ডটার্স অফ ইভ: ইসলাম কিভাবে নারী এবং তাদের সমতা উপলব্ধি করে  (বই পর্যালোচনা)

ডটার্স অফ ইভ: ইসলাম ও নারী মুক্তি, গ্রন্থটির রচয়িতা এম জামাল হায়দার। এবং গ্রন্থটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। নারী মুক্তির প্রকৃতি কাহিনী নিয়ে এই অপরূপ গ্রন্থটি রচিত। 

নারীকে ভালোবাসে না কে! চৌদ্দ'শো বছর আগে মদীনায় নারীমুক্তির এক ঐশ্বরিক অধ্যায় সংঘটিত হয় সর্বশেষ রসুল হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) নেতৃত্বে। নারী অধিকার যেথায় ভূলুণ্ঠিত, সেই আরব ভূখণ্ডে রচিত হয় নারীমুক্তির এক স্বর্ণালী ইতিহাস।

কিন্তু সব সময় দেখা যায় নারী স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে নানা বিষয়ে ইসলামের দিকে অভিযোগের আঙুল। সেই ধারা আজও অব্যাহত। এর সমুচিত জবাব ও অজ্ঞতাকে বিদূরিত করার নিমিত্তে এবং নারীমুক্তির প্রকৃত ভাবনাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন এম. জামাল হায়দার তাঁর রচিত "Daughters of EVE: Islam and Female Emancipation" বইটিতে।

নারীমুক্তির ভাবনাটি নিঃসন্দেহে বৃহৎ। একটা বিপ্লবও বটে। তবে তার জন্য নারী সত্ত্বাকে জানাটা অত্যন্ত জরুরী। তাই এই পুস্তকের প্রথমেই নারীসত্ত্বাকে এক অন্য আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নারীসত্ত্বাকে না চিনতে পারলে, না বুঝতে পারলে নারীমুক্তির বিশাল কর্ম সম্পাদিত হবে কিভাবে? লেখক নারীসত্ত্বাকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে নারীমুক্তির আলোকিত অভিমুখে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। প্রাচীন যুগ, ইসলামী যুগ ও আধুনিক যুগের মহিলাদের অবস্থানকে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বই সারসংক্ষেপ 

ইভ বা আদিমাতা হাওয়া হলেন প্রথম মানবী। 'ডটার্স অব ইভ' বলতে সমগ্র নারীজাতিকে বোঝানো হয়। হযরত আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম মানব এবং আদি পিতা। তিনি এবং মা হাওয়া। (ইভ) প্রাচুর্যাভরা জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন মহান প্রভুর মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে। আদম এবং ইভ এই পৃথিবীতে মানবজাতির সূচনা করেন। দুজনে মিলে বাসযোগ্য করে তোলেন এই পৃথিবীকে। একে অপরের পরিপূরক ছিলেন তাঁরা। মা ইভের প্রতি পিতা আদমের ভালোবাসা এই অসাধ্যকে সাধন করেছিল।

নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক হলো ভালোবাসার। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের। তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং সহযোগী। মানবসভ্যতার বিকাশে পুরুষের যতটা ভূমিকা রয়েছে, নারীর ভূমিকা তার চেয়ে কিছু কম নয়। বলা যায় নারী নিজের কোলে এই পৃথিবীকে লালন পালন করেছে। তারা এই পৃথিবীকে রঙিন করে তুলেছে।

বিশ্বসভ্যতার প্রথম লগ্ন থেকেই মহিলারা তাদের দায়িত্ব ও কর্ম সুচারুরূপে পালন করলেও তাদের প্রাপ্য সম্মান ও প্রশংসা করা হয়নি। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই প্রাচীন যুগ থেকে তারা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিলে সবক্ষেত্রেই তারা ছিল নিপীড়িত। সমস্ত ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অবশেষে সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে হযরত মুহাম্মাদের (সঃ) হাত ধরে প্রকৃত নারীমুক্তির সূচনা হয়। মহিলাদের সামাজিক ন্যায় ও সমস্ত ধরনের অধিকার দেওয়া হয়। সেদিনের সেই বৈষম্যপূর্ণ দুনিয়ায় এটা ছিল এক মহান পদক্ষেপ।

মহিলাদের অধিকার ও সামাজিক মুক্তির ফলে মানবতার সার্বিক বিকাশ ঘটেছিল। সেই সময়ে মুসলিম মহিলারা ছিলেন বিশ্বের সবচাইতে শিক্ষিতা। কিন্তু একটা সময়ে মুসলিম মহিলারা যে গৌরবের শিখরে আরোহণ করেছিল, সেই অবস্থানে তারা আজ আর নেই। অতীতে মহিলা হওয়াটা যদি দুর্দশার হতো, আজ মুসলিম মহিলা হওয়াটা আরো বেশি দুর্দশার কারণ। ইউরোপ-সহ সারা বিশ্বকে যারা নারীমুক্তির পাঠ দিয়েছিল, তাদের কেন এই অধঃপতন? এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই অপরূপ গ্রন্থে।

যুগের সাথে সাথে সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হয়। নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটে। নতুন সমাধান নিজেদের খুঁজে নিতে হয়। আজ থেকে একশত বছর আগে পরিবার ছিল একান্নবর্তী। কিন্তু আজ পরিবারগুলি অনু পরিবারে পরিণত। এখন মেয়েরা বাইরে কাজ করছে। সংসার ও পরিবার একই সাথে সামলাতে হচ্ছে। বিপণন শক্তিগুলি প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করা হচ্ছে। জীবন যাপনের খরচ বহুগুণে বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে মহিলাদেরও এগিয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে।

দুঃখের বিষয় হলো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সমস্যার সঠিক সমাধান না করার কারণে অতীতে মুসলিম মহিলাদের অবস্থা খারাপ হয়েছিল। আজও যে সমস্যাগুলি সামনে আসছে তার সঠিক সমাধান দরকার। নাহলে মুসলিম মহিলারা ইসলাম থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে সেটা তাদের জীবনকে আরো দুর্দশার মধ্যে ফেলবে। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা অক্ষুন্ন রেখে, ইসলামী ঐতিহ্যের সামঞ্জস্য বজায় রেখে অনুশাসনগুলির পরিমার্জন করলে অনেক সমস্যার সুন্দর সমাধান সম্ভব। এ বিষয়ে সমস্ত বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহদের ঐক্যমত্যে আসাটা যুগের দাবি।

ইসলাম পুরুষ ও মহিলাদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় সমান বলে বিবেচনা করে। সমতার মাপকাঠি ঠিক করা হয় উভয়ের সামর্থ্য অনুযায়ী। একই মাপকাঠিতে সমতা বিচার কখনও ন্যায় দিতে পারেনা। উভয়ের শক্তি, আকৃতি, আবেগ, বিবেচনা, বোধ আলাদা। ন্যায় হলো উভয়ে একই সম্মান ও মর্যাদা পাবে। শিক্ষা ও জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে একই সুযোগ পাবে। ইসলামে নারীমুক্তি হলো নারীকে 'নারী' হিসাবে সম্মান জানানো। ইসলাম নারীমুক্তির নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথক। নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে পণ্য বানায়, বাণিজ্যিকীকরণ করে এবং লালসা ও প্রবৃত্তির জীবনকে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে ইসলাম তাদের মর্যাদা, শালীনতা ও মমতার সাথে উপস্থাপন করে।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই বইটি এক অনন্য উপস্থাপনা। খুব সংক্ষেপে নিটোলভাবে প্রাচীন যুগ থেকে আজকের মহিলাদের অবস্থানের প্রকৃত ইতিহাস প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরেছে বইটি। যুগে যুগে মহিলাদের সমস্যার কথা এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে তার সমাধান আমাদের সামনে দিনের আলোর মত ফুটে ওঠে।

মূল্যায়ন :-ডটার্স অফ ইভ„ একটি আপদমস্তক নারীবাদী বই। মুসলিম উম্মাহর মহীয়সী এবং সম্মানীয়া নারীদেরকে সামনে রেখে নারীবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে ইতিহাসের ছোঁয়া এবং ভবিষ্যতের পথচলা সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন লেখক জামাল হায়দার সাহেব। এছাড়াও উগ্র সংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা নারী স্বাধীনতার আড়ালে তাদেরকে পণ্যে পরিণতি করার পরিকল্পিত চক্রান্তের যে স্রোত সৃষ্টি করেছে,

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter