হজরত নুহ (আঃ) ও মহাপ্লাবন

আল্লাহ পাক হজরত আদম (আঃ)-এর প্রায় এক হাজার বছর পর হজরত নুহ (আঃ)-কে প্রেরণ করেন। ইসলামের দায়িত্ব নিয়ে ইরাক প্রদেশে দিজিলা ও ফুরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে তিনি অবতীর্ণ হন। তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুল গফফার বিন মালিক। কিন্তু তিনি কুরাআনের মধ্যে নুহ নামেই অভিহিত। নুহ কথার অর্থ ক্রন্দ্রন। তাঁর সময়ে মহাপ্লাবনে আপন স্ত্রী, পুত্র সহ প্রায় অধিকাংশ আত্মীয় মারা যায়। তাদের দুর্ভাগ্য দেখে এত কেঁদেছিলেন যে আল্লাহ পাক তাঁকে নুহ নামেই অভিহিত করেন।

চল্লিশ বছর বয়সে রমজান মাসে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। তার পর থেকে দ্বীনের দাওয়াত দেন প্রায় নয়শত পঞ্চাশ বছর। কিন্তু মানুষ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি, বরং নবী হিসাবে মানতে অস্বীকার করল। তারা বলতে লাগল তুমি তো  আমাদের মতই মানুষ, আমাদের মত খাও, আমাদের মত পান কর, আমাদের মত ঘুমাও তবে কেমন করে নবী হলে। নুহ (আঃ) বলেন: হে আমার জাতি! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করোনা। তোমরা যদি আল্লাহ কে মানতে অস্বীকার করো তাহলে আল্লাহর আজাব তোমাদের উপর আসতে থাকবে। আমি তোমাদের কাছে কিছু চায়না শুধু তোমাদের মুক্তির জন্য সতর্ক করছি।

এসব কথা শোনার পর তারা আরও রেগে যায় এবং অত্যাচার শুরু করে। কখনো তিনি অচেতন হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে আবার দুয়া করেন: হে আল্লাহ, আমার কওম জানেনা তাদের ক্ষমা করে দাও। তার কওমের লোকেরা  বলল: হে নুহ আপনি অযথা আমাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করছেন। আপনি যদি প্রকৃত সত্যবাদী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার আজাব নিয়ে আসেন। হজরত নুহ (আঃ) আল্লাহর সাহায্য চান। আল্লাহ বললেন: হে নুহ! তুমি চিন্তা করোনা। পাপিষ্ঠরা নিশ্চয় বন্যার আজাবে ডুবে মারা যাবে। তুমি নিজেকে এবং তোমার সাথীদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি নৌকা তৈরি করো।

হজরত নুহ (আঃ) নৌকা বানাতে শুরু করলেন। তাঁকে নৌকা তৈরি করতে দেখে তাঁর জাতিরা বিদ্রুপ করতে লাগে: হে নুহ! তোমার এই নৌকা কোথায় চলবে? সমুদ্রে নাকি মরুভূমিতে? কিন্তু নুহ (আঃ) তাদের কথায় কান না দিয়ে নৌকা তৈরি করতে লাগলেন। নৌকা তৈরি শেষ হল। নৌকাটি ছিল তিন তলা বিশিষ্ট। একতলাই পক্ষীকুল, একতলাই জন্তু-জানোয়ার, একতলাই নুহ (আঃ) এবং তাঁর সাথীগণ।

আল্লাহ বললেন: হে নুহ আপনি পৃথিবীর সমস্ত বস্তু, প্রাণী এবং আপনার অনুগামীদের জোরায় জোরায় নৌকাই তুলে নিন, যাতে মহাপ্লাবনের পর আবার তারা বংশ বিস্তার করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। তার সাথে সাথে দুয়াও শিখিয়ে দিলেন।

بسم الله مجريها ومرسها إن ربي لغفور رحيم

অতঃপর তিনি পক্ষী, সমস্ত জন্তু-জানোয়ার, কীটপতঙ্গ, বীজ, ঘাস, ফল-ফসল সব কিছুই জোড়া জোড়া তুলে নিলেন। আল্লাহ আলামত হিসাবে জানিয়ে দিলেন যে, যখন রুটি বানানো উনুন থেকে পানি বাহির হবে তখনই মহাপ্লাবনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। একদিন দেখা গেল, তার গৃহতেই উনুন থেকে গরম পানি বের হতে থাকল। নুহ (আঃ)-এর স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাকে খবর দিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ জিনিসপত্র তুলে প্রস্তুত হতে থাকলেন।

শুরু হল আল্লাহর আজাব। চতুর্দিক থেকে পানি আসতে শুরু করে। এমনকি সমস্ত অঞ্চলের জমিন ফেটে পানি বের হতে লাগল। বিশ্বজুড়ে শুধু মহাপ্লাবন। আকাশ থেকে বর্ষণ শুরু হল।

পৃথিবীর সমস্ত গাছপালা, ঘরবাড়ি পানির তলায় ডুবে গেল। একমাত্র নুহ নবীর নৌকা ভাসমান। নুহ নবীর তিন পুত্র - সাম, হাম, ইয়াফিস নৌকায় চড়লেও অপর পুত্র কিনাআন দাম্ভিকতার কারণে নৌকায় চড়লোনা। নুহ (আঃ) তার পুত্র কে আহ্বান করে বললেন: হে আমার পুত্র নৌকায় আরোহণ করো। এছাড়া আর রক্ষাকর্তা কেউ নেয়।

ونادى نوح ابنه وكان في معذل يبنى اركب معنا و لا تكن مع الكافرين

অর্থ-  নুহ (আঃ) তার পুত্রকে ডেকে বললেন: হে পুত্র! আমার সাথে নৌকাই উঠে এসো কাফেরদের সাথে থেকো না।

কিনাআন উত্তরে বললেনঃ  

سأوى إلى جبل يعصمنى من الماء

আমি কোনও উঁচু পাহাড়ে আশ্রয় নেব, সে আমাকে প্লাবন থেকে বাঁচাবে। অর্থাৎ প্লাবনের পানি পাহাড়ের উপর পর্যন্ত যাবেনা না বলেই মনে করছিল।

সঙ্গে সঙ্গে নুহ (আঃ) বললেন: হে আমার পুত্র! আজ আর এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু কিনাআন তার অহংকারে ভর করেই সে কথা অস্বীকার করে এবং পাহাড়ে আরোহণ করতে লাগল। প্লাবনের পানি বাড়তে লাগল। নৌকা ভাসতে লাগল পাশাপাশি পর্বতে কিনাআনও উঠতে লাগল। কিনাআনের করুণ অবস্থা দেখে পিতা নুহ (আঃ) আকাশের প্রতি মুখ তুলে বলতে থাকেন: হে আমার প্রতিপালক! আপনি তো প্রতিশুতি দিয়েছেন যে আমার পরিবারসমূহকে ধ্বংস করবেন না। কিনাআন আমার পুত্র। হয়তো এখুনি পানিতে পড়ে মারা যাবে। এ কথা শুনে আল্লাহ পাক নুহ (আঃ)-কে সতর্ক করে বললেন: হে নুহ (আঃ)! সে তোমার জন্ম দেওয়া সন্তান হলেও ঈমানের ভিক্তিতে সে তোমার থেকে পুরো আলাদা। সুতরাং সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। তার জন্য তুমি এমন প্রার্থনা আমার কাছে করোনা। এরুপ অবস্থায় বিরাট একটি ঢেউ এসে কিনাআনকে ভাসিয়ে দেয়।

আল্লাহর কাছ থেকে সতর্ক বার্তা পাওয়ার পর নুহ (আঃ) আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। অবশেষে ১০ মুহররম সারা বিশ্বকে ধ্বংস করার পর প্লাবন বন্ধ হল। নুহ (আঃ)-এর নৌকা জু'দি (সিরিয়া) পর্বতের উপর অবতীর্ণ হল। নুহ (আঃ) এবং সহচরবৃন্দ, নৌকার অন্যান্য পশুপাখি মিলে আবার পৃথিবীর বুকে বসবাস শুরু করে। মহাপ্লাবনে নৌকাটি রজব মাসের ২ তারিখ থেকে মুহররম মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত মোট ৬ মাস ৮ দিন ভেসেছিল। 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter