একছাঁচে গড়া চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ: ব্রেকিং দ্য মনোলিথ পর্যালোচনা

ব্রেকিং দ্য মনোলিথ: এসেস, আর্টিকেলস অ্যান্ড কলামস অন ইসলাম, ইন্ডিয়া, টেরর অ্যান্ড আদার থিংস দ্যাট অ্যানয় মি, হল প্রখ্যাত ব্রিটিশ মুসলিম চিন্তাবিদ জিয়াউদ্দিন সর্দারের প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কলামের এক সংকলন। এই গ্রন্থে তিনি ইসলাম, পরিচয়, ভারত, সন্ত্রাসবাদ, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক সমালোচনার মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন—সবই করেছেন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, গভীরতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত সরলতায়। “মনোলিথ ভাঙা” কথাটির মাধ্যমে তিনি মুসলিম পরিচয়কে একটি কঠোর, একরৈখিক ও প্রায়শই চরমপন্থী বয়ানে সীমাবদ্ধ করার প্রবণতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সর্দার ইসলামের ভেতর বহুত্বের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং মুসলমানদের নিজস্ব আত্মপরিচয় ও ভাবনার পরিসর পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়ে রচিত এবং ৯/১১-এর পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি, ইসলামোফোবিয়ার উত্থান এবং ভারতে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছে। ফলে, এগুলো একদিকে যেমন প্রাসঙ্গিক, অন্যদিকে তেমনি চিরন্তন। তিনি যেমন পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম চিত্রণকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন, তেমনি মুসলিম সমাজের চিন্তার জড়তা এবং কর্তৃত্ববাদী ব্যাখ্যাগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি সাংস্কৃতিক গোঁড়ামির বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার বৈচিত্র্যের পক্ষে সোচ্চার হন। ইতিহাস ও দর্শনের গভীর জ্ঞান নিয়ে সর্দারের এই লেখাগুলো বিশ্লেষণধর্মী হলেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বেদনায় ভরপুর। একজন আধুনিক মুসলিম হিসেবে জটিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা মোকাবিলার যে অভিজ্ঞতা, তা এই বইয়ের প্রতিটি লেখায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

ব্রেকিং দ্য মনোলিথ মূলত সংস্কার, সংলাপ এবং মুক্ত চিন্তার পক্ষে একটি জরুরি আহ্বান। এটি এমন একটি পাঠ, যা আজকের বিশ্বে ন্যায়বিচার ও বহুত্বের পক্ষে আগ্রহী যে কারো জন্য অত্যাবশ্যক।

ব্রেকিং দ্য মনোলিথ বইয়ের মূল বক্তব্য

জিয়াউদ্দিন সর্দারের ব্রেকিং দ্য মনোলিথ মূলত মুসলিম পরিচয়কে একটি একরৈখিক ও কঠোর রূপে দেখানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা। বইটির মূল বার্তা হল—ইসলাম এবং মুসলিম সংস্কৃতি কোনো একক, অপরিবর্তনীয় সত্তা নয়; বরং তা বহুমাত্রিক, প্রাণবন্ত এবং সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হতে থাকে। এই সংকলনে সর্দার স্পষ্টভাবে essentialism-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন—অর্থাৎ এমন একটি ধারণার বিরুদ্ধে, যা মনে করে মুসলমান হওয়ার একমাত্র নির্ধারিত উপায় আছে, ইসলামের একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা আছে, কিংবা সব মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ের মধ্যে ফেলে দেখা উচিত।

এই "মনোলিথ" বা একক কাঠামো মূলত সেই সীমাবদ্ধ ও দমনমূলক ইসলাম চিত্রকে বোঝায়, যা চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম উভয়েই ছড়িয়ে দেয়। সর্দার দেখান যে, এই সরলীকৃত ধারণাগুলো কেবল ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দেয় না, বরং মুসলিম সমাজের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে। তিনি মুসলমানদের আহ্বান জানান যেন তারা নিজেদের সমৃদ্ধ বৌদ্ধিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে, চিন্তার বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করে এবং অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্ববাদ ও গোঁড়ামিকে সাহস ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে মোকাবিলা করে।

একইভাবে, তিনি পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের বিকৃত চিত্র উপস্থাপন—যা ইসলামকে সহিংস, পশ্চাদপদ বা আধুনিকতার পরিপন্থী হিসেবে তুলে ধরে—তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। সর্দার মনে করেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ভুল নয়, বরং রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা ও বিভাজন বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।

সব মিলিয়ে, ব্রেকিং দ্য মনোলিথ একটি জোরালো আহ্বান—সরলীকরণের বদলে জটিলতাকে গ্রহণ করা, বর্জনের বদলে অন্তর্ভুক্তিকে বেছে নেওয়া এবং অন্ধ আনুগত্যের পরিবর্তে চিন্তাশীলতার চর্চা। এটি একটি মুক্ত, বহুমাত্রিক এবং মানবিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির পথে আহ্বান।

পশ্চিমা উপস্থাপনায় ইসলাম এবং সন্ত্রাসবাদ

জিয়াউদ্দিন সর্দার তাঁর বই Breaking the Monolith-এ পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদের উপস্থাপনাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম, রাজনীতি ও একাডেমিক চর্চায় ইসলামকে একটি সংকীর্ণ, সহিংস এবং গোঁড়া ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা হয়, যা একদিকে যেমন ইসলামোফোবিয়া উসকে দেয়, অন্যদিকে মুসলমানদের আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্বাসেও গভীর প্রভাব ফেলে।

১. ইসলাম = সন্ত্রাস: একটি বিপজ্জনক রূপকথা

সর্দার বারবার এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন যে ইসলাম নিজেই সন্ত্রাসবাদের উৎস। তাঁর মতে, পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা সচেতনভাবে একে প্রোমোট করে, যেন মুসলমানদের প্রতি জনসাধারণের ভয় ও বিদ্বেষ জিইয়ে রাখা যায়। "মুসলমান" শব্দটি যেন "বোমা", "জঙ্গি", বা "হুমকি"র প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে। তিনি এই বর্ণনাকে বর্ণবাদী ও উপনিবেশিক চেতনার উত্তরাধিকার হিসেবে দেখেন।

২. চিন্তার জায়গায় নিরাপত্তা রাজনীতি

সর্দার দেখিয়েছেন কীভাবে ৯/১১-এর পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ (War on Terror) ধারণাটি পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের জীবন, চিন্তা, অভিব্যক্তি — সবকিছুই নিরাপত্তা ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। একে তিনি ‘security epistemology’ নামে অভিহিত করেন, যেখানে জ্ঞান ও বাস্তবতা নির্মিত হয় নিরাপত্তার ছাঁকনিতে।

৩. একক পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া

পশ্চিমে মুসলমানদের 'ভালো মুসলিম বনাম খারাপ মুসলিম' এই বাইনারির মধ্যে ফেলে রাখা হয়। যারা পশ্চিমা আদর্শে খাপ খায়, তারাই ‘ভালো’; বাকিরা সন্দেহভাজন। এর ফলে মুসলমানদের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক বহুত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিতর্কের স্থান সংকুচিত হয়ে যায়। সর্দার এই "মনোলিথিক ইসলাম" ধারণার বিপক্ষে অবস্থান নেন।

৪. উত্তর-উপনিবেশিক সংকট ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য

সর্দার মনে করেন, ইসলামকে একটি একমাত্রিক ও সহিংস ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব একটি নতুন রূপে উপনিবেশবাদের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে—যেখানে মুসলমানদের নিজেদের সম্পর্কে ভাবার অধিকারও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

৫. বিকল্প প্রস্তাব: বহুত্ব ও আত্মসমালোচনা

এই বিপজ্জনক উপস্থাপনার বিরুদ্ধে সর্দার ইসলামের নিজস্ব বহুমাত্রিক ঐতিহ্য, সমালোচনামূলক চিন্তা, আত্মসমালোচনার ঐতিহ্য ও মানবিকতাকে পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বাস করেন, মুসলমানদের নিজেদের ভেতরে আত্মসমালোচনা ও পুনরুচ্চারণের জায়গা তৈরি করতে হবে, তবে সেটা পশ্চিমা আধিপত্যের অনুকরণে নয়, বরং নিজস্ব সূত্র থেকে।

ইসলামি জাতিসত্তার নিজের গল্প ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম

জিয়াউদ্দিন সর্দার Breaking the Monolith বইয়ে মুসলিম জাতির "নিজস্ব গল্প পুনরুদ্ধার" বা আত্মবর্ণনা ফিরে পাওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, আধুনিক বিশ্বে মুসলমানদের পরিচয় ও অস্তিত্ব মূলত বাইরের শক্তিগুলোর ভাষায় সংজ্ঞায়িত হচ্ছে—বিশেষত পশ্চিমা মিডিয়া, রাষ্ট্র ও একাডেমিয়া। ইসলাম কী, একজন মুসলমান কে, কীভাবে তারা চিন্তা করে—এই সব প্রশ্নের উত্তর এখন মুসলমানদের নিজেদের অভ্যন্তর থেকে নয়, বরং পশ্চিমের চোখে তৈরি হচ্ছে। এর ফলে মুসলমানরা নিজেদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, বুদ্ধিবৃত্তিক বৈচিত্র্য ও আত্মপরিচয়ের বহুস্তর হারিয়ে ফেলছে।

সর্দার এই পরিস্থিতিকে "আত্মবিস্মৃতি" বা collective amnesia বলে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, মুসলিম জাতিকে আবার নিজেদের গল্প নিজেদের ভাষায় বলা শিখতে হবে—যে গল্পে থাকবে আত্মসমালোচনা, চিন্তার বৈচিত্র্য, মানবতা ও ইতিহাসচেতনা। এই গল্প কেবল চরমপন্থা বা প্রতিরোধের ভাষায় নয়, বরং সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার বুননে গাঁথা হওয়া উচিত।

তাঁর মতে, মুসলমানদের উচিত নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের আধুনিক পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নিমাণ, যাতে তারা বিশ্বব্যাপী প্রভাবিত পরিচয় চাপিয়ে না নিয়ে নিজস্ব ইসলামি স্বর (Islamic voice) সৃষ্টি করতে পারে। এই আত্মগল্পই হবে ইসলামি পুনর্জাগরণের মূল চালিকা শক্তি।

ব্রেকিং দা মোনোলিথ, কেবল একটি আধ্যাত্মিক বা বৌদ্ধিক কাজ নয়, এটি একটি ক্রিয়ামূলক আহ্বান যা মুসলিম ও পশ্চিমা পৃথিবী উভয়ের জন্য। যখন ইসলামোফোবিয়া এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন এই বইটি একটি প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী সমালোচনা প্রদান করেছিল। সরদারের কাজ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা যদি বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর মধ্যে মানুষের ঐক্য এবং সম্মান খুঁজে না পাই, তবে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাবে।

বইটি ইসলামের এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে একটি নতুন, জ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির আহ্বান জানিয়েছে। যা শুধু দুই পক্ষের মধ্যে ভিন্নতা দূর করে, একইসঙ্গে একে অপরকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সহায়তা করবে।

উপসংহার

জিয়াউদ্দিন সর্দারের Breaking the Monolith শুধু একটি বই নয়—এটি একটি বিবেক-জাগ্রত আহ্বান। ইসলাম ও মুসলমানদের ঘিরে বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা, চরমপন্থার উত্থান এবং পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির একচেটিয়া আধিপত্যের বিপরীতে এই বইটি দাঁড় করায় যুক্তিবাদ, আত্মসমালোচনা ও নৈতিক সাহসের একটি সজীব মঞ্চ। পাঠক এখানে পাবেন এমন এক ভাষ্য, যা মুসলিম জগতের বহুবচন, বিবর্তন এবং আত্মজিজ্ঞাসার কথা বলে—যা আজকের সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই বইটি আমাদের শেখায় যে, চিন্তার স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কেবল পশ্চিমে নয়, মুসলিম সমাজের মধ্যেও একান্ত জরুরি। এটি আপনাকে বাধ্য করবে প্রশ্ন তুলতে, চিন্তা করতে, এবং ইসলামকে পুনরায় ভাবতে—গোঁড়া কিংবা প্রথাসর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে।

যদি আপনি ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে প্রচলিত বয়ানের বাইরে সত্যিকারের গভীরতা, সততা ও বিশ্লেষণ খুঁজতে চান—তাহলে Breaking the Monolith আপনার পাঠ তালিকায় থাকা উচিত। এটি কেবল পড়ার জন্য নয়, উপলব্ধির জন্যও একটি অপরিহার্য গ্রন্থ।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter