কলিং টি খৃষ্টানস: সত্যের খোঁজে এক খ্রিস্টানের ইসলাম-যাত্রা
বইয়ের পরিচিতি
আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয় বিভাজন, মতবিরোধ ও ভুল ব্যাখ্যার ভিড়ে, আন্তঃধর্মীয় বোঝাপড়া ও যুক্তিভিত্তিক দাওয়াহ এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিম সমাজের সামনে। এই বাস্তবতায় অ্যাডাম হাফিজ রচিত “Calling the Christians: How Understanding Christianity Brings Us to Islam” গ্রন্থটি মুসলিম ও খ্রিস্টান—উভয় সম্প্রদায়ের কাছে এক দার্শনিক আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেছে। লেখক খ্রিস্টধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন—কিন্তু বিদ্বেষ বা বিতর্ক নয়, বরং গবেষণা, আত্মজিজ্ঞাসা ও সত্য অনুসন্ধান ছিল তাঁর চালিকাশক্তি। এবং এই বইটি শুধুমাত্র দুটি ধর্মের তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বরং এটি ধর্মীয় সংলাপ এবং আন্তঃধর্মীয় আলোচনার এক দৃষ্টান্ত।
লেখকের পরিচিতি ও দৃষ্টিভঙ্গি
অ্যাডাম হাফিজ একজন সাবেক খ্রিস্টান যিনি যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টান ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল খ্রিস্টধর্মেই সত্য নিহিত আছে, কিন্তু দীর্ঘ অধ্যয়ন ও হৃদয়গ্রাহী অনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন, ইসলামই সেই ধর্ম যা সব প্রশ্নের যুক্তিবোধসম্পন্ন ও স্বচ্ছ উত্তর দেয়। লেখকের একটি অমর উক্তি বইটির সারকথা প্রকাশ করে: “I didn’t leave Christianity because I hated it. I left because I loved the truth more.” “আমি খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করিনি কারণ আমি তা ঘৃণা করতাম, বরং আমি সত্যকে আরও ভালোবাসতাম।” এই একটি লাইনেই লেখকের অভিপ্রায়, বিনয় ও আন্তরিকতার প্রতিফলন ঘটে।
উপস্থাপনভঙ্গি ও ভাষাশৈলী
বইটির ভাষা সহজ, আবেগময় ও যুক্তিনিষ্ঠ। তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায়—লেখক একজন সাবেক খ্রিস্টান হিসেবে খ্রিস্টান পাঠকদের মনস্তত্ত্ব ভালোভাবেই বুঝেছেন। তিনি কঠোরতা বা উপহাসের বদলে ব্যবহার করেছেন দাওয়াহভিত্তিক নম্রতা ও মানবিকতা, যা আজকের দুনিয়ায় দাওয়াহ কার্যক্রমে অনুপম দৃষ্টান্ত। এছাড়া ও বইটি শুধুমাত্র দুটি ধর্মের তুলনা নয়, এটি ধর্মের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লেখক দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, ধর্মীয় মতবাদ যে মানুষের অন্তরের গভীরে স্পর্শ করতে পারে, তা সীমানা ছাড়িয়ে যায়। এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা যেখানে ধর্মীয় আবেগের পরিবর্তে, জ্ঞানের আলোকে সত্যের সন্ধান করা হয়।
বইটির বৈশিষ্ট
‘Calling the Christians’ বইটি একজন প্রাক্তন খ্রিস্টানের আত্মজিজ্ঞাসার ফল, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যুক্তিবাদী ও নম্র উপস্থাপনায় মিলিত হয়েছে। অ্যাডাম হাফিজ খ্রিস্টধর্মের তিনটি মূল বিশ্বাস—ত্রিত্ববাদ, ঈসা (আ.)-এর ঈশ্বরপুত্রত্ব, এবং আদিপাপ—বিবেচনা করে দেখিয়েছেন কীভাবে ইসলামের সরল একত্ববাদ, ন্যায়বিচার ও নবুয়তের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিসঙ্গত ও অন্তরগ্রাহী বিকল্প হিসেবে দাঁড়ায়। বাইবেল ও কোরআনের তুলনামূলক পাঠের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় সত্যের এক আন্তরিক ও সম্মানজনক খোঁজকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন, যা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং খ্রিস্টানদের দিকেও এক বন্ধুসুলভ আমন্ত্রণ। সহজ ভাষা, দাওয়াহ-উপযোগী ভঙ্গি এবং আত্মিক সংলাপ এই বইটিকে আজকের দাওয়াহ চিন্তায় এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত করেছে।”
ইসলামের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
বইটি ইসলামের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। লেখক ইসলামকে খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে তুলনা করে একটি সেতুবন্ধন স্থাপন করেছেন, যা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য ইসলামের প্রতি আরও গভীর সম্মান তৈরি করে। এটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং তার মানবিক দিকগুলোকে আলোকিত করে। ” বইটি খ্রিস্টান পাঠকদের ইসলামকে নতুন দৃষ্টিকোণে দেখার একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করে। লেখক অ্যাডাম হাফিজ ইসলামকে শুধুমাত্র একটি নতুন ধর্ম নয়, বরং সত্য, যুক্তি ও করুণার এক সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসভিত্তিক সংকটগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি ইসলামের তাওহীদ, নবুয়ত ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্তিবাদী, স্বচ্ছ ও আত্মিক প্রশান্তির পথ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। ইসলামকে ‘ভয়’ নয়, বরং ‘বোঝা’র একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখানোর এই প্রয়াস—বিশেষত একজন সাবেক খ্রিস্টান চিন্তাবিদের কলমে—খ্রিস্টান পাঠকের হৃদয়ে সত্যের প্রতি এক আন্তরিক অনুসন্ধান জাগাতে পারে। এ গ্রন্থ পাঠকের চোখে ইসলামের পরিচিত কাঠামোকে একেবারে নতুন আলোয় প্রকাশ করে।
বিশ্লেষণধর্মী কাঠামো ও দাওয়াহর বাস্তব উপযোগিতা
‘Calling the Christians’ বইটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত—ত্রিত্ববাদ, ঈসা (আ.)-এর প্রকৃতি, এবং মুক্তি বা পরিত্রাণের তত্ত্ব। প্রতিটি অংশে লেখক বাইবেলের পাঠ ও খ্রিস্টীয় মতবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব তুলে ধরে ইসলামের সরল, যুক্তিনিষ্ঠ ও প্রাকৃতিক বিশ্বাসব্যবস্থাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। যেমন, ‘Understanding the Trinity’ অধ্যায়ে তিনি দেখান কিভাবে ত্রিত্ববাদের ধারণা বাইবেলের মৌলিক একত্ববাদী বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। লেখক বাইবেল থেকেই উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন—“God is not the author of confusion” (1 Corinthians 14:33), যা দিয়ে বোঝান, বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব কখনোই আল্লাহর পক্ষ থেকে হতে পারে না। এই বইটি শুধু ধর্মতাত্ত্বিক পাঠ নয়—বরং বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার মতো বহুধর্মীয় সমাজে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য এক বাস্তব দাওয়াহ সহায়িকা। কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজের পাঠক এবং আন্তঃধর্মীয় বোঝাপড়ায় আগ্রহীদের জন্য বইটি যুগোপযোগী ও প্রয়োজনীয়।
পাঠক হিসাবে আমার অনুভূতি
আমি যখন বইটি পড়ছিলাম, তখন আমি অনুভব করেছি যে এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আলোচনা নয়, বরং একটি আত্মবিশ্লেষণ। লেখকের আন্তরিকতা এবং তাঁর নিজস্ব ধর্মান্তরের গল্প আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বইটি মনের গভীরে এক বিশেষ দাগ রেখে গেছে। এবং অ্যাডাম হাফিজের আত্মিক সততা, তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন এবং সত্যের প্রতি ভালোবাসা আমার নিজের বিশ্বাসকে নতুনভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে যখন তিনি বাইবেল ও কোরআনের আলোকে যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামকে তুলে ধরেন, তখন আমি একজন পাঠক হিসেবে শুধু তথ্য নয়, বরং এক অভ্যন্তরীণ প্রশান্তিও অনুভব করি। বইটি আমাকে আরও গভীরভাবে দাওয়াহ চিন্তায় অনুপ্রাণিত করেছে এবং মনে করিয়ে দিয়েছে—সত্য যদি আন্তরিকভাবে অনুসন্ধান করা হয়, তবে তা আত্মায় প্রতিফলিত হবেই।
উপসংহার
‘Calling the Christians’ গ্রন্থটি আধুনিক যুগের প্রাসঙ্গিক, যুক্তিবাদী ও আন্তরিক এক দাওয়াহ দলিল। এটি কেবল একজন খ্রিস্টানের ইসলাম গ্রহণের কাহিনি নয়, বরং সেটি এমন এক যাত্রা যেখানে সত্যপ্রেম, আত্মবিশ্লেষণ এবং ঈমানী দৃঢ়তা মিলিত হয়েছে। আজকের দাওয়াহকর্মীদের উচিত—এই বইটি হাতে রেখে খ্রিস্টানদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছানো। একই সঙ্গে, এটি মুসলমানদের নিজেদের ধর্মীয় জ্ঞানে দৃঢ়তা আনতে সহায়তা করবে। এবং আমি বইটি সকল পাঠকদের জন্য সুপারিশ করি, বিশেষ করে যারা ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক আলোচনার প্রতি আগ্রহী।