একটি বহু-ধর্মীয় এবং বহু-সাংস্কৃতিক দেশ, অথচ আজকের এই সময়ে ধর্মীয় সহিংসতা একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি, মসজিদ ধ্বংস, ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।এই সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্য কেন্দ্র এবং জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশাসনকে ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি আরোপ করতে হবে। বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে।এই ব্যাপারটি বিদ্রূপজনক কে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা নিজেই বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। তাই রাজনৈতিক নেতাদের ধর্মীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্মীয় বিদ্বেষকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা উচিত। এই ধরণের ঘটনাগুলি লাঘব করতে স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে আমার মনে হয়। এছাড়াও গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক সংহতি বাড়ানো যেতে পারে। ধর্মীয় বিদ্বেষ লাঘব করতে এবং মসজিদ ধ্বংসের মতো ঘটনা প্রতিরোধ করতে একটি সমন্বিত ও বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। আইন প্রণয়ন, শিক্ষা, সংলাপ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে একটি শান্তিপূর্ণ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

References: 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter