মোদীর হিংসাত্মকপূর্ণ রাজত্বকালঃ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং ক্রমবর্ধমান মব লিঞ্চিং

অহরহ মুসলিমদের বিরদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ পদক্ষেপ, ভাষণ, আচরণ ও দিনদুপুরে তাদের গণপিটুনির সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। 28শে সেপ্টেম্বর, 2015 তারিখে রাত 10:30 টার দিকে ঘটে যাওয়া সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড এখনো আমাদের চোখের সামনে ভাসছে, যখন 50 বছর বয়সী আখলাককে গরুর মাংস খাওয়ার ‘গুজবের’ কারণে উন্মত্ত হিন্দুত্ব কর্মীরা নির্মমভাবে তাকে টেনে নিয়ে যায় এবং মারধর করে হত্যা করে। হিন্দুত্ববাদীর এই বর্বরতা এখনও বেড়ে ও ঘটে চলছে।

বিদ্বেষপূর্ণ এই ঘটনাগুলির প্রেক্ষাপটে কবি কাজি নজরুল ইসলামের সেই ঐক্যতার স্তবক মনে পরে যাইঃ 

মোরা এক বৃন্তে দু'টি কুসুম

হিন্দু-মুসলমান। 

মুসলিম তার নয়ন-মণি, 

হিন্দু তাহার প্রাণ।।

এক সে দেশের খাই গো হাওয়া,

এক সে দেশের জল,

এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই 

একই ফুল ও ফল।।

কিন্তু বলাবাহুল্য যে, আজকের ভারতবাসীর মধ্যে পূর্বের ন্যায় সেই ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীও সহিষ্ণুতা বাকি নেই, নিছক কাগজ কলমের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি সীমিত রয়েছে। রাজনৈতিক হিতকরে উসকানিমূলক ভাষণ ও নানা পদক্ষেপের কারণে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও দুষ্টতা এতটাই বেড়েছে যে একদিন তা সমগ্র ভারতবাসীকে গ্রাস করে ফেলবে। বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতাসীন হওয়ার এবং সম্প্রতি লোকসভা ভোটের পর মুসলিম-বিরোধী মনোভাব ও সাম্প্রদায়িক বিবাদ ধীরে ধীরে তার শিখরে পৌঁছে গেছে। 

ভারতীয় জনতা পার্টির হিন্দুত্ব চিন্তাধারা ভারতের কিছু পরিমাণ অশিক্ষিত তরুণ হিন্দু সমাজকে এতটাই উত্তেজিত করে তাদের মগজ ধোলাই ও তাদের নৈতিক মানসিক চিন্তাধারা বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে, যে তারা তাদের আসল উদ্দেশ্য যেমন চাকরী, সন্তানদের উচ্চশিক্ষা ও সুস্থ একটি জীবন গড়ে তোলার পরিবর্তে, মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কোমর বেঁধে প্রস্তুত, তাতে নিজের প্রাণ দিতেও রাজী। অপরদিকে, হিন্দু নেতাদের শিশুরা বিদেশে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করে মানসম্পন্ন জীবন যাপন করছে। এইভাবে সাধারণ মানুষদের মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে একটি সাম্প্রদায়িক বিবাদ ও ইস্যু রেখে সরকার তার প্রশাসনের ত্রুটিগুলো লুকোতে সক্ষম হয়েছে। মনে রাখতে হবে, কেবল সমস্ত ধর্ম ও জাতির সমন্বয় চেষ্টা ও অবদানে ভারত বিশ্বস্তরে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম। 

ইন্ডিয়া টাইমস-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে, দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মব লিঞ্চিং মামলার উদ্বেগজনক বৃদ্ধির বিষয়ে এন.এফ.আই.ডাবলু -এর দায়ের করা মামলার  শুনানির সময়, পিটিশনকারী অভিযোগ করেন যে দেশে মুসলিমদের গণপিটুনি হল একটি "বাস্তবতা" এবং "পরিসংখ্যানগত তথ্য" হিসেবে, মুসলিমরা মব লিঞ্চিংয়ের বা গণপিটুনির প্রাথমিক লক্ষ্য যেইটি কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।

বহু গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনার মধ্যে নিম্নে কিছু আলোচনা করা হলঃ

17 জুন উত্তর হিমাচল প্রদেশ রাজ্যের নাহান শহরে, জাভেদ কুরেশি নামে এক মুসলিম বাক্তি  তার হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস হিসেবে একটি প্রাণীর মৃতদেহের সাথে একটি ছবি আপলোড করলে, একদল হিন্দুত্ব গোষ্ঠী - পুলিশ কর্মীদের উপস্থিতিতে- গরু জবাই করার অভিযোগে কুরেশির অনুপস্থিতে তার তালাবদ্ধ দোকানে প্রবেশ করে তার দোকানে ব্যাপক ভাবে হামলা চালায় এবং লুটপাট করে।  দুই দিন পরে, পুলিশ তদন্তে দেখা যায় যে ছবিতে দেখানো প্রাণীটি গরু ছিলোনা। তবুও, পুলিশ "ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত" করার দায়ে কুরেশিকে গ্রেপ্তার করে। 

অনুরূপভাবে, 18 জুন মঙ্গলবার গভীর রাতে উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে, একদল হিন্দু পুরুষ 35 বছর বয়সী ফরিদ ওরফে ঔরঙ্গজেব নামে এক মুসলিম ব্যক্তিকে ঘিরে তাকে লাঠি ও ঘুষি মেরে পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটির একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছিল।  হামলার পিছনে প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করা না গেলেও, স্থানীয় পুলিশ বলেছে যে অভিযুক্ত হিন্দু ব্যক্তিরা মুসলিম ব্যক্তিকে একজন হিন্দু ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে চুরি করার চেষ্টার “সন্দেহে” তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। পরবর্তীতে 19 জুনে, হিন্দুত্ববাদী কর্মীরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ধর্না দেয় এবং তাদের গ্রেপ্তার না করার দাবি জানায়।

বিশেষ করে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এতটাই অস্থিতিশীল যে, প্রশাসন প্রায়শই তার ক্রিয়াকলাপে কঠোর মুসলিম বিরোধী অবস্থান প্রদর্শন করছে। একইভাবে, বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের একটি গ্রামে, সরকারি কর্তৃপক্ষরা ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার সন্দেহে 11টি মুসলিম পরিবারের বাড়ি ভেঙে দেয়।

শুধুমাত্র 2023 সালের জুন মাসে, ছয়জন ব্যাক্তি মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হয়, তবুও এই ঘটনাগুলি খুব কমই সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়। সাম্প্রতিক ভাবে, ঝাড়খণ্ডের একজন ইমাম শাহাবুদ্দিন 2শে জুলাই মবের মারাত্মক মারধর এর ফলে নিহত হন। 

ভারতে ক্রিকেট কেই বা ভালো না বাসে। ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সব ভারতবাসীরাই ভারতীয় ক্রিকেট দলের ফ্যান। কিন্তু এই মর্মান্তিক ঘটনাটি সামনে আসে যখন গুজরাটের 23 বছর বয়সী সালমান ভোহরা নামে একজন মুসলিম ব্যক্তি একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পরে একদল হিন্দু দলের হাতে নিহত হন। টুর্নামেন্টে মুসলিম খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স নিয়ে অস্বস্তির কারণে অমুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালের সময়, কিছু দর্শক 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান দিয়ে খেলোয়াড়দের হেঁচকি দিতে শুরু করে। শেষপর্যায়ে পার্কিং নিয়ে একটি বিবাদ শুরু হলে, তারা সলমনের মুসলিম পরিচয় পেয়ে তার উপর মারাত্মক আক্রমণ করে এবং একটি ছুরির দ্বারা তাকে বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষত করে। 

7 জুন, 35 বছর বয়সী শামলি জেলার তাহসিন খান গুড্ডু ও তার চাচাতো ভাই চাঁদ মিয়ান খান, সাহারানপুরের সাদ্দাম কুরেশির সাথে, মহিষ পরিবহনের সময় একদল হিন্দু জনতা গরু পাচার ভেবে নির্মমভাবে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে তাদের দেহ রোডের সেতু থেকে ফেলে দেয়। 

এইভাবেই, 24 জুন, ছত্তিশগড়ের একটি গ্রামের এক হিন্দু মহিলা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে একদল আত্মীয় তাকে খুন করে। এছাড়াও, 14 জুলাই, দেহরাদুনের নেহেরু কলোনির একটি বাসভবনে, একটি খ্রিস্টান প্রার্থনা সভা চলাকালীন এক হিন্দুত্ববাদী দল হিংসাত্মকভাবে সভাটিকে ব্যাহত করে এবং আক্রমণ চালায়।

এ. পি.সি.আর দ্বারা প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে, 7 জুন থেকে 5 জুলাইয়ের মধ্যে মোট দশটি লিঞ্চিংয়ের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ছত্তিশগড়, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট এবং পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও তেলেঙ্গানা, ওড়িশা এবং রাজস্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের টার্গেট করে বুলডোজার চালানো হয়েছে। হিমাচল প্রদেশে মুসলিমদের বাড়িতে হামলার পর জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। অনেক মামলাতে, এফআইআর নথিভুক্ত করা সত্ত্বেও, এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

কেবল গণপিটুনির মধ্যে সীমিত নয়, মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব এতটাই বেড়েছে যে, মুসলমানদের উপর মিথ্যা মামলা চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি, 16 জুলাই, কৃষ রাম নামে একজন হিন্দু পুরোহিত, পূর্ব উত্তর প্রদেশের একটি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের যে মান্নান এবং সোনু নামে দুই মুসলিম ব্যাক্তি তাঁর মন্দিরে রাখা একটি গণেশ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু পুলিশ যখন বিষয়টি তদন্ত করে, তখন তারা প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে দুটি শিশুর দ্বারা প্রমাণ খুঁজে পায় যে, এটি দুটি মুসলমান নয় বরং পুরোহিত নিজেই গণেশ মূর্তিটি ভেঙে দু'জন মুসলমানকে মিথ্যাভাবে আরোপ লাগিয়ে তাদেরকে ফাঁসাবার চেষ্টা করেছে। এইরকম আরও কতই না ঘটনা ঘটছে যেইগুলো ঢেকে দেওয়ার কারণে তার সম্বন্ধে আমরা অজ্ঞ। 

এছাড়াও বিভিন্ন বৈঠকে হিন্দু ধর্মীও নেতারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহবান জানাই।  সম্প্রতি, মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া শহরে, ফিলিস্তিন সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটি ঘৃণাপূর্ণ প্রচারণার নেতৃত্ব দেয় হিন্দু ডানপন্থী নেতা অশোক পালিওয়াল, সে তার বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণে ফিলিস্তিন সমর্থকদের দেশবিরোধী বলে অভিহিত করে এবং হিন্দুদের সমস্ত ফিলিস্তিন সমর্থকদের হত্যা করার আহবান জানাই।

আরেকটি ঘটনায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং বলেন যে, “ভারতে মুসলমানদের থাকতে দেওয়া ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। 1947 সালে সব মুসলিমকে পাকিস্তানে পাঠানো হলে দেশের পরিস্থিতি আজ অতি সুন্দর হতো।”

মুসলিমদের উপর হামলার বিষয়ে বিরোধী নেতাদের নীরবতা অতি আশ্চর্যজনক। ভারতীয় মুসলিমদের ক্রমশই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আজ মুসলিমরা ভারতে মুসলমান হিসাবে তাদের ঘরের ভিতরেও নিরাপত্তাহীন বোধ করছে। একাধিক রিপোর্ট ও পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, লোকসভা নির্বাচনের পর মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে।

জামাআতে ইসলামে হিন্দ এবং জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম সংস্থাগুলি গো-হত্যার অপ্রমাণিত অভিযোগের পরে লিঞ্চিং সহ বিদ্বেষমূলক সহিংসতার বৃদ্ধিতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে, এই হুমকির মোকাবেলায় আদালতের আইনের কার্যকরণ এর দাবী জানাই এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকেও তার বক্তব্য চেয়েছে।

জামায়াতে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি আরশাদ মাদানি বলে জানান যে , “মব লিঞ্চিং উগ্রতার একটি চরম নিষ্ঠুর রূপ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এটি ঠেকাতে কঠোর আইনের দাবি জানিয়ে আসছি, সুপ্রিম কোর্টও এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এবং কেন্দ্রকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে এই ভয়ঙ্কর সহিংসতার ধারাবাহিকতা বন্ধ করার কোনো গুরুতর উদ্যোগ নেই।”

২০১৭ সালের জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্ট, তাহসিন এস. পুনাওয়ালা বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া মামলায় মব লিঞ্চিং মোকাবেলায় বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক, প্রতিকারমূলক এবং শাস্তিমূলক আইন প্রত্যায়ন করেছিল, যদিও সেটির সঠিক অবাস্তবায়নের কারণে এই ঘৃণ্য অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ভারত সরকার ভারতীয় ভারতীয় ন্যায় সংহিতা আইনের মধ্যে লিঞ্চিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর বিধান চালু করেছে। নতুন আইনে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও কিছু রাজ্য এই আক্রমণ ঠেকাতে কিছু আইন জারি করে যার মধ্যে মনিপুর, পশ্চিম বঙ্গ, রাজস্থান এবং ঝাড়খণ্ড উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রম বর্ধমান হিংসা ও হত্যা কাণ্ড শীর্ষ আদালতের আইনের আওতাই আনা অত্যাবশ্যক। 




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter