বই পর্যালোচনা—লরেন্ট গেয়ার ও ক্রিস্টোফ জাফরলট সম্পাদিত—ভারতীয় শহরগুলিতে মুসলমান: প্রান্তিকীকরণের গতিপথ

পরিচিতি

ভারত ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে ভরা একটি দেশ। এই দেশের অন্যতম বৃহৎ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হলো মুসলমানরা। যদিও তাঁরা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু আজও সমাজের মূল স্রোতে তাঁদের অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্ন থেকে যায়। শহরগুলো, যেখানে উন্নয়নের সব সুবিধা থাকার কথা, সেখানেও মুসলমানরা নানা ধরনের অন্যায়, আশঙ্কা ও সামাজিক বঞ্চনার মুখে পড়ছে।

এই বাস্তবতাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছে লরেন্ট গেয়ারক্রিস্টোফ জাফরলট সম্পাদিত বই “Muslims in Indian Cities: Trajectories of Marginalization”। বইটি শুধু সংখ্যাতত্ত্ব নয়, বরং জীবন্ত অভিজ্ঞতা, গোষ্ঠীগত চ্যালেঞ্জ এবং শহরভিত্তিক মুসলমানদের জীবনযাত্রা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক রচনা, যা ভারতের সাম্প্রতিক ধর্মীয় সহাবস্থানের অবস্থা বোঝার জন্য অপরিহার্য পাঠ্য।যদিও আমি বইটি পুরোপুরি পড়িনি, তবুও পাঠক ও সমালোচকদের উপস্থাপিত নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখার মাধ্যমে বইটির মূল ভাব, কাঠামো এবং সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ও সমন্বিত ধারণা গড়ে তুলতে পেরেছি।

ভূমিকা

ভারত একটি বহু ধর্মের দেশ, যেখানে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। তবে, এই জনগোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন শহরে বাস করলেও তাঁদের জীবন মান এবং সামাজিক অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। “ভারতের শহরে মুসলমান: প্রান্তিকতার পথে যাত্রা” বইটি সেই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।

এই বইটি ১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত, যেখানে ভারতের বিভিন্ন শহরের মুসলমানদের জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। বইটির প্রতিটি অধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন গবেষক লিখেছেন, এবং প্রতিটি শহরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

শহরভিত্তিক মুসলমানদের জীবন

১. আহমেদাবাদ (গুজরাট)

২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা মুসলমানদের জীবনে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। দাঙ্গার পর মুসলমানরা মূল শহর ছেড়ে জুহাপুরা নামক একটি মুসলিম প্রধান এলাকায় বসবাস শুরু করে। এই জায়গাকে "ঘেট্টো" বলা হয়—অর্থাৎ এমন একটি এলাকা যেখানে একই ধর্ম বা জাতির লোকেরা গাদাগাদি করে থাকে এবং শহরের মূল পরিষেবা থেকে তারা বঞ্চিত থাকে। মুসলমানরা এখানে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতিবিচ্ছিন্নতার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে।

২. মুম্বাই (মহারাষ্ট্র)

মুম্বাই ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী হলেও এখানে মুসলমানরা নানা বাধার সম্মুখীন হয়। তারা অনেক সময় বাড়ি ভাড়া পায় না, কারণ মুসলিম বলে তাদের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস রয়েছে।
১৯৯২-৯৩ সালের দাঙ্গার পর মুসলমানরা ডোংরি, কুরলা, নাগপাড়া ইত্যাদি মুসলিম পাড়ায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যদিও এখানে শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বেশি, তবুও চাকরির বাজারে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।

৩. দিল্লি

দিল্লির জামিয়া নগর একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। এখানে উচ্চশিক্ষিত মুসলমানদের বসবাস, কিন্তু ২০০৮ সালের বাটলা হাউস এনকাউন্টার এই অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে।
এখানকার মুসলমানরা সমাজে অবদান রাখতে চাইলেও, তারা প্রায়ই পুলিশি নজরে থাকে এবং নানা অবিশ্বাস শিকার হয়।

৪. আলিগড় (উত্তরপ্রদেশ)

আলিগড়ে রয়েছে বিখ্যাত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (AMU), যা মুসলমানদের শিক্ষাগত উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। এখানে মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি, ফলে তারা কিছুটা আত্মবিশ্বাসী, তবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে এখনও পিছিয়ে রয়েছে।

৫. হায়দরাবাদ (তেলেঙ্গানা)

হায়দরাবাদে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে। AIMIM পার্টি এখানে সক্রিয় এবং মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে, শহরটি পুরাতন শহর (মূলত মুসলিম) এবং নতুন শহরে (মূলত অমুসলিম) বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
এখানে মুসলমানরা আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু শহরের উন্নয়ন মূলত নতুন শহর ঘিরেই হয়েছে।

৬. বেঙ্গালুরু (কর্ণাটক)

বেঙ্গালুরু একটি প্রযুক্তিনগরী। এখানে মুসলমানরা ছোট ব্যবসা ও পরিষেবা খাতে কাজ করছে। কিন্তু বাসস্থান, শিক্ষা ও চাকরিতে বৈষম্য এখানেও স্পষ্ট। কিছু মুসলমান আধুনিক পেশায় যুক্ত হলেও, বেশিরভাগ এখনও প্রান্তিক অবস্থানে।

মুসলমানদের সাধারণ সমস্যা

১. আবাসনের বৈষম্য:
অনেক সময় মুসলমানরা শুধুমাত্র ধর্মের কারণে ভালো জায়গায় বাড়ি ভাড়া বা কেনার সুযোগ পায় না। হিন্দু প্রধান এলাকাগুলোতে মুসলমানদের ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না।

২. চাকরি ও শিক্ষায় বাধা:
বেসরকারি খাতে মুসলমানদের নিয়োগে অঘোষিত বৈষম্য রয়েছে। অনেকে চাকরির সাক্ষাৎকারে নাম বা পোশাক দেখেই বাদ দিয়ে দেয়।

  1. পুলিশি নজরদারি:
    মুসলমানরা অনেক সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ছোট অপরাধ বা কোনও সন্ত্রাসী ঘটনার পর প্রথমেই মুসলিম যুবকদের টার্গেট করা হয়।
  2. অবকাঠামো ও পরিষেবার অভাব:
    মুসলিম ঘেট্টো এলাকায় পানি, স্বাস্থ্যসেবা, রাস্তা, ড্রেনেজ, স্কুল সবকিছুরই অভাব রয়েছে। এই জায়গাগুলো শহরের পরিকল্পনার বাইরে পড়ে থাকে।
  3. রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব:
    অনেক শহরে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কম। ফলে তাঁদের সমস্যাগুলো স্থানীয় সরকার বা প্রশাসনে সেভাবে আলোচিত হয় না।

বইটির মূল বার্তা

এই বইটি শুধু মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট দেখায় না, এটি আমাদের ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবায়। লেখকরা বলতে চান, যদি দেশের এতো বড় এক জনগোষ্ঠী নিজেকে নিরাপদ না মনে করে, তাহলে তা দেশের জন্য ভালো নয়। একটি জাতি তখনই উন্নত হয় যখন তার সব নাগরিক সমান অধিকার পায়, ধর্ম বা জাতের ভিত্তিতে নয়।

উপসংহার

“ভারতের শহরে মুসলমান: প্রান্তিকতার পথে যাত্রা” বইটি আমাদের চোখ খুলে দেয়। এটি দেখায়, কীভাবে মুসলমানরা শহরের মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন, অবিশ্বাসিত ও বৈষম্যের শিকার। এই বইটি সকল পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ—বিশেষ করে যারা মানবাধিকার, ধর্মীয় সহাবস্থান এবং সামাজিক সমতা নিয়ে চিন্তা করেন। ভারতের উন্নতির পথে, এই প্রান্তিককরণকে অস্বীকার করলে চলবে না। সমান অধিকার, সুবিচার ও সামাজিক সম্মিলনের মধ্য দিয়েই আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্র গড়তে পারি।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter