নেতৃত্বহীনতা, আসাবিয়্যাহ ও আত্মবিস্মৃতি: ফিলিস্তিন-ইরান সংকটে মুসলিম বিশ্বের নীরবতা
ভূমিকা: মুসলিম জাতির অতীত ঐক্য ও বর্তমান দুর্বলতা
ইসলামের ইতিহাসের সূচনালগ্নে মুসলিম জাতি একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে উদিত হয়েছিল। নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর জামানায় সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এমন সহযোগিতা, সহানুভূতি ও ত্যাগের চিত্র ছিল যা আজ কল্পনাতীত। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই ঐক্য আজ অতীতের একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে গেছে। রাজনৈতিক স্বার্থ, জাতিগত বিভাজন, সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব এবং ঈমানি দুর্বলতা আমাদের এমন একটি জায়গায় এনে ফেলেছে, যেখানে এক মুসলিম দেশের উপর অন্য একটি মুসলিম দেশের হামলা ঘটে গেলেও আমরা নিরব থাকি। ফিলিস্তিনের উপর চলমান ইসরায়েলি নিপীড়ন আর সাম্প্রতিক ইরানের পাশে না দাঁড়ানোর ঘটনায় আমরা এই করুণ বাস্তবতার পুনরায় মুখোমুখি হচ্ছি।
ফিলিস্তিন: দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কাহিনী
বিশ্ব সাক্ষী রয়েছে যে, ইসরায়েল বহু দশক ধরে ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর দখল, জ্বালাতন, অত্যাচার, হত্যা, বোমাবর্ষণ ও ধর্মীয় নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। তাদের মূল লক্ষ্য শুধুমাত্র জমি নয়, বরং মুসলিমদের আত্মমর্যাদা ও কিবলাতুল উলা নামে সুপরিচিত আল-আকসা মসজিদ। দিবারাত্রি শিশুরা নিহত হচ্ছে, হাসপাতাল ধ্বংস হচ্ছে, এবং মসজিদে নামাজরত মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা ফেলা হচ্ছে যার বিভৎস দৃশ্য সম্বন্ধে বলা শব্দের ও চিন্তার বা ভাবনার বাইরে। ফিলিস্তিন মুসলমানদের জন্য কেবল একটি ভূখণ্ড নয়; এটি ঈমান ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা। অথচ যুগের পর যুগ ধরে এই ভূমিকে দখল করে রেখেছে দখলদার ইসরায়েল, যারা অবিচার, হত্যা, নারকীয় আগ্রাসন ও জাতিগত নিধনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। অনেক মুসলিম দেশ মুখে ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেও কার্যত কেউই তাদের রক্ষা করতে সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়নি। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি আগ্রাসন, গাজায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ, শিশু হত্যাকাণ্ড, হাসপাতাল ধ্বংস, এসব ঘটনার প্রতিবাদে মুসলিম উম্মাহর কার্যকর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
অপরদিকে ইরান, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি শক্তিশালী ও সুপরিচিত রাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরায়েলি প্রভাবিত জোটের বৈরিতার শিকার। শিয়া-সুন্নি ভেদাভেদের বাইরে গিয়ে আজকের বাস্তবতায়, ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো ইরানকে একটি ‘বিপদ’ বলে মনে করছে শুধুমাত্র তাদের মুসলিম পরিচয় ও প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতি।
ইরানের পদক্ষেপ ও মুসলিম বিশ্বের নীরবতা :
২০২৫ সালের জুন মাসে যখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা চালানো হলো, তখন সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো একটি সত্যের দিকে—ইরান, শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাষ্ট্র, সে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনে অগ্রগামী থেকেছে। তারা হামাস ও গাজায় মুসলমানদের পক্ষে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় থেকেছে। অথচ বেশিরভাগ সুন্নি মুসলিম দেশ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কেবল বিবৃতি দিয়ে দায়সারা করছে। এমনকি অনেকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করছে। এই নীরবতা আমাদের ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের প্রশ্নকে কাঁপিয়ে তোলে।
হারামাইন শরীফাইনের অভিভাবকদের নীরবতা—এক নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা
যখন গাজা রক্তে ভাসছে, যখন ইরানের বিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়, তখন তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব—বিশেষ করে সৌদি আরব—এর নীরবতা কেবল লজ্জাজনক নয়, বরং একধরনের সহযোগিতাও।
“হারামাইন শরীফাইনের খাদেম” নামধারী এই রাষ্ট্র বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে, তাদের আনুগত্য মুসলিম উম্মাহর প্রতি নয়, বরং সেই শক্তিগুলোর প্রতি—যারা দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে, বিভাজন উস্কে দিচ্ছে এবং মুসলিম ভূখণ্ডকে পদদলিত করছে। কোথায় তাদের ক্ষোভ, যখন আল-আকসা মসজিদে হামলা হয়, ফিলিস্তিনিদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, ইরানিদের নিশানা করে ড্রোন চালানো হয়, আর মুসলিম জমিনে আগ্রাসী শক্তির দাপট চলে?
সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা বিশ্ব মঞ্চে তাদের প্রভাবশালী পরিচয় নিয়ে অহংকার করে, অথচ যখন সত্যিকারভাবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সময় আসে, তখন তারা কেবল বিবৃতি পড়ে বা একেবারে চুপ করে থাকে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়, অথচ গাজার আকাশে ছোড়া বোমা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই, ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের প্রতিবাদ নেই।
তাদের এই নীরবতা কাপুরুষতারই ছায়া। তাদের নিষ্ক্রিয়তা কূটনীতি নয়, এটা মর্যাদার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ। এই শাসকগোষ্ঠী মুসলিম জাতির দুর্দশার দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছে—ন্যায় ও নৈতিকতার পরিবর্তে কেবল রাজনৈতিক সুবিধা হিসাব করে চলেছে। একের পর এক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি, দখলদারদের সঙ্গে হাসিমুখে করমর্দন, যুদ্ধাপরাধীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা—সবই একটি জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ।
এটা বলার সময় এসেছে: এটি এক ভয়ঙ্কর নৈতিক ব্যর্থতা। যদি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানেরা ফিলিস্তিনের জন্য না দাঁড়ান, যদি তারা ইরানকে অপমানিত ও প্রতিরোধকে অপরাধ বানানোর বিরুদ্ধে কথা না বলেন, তবে তাদের বুঝে নিতে হবে—ইতিহাস তাদের এই নীরবতাকে নিরপেক্ষতা নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই মনে রাখবে।
মুসলিম জাহান এর চেয়ে দৃঢ় ও সৎ নেতৃত্বের দাবিদার। যতদিন না এই তথাকথিত শাসকরা জেগে উঠছেন, ততদিন সাধারণ মুসলমানরাই—গণমানুষ—উঠে দাঁড়াতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে, সংগঠিত হতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ, এক স্পর্ধাহীন নেতৃত্বে উম্মাহর আত্মা বাঁচতে পারে না।
ভ্রাতৃত্ববোধের চরম সংকট :
আজকের মুসলিম সমাজে উম্মাহবোধ হারিয়ে গেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। যখন আমরা দেখি যে এক দেশের মুসলমান বিপদে থাকলেও অন্য দেশের মুসলমান কেবল "আমার দেশ নয়" বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, তখন বোঝা যায় আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ কতটা ভঙ্গুর। ইসলাম যে উম্মাহর ধারণা দিয়েছে, সেই "كل المسلم على المسلم حرام دمه وماله وعرضه"— এর বাস্তব প্রতিফলন আজ কোথাও নেই। ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, সুদান—প্রতিটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডেই মুসলমান মুসলমানের পাশে দাঁড়ানোর বদলে রাজনীতি, মতবাদ বা জাতিগত ভেদাভেদকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
এই বিভক্তির মূল কারণগুলো বহুস্তরীয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
১. রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বিভক্তি
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সংকট রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও ভেতরগত বিভক্তি। বেশিরভাগ মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজতন্ত্র স্বৈরাচারী চরিত্রের। তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এসব শাসকগোষ্ঠী পশ্চিমা আগ্রাসী শক্তির ইশারায় চলে, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার বিনিময়ে নিজেদের রাজত্ব কায়েম রাখে। এ কারণে যখন ফিলিস্তিন বা ইরানে মুসলিমদের উপর আগ্রাসন হয়, তখন এরা মুখ খোলে না। তাদের নীরবতা মূলত অপরাধে মৌন সম্মতির নামান্তর। কেউ কেউ আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে মুসলিম উম্মাহর ঐতিহাসিক রক্তপাতকে উপেক্ষা করছে। এমন নেতৃত্ব কখনোই একটি ঐক্যবদ্ধ, মর্যাদাবান ও প্রতিরোধশীল মুসলিম জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারে না। মুসলিম সমাজের উচিত এসব শাসকদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল, সাহসী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া।
২. জাতীয়তাবাদ ও গোঁড়ামি
ইসলাম মানুষের জাতি, ভাষা, বর্ণ—এসব পার্থক্যকে অতিক্রম করে একটি ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর শিক্ষা দেয়। কিন্তু আজ মুসলিম বিশ্বে “আসাবিয়্যাহ” বা অন্ধ জাতিগত অহংকার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কেউ নিজেকে আরব, কেউ পার্সিয়ান, কেউ তুর্কি বা বাঙালি পরিচয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ইসলাম যেখানে বলেছে “ইন্নামা আল-মু’মিনূনা ইখওয়াহ”—সব মুসলমান ভাই ভাই, সেখানে আজ এসব পরিচয় দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা শক্তিগুলোও সচেতনভাবে মুসলিমদের মধ্যে এই বিভাজন জিইয়ে রেখেছে। ফলে ফিলিস্তিন বা কাশ্মীরে মুসলিম হত্যা হলেও অনেক মুসলিম দেশ তাতে নির্বিকার থাকে, কারণ ভুক্তভোগীরা “তাদের জাতির লোক নয়”। এই গোঁড়ামি মুসলিম ঐক্যের পথে প্রধান বাধা। ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলায় উম্মাহর ভ্রাতৃত্ববোধ ফিরিয়ে আনা না গেলে, মুসলিম বিশ্ব কেবল সংখ্যায় বড় হলেও কার্যত দুর্বলই থেকে যাবে।
৩. জ্ঞানচর্চা ও দ্বীনি নেতৃত্বের দুর্বলতা
মুসলিম সমাজে একসময় এমন আলেম, চিন্তাবিদ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যারা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক নির্দেশনা দিতেন। আজ সেই ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়েছে। বহু আলেম ক্ষমতাসীনদের হাতের পুতুল হয়ে গেছেন, আর চিন্তাবিদরা জাতিকে নিছক তত্ত্বে বিভোর রেখে বাস্তব প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হচ্ছেন। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো "আল-আমরু বিল মা'রুফ ওয়ান্ নাহি 'আনিল মুনকার"—ভালো কাজে আদেশ ও মন্দে নিষেধ করা। আজ সেই দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। দ্বীনি নেতৃত্ব যদি নিরপেক্ষ, সাহসী ও চিন্তাশীল না হয়, তবে তারা কখনোই উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে না। এক নতুন প্রজন্মের আলেম ও চিন্তাবিদ দরকার, যারা আধুনিক জ্ঞান ও দ্বীনি বোধ নিয়ে মুসলিম সমাজকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম হবেন।
৪. ঈমানি জাগরণ ও তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্য
ঐক্যের ভিত্তি কখনো কেবল ভাষা বা ভূখণ্ড হতে পারে না। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, আসল ভিত্তি হলো তাওহীদ—একক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য। আজ মুসলিম সমাজে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। আল্লাহর ভয় নেই, আখিরাতের চিন্তা নেই—যার ফলে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো কেবল জাগতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। তাওহীদি দৃষ্টিভঙ্গি ফিরিয়ে আনতে না পারলে ঐক্য কখনো স্থায়ী হবে না। মুসলমানদের নিজেদের পরিচয়, দায়িত্ব ও দুনিয়ার উদ্দেশ্যকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে ঈমানের আলোকে। একমাত্র তাওহীদই এমন একটি ছায়া দিতে পারে, যেখানে জাতিগত-ভাষাগত ভেদাভেদ বিলীন হয়ে উম্মাহ এক ছাতার নিচে আসতে পারে। ঈমানি জাগরণ ছাড়া রাজনৈতিক বা সামরিক শক্তি অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৫. উম্মাহবোধের চর্চা পরিবার ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
একজন মুসলমান যখন জন্ম নেয়, তখনই তাকে শেখাতে হবে—সে কেবল পাকিস্তানি, সৌদি, ইরানি, বা বাংলাদেশি নয়—সে একজন মুসলমান, এবং তার পরিচয় পুরো উম্মাহর সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু আজ পরিবার, স্কুল-কলেজ ও মিডিয়া এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণতা শিক্ষিত হচ্ছে, উম্মাহবোধ নয়। ইতিহাস, সাহিত্য ও ধর্মশিক্ষায় উম্মাহর ঐক্য ও সংগ্রামের কথা থাকছে না। এই কারণে মুসলিম যুবসমাজ আন্তর্জাতিক মুসলিম সমাজের কষ্ট-দুঃখে উদাসীন থেকে যাচ্ছে। পরিবার ও শিক্ষায় উম্মাহচেতনাকে জাগাতে হবে। পাঠ্যক্রমে ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া, কাশ্মীরসহ মুসলিম নিপীড়নের ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মিডিয়ায় উম্মাহর বার্তা পৌঁছাতে হবে। ছোট থেকে বড়—সব পর্যায়ে উম্মাহবোধ গড়ে তুলতে পারলে তবেই আমরা এক শক্তিশালী মুসলিম পরিচয় গড়তে পারব।
৬. রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন নেতৃত্ব গড়ে তোলা
একটি জাতির উন্নতির জন্য স্বাধীন, দূরদর্শী ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্ব অপরিহার্য। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে বেশিরভাগ শাসক পশ্চিমা শক্তির ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেন না যা তাদের প্রভুদের বিরক্ত করতে পারে। এমন অবস্থায় দরকার এক নতুন প্রজন্মের নেতার, যারা কেবল নিজের সিংহাসন নয়—উম্মাহর কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবে। এই নেতৃত্ব রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনবে, জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা প্রতিফলিত করবে, এবং মুসলিম বিশ্বের সম্মান ও নিরাপত্তার পক্ষে কাজ করবে। স্বাধীন নেতৃত্ব মানেই একঘরে হয়ে যাওয়া নয়—বরং তা হলো ন্যায়-নীতি ও নৈতিক অবস্থানে অবিচল থাকা। মুসলিম জনগণের উচিত এমন নেতৃত্বকে বেছে নেওয়া, যারা সাহসী, সৎ এবং উম্মাহর পক্ষে সরব।
৭. আন্তর্জাতিক লবি ও কূটনৈতিক সক্রিয়তা
বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো যেমন UN, ICC, এবং OIC—নানান সিদ্ধান্ত ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে যদি এসব প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় হয়, তাহলে বিশ্বপরিসরে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ও মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুসলিম দেশগুলো অনেকাংশেই এসব ফোরামে নিষ্ক্রিয় বা বিভক্ত। সৌদি, মিশর, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান—সবাই আলাদাভাবে বক্তব্য রাখে, একসাথে না। যদি একটি সম্মিলিত কূটনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যায়, যেখানে মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি দল আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ তুলে ধরে, তাহলে বিশ্ব বাধ্য হবে প্রতিক্রিয়া জানাতে। মুসলিমদের উচিত এখনই কূটনৈতিক শক্তি ও একতা বৃদ্ধি করা, যা শত্রুর মুখে যুক্তি ও ন্যায়ের ভাষায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারবে।
ইমাম মাহদীর আগমনের আগে কী কিছুই করা যাবে না?
অনেকে বলেন, "ইমাম মাহদী আসার আগ পর্যন্ত মুসলিমরা বিজয়ী হবে না।" এটি ঈমানের দুর্বলতা ও দায়িত্ব এড়ানোর একটি অজুহাত ছাড়া কিছু নয়। সাহাবারা কখনো এই ধরনের অজুহাত খুঁজে বসে থাকেননি। বরং তাঁরা দাওয়াত, জিহাদ, ইলম ও সেবার মাধ্যমে পরিস্থিতি পাল্টেছেন। অতএব, আমাদেরও কর্তব্য এখন বসে থাকা নয়, বরং নিজেদের আত্মশুদ্ধি, ঐক্য ও সংগ্রামের মাধ্যমে ইমাম মাহদীর আগমনের পথ প্রস্তুত করা।
উপসংহার: এখনই সময় জাগরণের :
আমরা সকলেই এ বিষয়ে অবগত যে মুসলিমের পরিপ্রেক্ষে ইসলাম সমাজ সর্বদা জুলুমকে ঘৃণা করে এবং নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াতে সদা উৎসাহ দেয়। যে সম্বন্ধে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা কুরআন শরীফে সুরাতুল ইমরানের ৫৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন:
وَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ ۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلظَّـٰلِمِينَ
“কিন্তু যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তিনি তাদেরকে তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেবেন। আর আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না।”
এই আয়াত আমাদের স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়, আজ ফিলিস্তিন ও ইরানের মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের একান্ত ঈমানি দায়িত্ব। আজকের মুসলমানদের উচিৎ, অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে উম্মাহর ঐক্যের পথ খোঁজা। ফিলিস্তিনকে রক্ষা করা আমাদের ঈমানের পরীক্ষা। ইরান হোক বা অন্য কোনো দেশ—যে মুসলমান মুসলমানের পাশে দাঁড়ায়, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং বাকি দেশগুলোকে ঘুম থেকে জাগানো এখন আমাদের দায়িত্ব। একমাত্র ঈমান, তাওহীদ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনই আমাদের এই দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে পারে। আর যদি আমরা ব্যর্থ হই, তবে ইতিহাসের ধারা আমাদের সেই উম্মাহ হিসেবে বিবেচনা করবে যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলো না—কারণ তারা বিভক্ত ছিল, ভীত ছিল, আর স্বার্থপর ছিল।