একজন অপ্রত্যাহারিত মুসলিম হওয়া: আধুনিক সময়ে পরিচয় এবং কর্তৃত্বের ওপর একটি প্রতিফলন
নিম্নে যে আলেখ্যটি উপস্থাপিত হইল, তাহা কানাডা-প্রবাসিনী আমার এক ধর্মভগিনীর জীবন-অভিজ্ঞতার এক নিগূঢ় উপাখ্যান। সেই সুদূর প্রতীচ্যের ভূমিতে, একজন মুসলিম রমনীর পরিচয়ে তিনি যে সকল কণ্টকাকীর্ণ পথ ও সংঘাতের সম্মুখীন হইয়াছেন, এই রচনায় তাহারই এক মর্মস্পর্শী প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হইয়াছে। তিনি এই প্রত্যয়ে বিশ্বাসী—এবং আমিও সেই একই বিশ্বাসের অংশীদার—যে, দ্বিধাহীন চিত্তে ইসলামের অনুবর্তী হওয়া, বিশেষত শিরোভূষণ (হিজাব) ধারণ করা, কোনোক্রমেই এক নেতিবাচক বা অবমাননাকর বিষয় নহে। বরং, ইহা তাঁহার স্বকীয় সত্তা ও আত্ম-সংযমের এক দ্যুতিময় ও সুদৃঢ় বহিঃপ্রকাশ, যাহা তাঁহার আত্মমর্যাদাবোধকে শাণিত করিয়া তাঁহাকে এক নব চেতনায় উদ্ভাসিত করিয়াছে।
-কখন যে এই বোধের উন্মেষ ঘটিল, তাহা আমি ঠিক ঠাহর করিতে পারি না, তবে ইহা অনুমান করা চলে যে, সেই সূচনালগ্ন অতি শৈশবেই ছিল। আমি স্বতন্ত্র ছিলাম। আমরা ছিলাম ভিন্ন স্রোতের যাত্রী। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে সেইসব বিপণন-কর্মীদের কুঞ্চিত ললাট, যখন আমার জননী তাঁহার প্রদেয় অর্থ কিয়দংশ নগদে ও কিয়দংশ পত্রে (ডেবিট কার্ডে) দিবার প্রস্তাব করিতেন। আমি দেখিয়াছি অভ্যর্থনাকারীদের চক্ষুক্ষীণ অবজ্ঞা, তাঁহাদের কণ্ঠস্বরে মিশ্রিত ছিল এক প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য ও উৎকট বিরক্তি। আর আমার সেই কচি মনে, সেই শিশু-মস্তিষ্কে, এক গভীর প্রত্যয় জন্মিয়াছিল—আমরা পৃথক, আমরা ওদের মতো নহি।
আমার মা, একজন ধর্মপ্রাণা মুসলিম রমনী হইয়াও, এই ভিনদেশী সমাজে আত্মীকরণের প্রয়াসে ত্রুটি রাখেন নাই। তিনি বিলক্ষণ বুঝিয়াছিলেন যে, এই প্রতীচ্যের সংস্কৃতি, তাহাদের জীবনাচরণকে সর্বাংশে ধারণ করার মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে জাগতিক সাফল্যের স্বর্ণদ্বার। তাঁহার সন্তানেরা, যাহারা এই ক্যানাডার মাটিতেই জন্মিয়াছে, এখানেই যাহাদের বৃদ্ধি, তাহারা সেই সাফল্যের শিখরে আরোহণ করিবে, যাহা তাঁহার সাধ্যের অতীত ছিল। সর্বোপরি, তাহাদের নিখুঁত পারঙ্গম বাচনভঙ্গি, বিদ্যায়তনিক উপাধি, আর সম্মুখে বিস্তৃত অপার সম্ভাবনার দিগন্ত। কেবল প্রয়োজন ছিল সেই পুঁজিবাদী জীবন-দর্শনকে আত্মস্থ করা, এই বিজাতীয় সংস্কৃতির ‘মেল্টিং পটে’ (বৈচিত্র্যের পাত্রে) স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়া মিশিয়া যাওয়া, এবং ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তির জন্য এক অতল ক্ষুধা অন্তরে জাগ্রত করা।
সুতরাং, আপনারা সহজেই অনুমান করিতে পারেন তাঁহার সেই ভগ্ন হৃদয়ের চিত্র, যখন তিনি দেখিলেন, আমি তথাকথিত আধুনিক জিন্সের আবরণ ত্যাগ করিয়া এক দীর্ঘ কৃষ্ণবর্ণ ‘আবায়া’-কে (বোরকা) আমার পরিধেয়রূপে বাছিয়া লইলাম। চারি বৎসর পর, আমি আমার সেই শিরোভূষণকে পূর্ণ ‘নিকাব’-এর অবয়বে বর্ধিত করিলাম।
মা আমাকে প্রশ্ন করিলেন, “কেন এই বেশ? তুমি রহিয়াছ ক্যানাডায়, কোনো রিয়াদ বা জেদ্দায় নও। সকলেই তো অবগত যে তুমি মুসলিম। তোমার এই অতিরিক্ত স্বত্বঃপ্রমাণের কী আবশ্যকতা পড়িল?”
আমি তখন অনুধাবন করিতে পারি নাই যে, আমার এই আত্ম-অবমাননা, এই হীনম্মন্যতা ও লজ্জাবোধের শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রাম, যাহা মাত্র ষোড়শ বর্ষে আমার চেতনায় আঘাত হানিয়াছিল, তাহার পূর্ণ স্থিরতা ও প্রশান্তি লাভ করিতে আরও এক দশক ব্যাপিয়া যাইবে।
দৃশ্যমান মুসলিম হইবার বাস্তবতা
আমার অভিজ্ঞতায়, এইখানকার দৈনন্দিন ইসলামবিদ্বেষ, ধরা যাক, ফ্রান্সের তুলনায় কিঞ্চিৎ মৃদু। আমার অধিকাংশ নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই মূলত সূক্ষ্ম অপমানজনক আচরণের (মাইক্রোঅ্যাগ্রেশন) সমষ্টি। ঘৃণাভরা কটুদৃষ্টি, প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ, আগ্রাসী প্রতিবেশী, এবং গা ঘেঁষিয়া চলিয়া যাওয়া ভারী যান—এই সবই তাহাদের বিদ্বেষ। আর সেই ঘৃণা স্পঞ্জের ন্যায় শোষিত হয়, হৃদয়ের গভীরে তাহা তীব্রভাবে অনুভূত হয়।
যখন আমি আমার শহরের এক শ্বেতাঙ্গ-প্রধান, অভিজাত এলাকায় সাশ্রয়ী মূল্যে একটি গৃহ ভাড়া লইলাম, তখন কল্পনা করিতে পারেন, প্রতিবার গৃহের বাহিরে পা ফেলিবার মুহূর্তে আমাকে কী পরিমাণ ধারাবাহিক হেনস্থার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। আমার পরিধেয় দর্শনে অন্য শিশুরা আমার কচি সন্তানের সহিত খেলিতে চাহিত না, আর সমুদ্রতটে লোকে আমাকে দেখিয়া উপহাস করিত। আমার বাহির হইবার ইচ্ছাই লোপ পাইল।
আমার স্বামীকে বিবাহ করিবার পর, আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, আমার ন্যায় তাঁহারও উচিত দৃশ্যমান মুসলিম বেশ ধারণ করা। আমি ‘জিলবাব’ ও ‘নিকাব’-এ আবৃতা থাকিব, আর আমার সঙ্গী জিন্স-টিশার্ট পরিয়া ঘুরিবেন, ইহা বড্ড বেমানান ঠেকিল। তিনি সম্মতি দিলেন, এবং আমরা দুইজনে মিলিয়া এক “দৃশ্যমান মুসলিম দম্পতি” হইয়া উঠিলাম, যাহা ছিল পারিপার্শ্বিকের মধ্যে অতিমাত্রায় দৃষ্টিকটু। তাঁহার নূতন বেশ দেখিয়া লোকে যে তাই ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাইতে পারে, তাহা দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন—বিশেষত যখন তিনি নিজে অর্ধ-শ্বেতাঙ্গ। আমি যে সূক্ষ্ম অপমান নিত্য ভোগ করিতাম, তিনিও তাহা অনুভব করিতে লাগিলেন; যদিও তাহা আমার দৈনিক অভিজ্ঞতার ভগ্নাংশমাত্র ছিল।
কিন্তু এক গভীর সত্য উপলব্ধির পর আমি বুঝিলাম যে, এইভাবে চলিতে পারে না। আমাকে গ্রীষ্মের জনবহুল দিনে উদ্যান বা উন্মুক্ত প্রান্তর এড়াইয়া চলিলে চলিবে না। আমি শিখিলাম, আমার প্রকৃত সত্তায় বিরাজ করা ব্যতীত আমার অন্য কোনো গত্যন্তর নাই। যে বাক্স আমার মাপে নির্মিত হয় নাই, তাহাতে আমি নিজেকে জোরপূর্বক প্রবেশ করাইতে পারি না। আমাদের পূর্ববর্তী যুগের কতিপয় আপোষহীন মুসলিম ব্যক্তিত্বের বাণী শ্রবণ করিবার পর আমার জগতের সমীকরণ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গেল।
যাঁহারা বিংশ শতকের সপ্তম দশকে প্রতীচ্যকে নাড়াইয়া দিয়াছিলেন
আমরা মুহম্মদ আলীকে ইসলামে প্রত্যাবর্তনকারী এবং ৭০-এর দশকের এক মুষ্টিযোদ্ধা হিসাবেই জানি, কিন্তু তিনি যে প্রকৃতই কী পরিমাণ অদম্য ও অকুতোভয় ছিলেন, তাহা জানিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছিলাম। তিনি ত্রুটিমুক্ত ছিলেন না, কিন্তু এই ধরণীর বুকে তিনি যে শিক্ষা রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা অগণিত। মুহম্মদ আলী ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ লইতে স্পষ্ট অস্বীকার করিয়াছিলেন, যদিও তাঁহার সম্মুখে ঝুলিতেছিল দশ হাজার ডলার জরিমানা, কারাবাস এবং তাঁহার মুষ্টিযুদ্ধ অনুজ্ঞাপত্র (লাইসেন্স) বাতিলের খড়গ। তিনি ইসলামিক মূল্যবোধ এবং এক ধর্মহীন (গডলেস) যুদ্ধে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞাকেই ঢাল করিয়াছিলেন। যদিও তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করিয়াছিলেন, যেখানে অবশেষে তাঁহার দণ্ডাদেশ বাতিল হয়, তথাপি ইসলামের নামে তিনি লক্ষ লক্ষ ডলারের সম্ভাব্য আয় এবং তাঁহার ক্রীড়াজীবনের স্বর্ণযুগের চারিটি মূল্যবান বৎসর বিসর্জন দিয়াছিলেন।
ম্যালকম এক্স-ও আমার অনুপ্রেরণার এক প্রধান উৎস। প্রতীচ্যের বুকে কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলিমদের অভিজ্ঞতা লইয়া তিনি কী নিদারুণ সাহসী ও নির্মমভাবে সত্যবাদী ছিলেন! তিনি কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অন্তর্নিহিত হীনম্মন্যতা, আত্ম-অবমাননা এবং সামাজিক বর্জনের যন্ত্রণা লইয়া প্রায়শই আলোচনা করিতেন। কিন্তু একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম হিসাবে, আমি সেই একই যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি মুসলিম অভিজ্ঞতার মধ্যেও সমান্তরালভাবে দেখিতে পাই। এই শিক্ষা সকল নিপীড়িত বর্ণের মানুষের বেদনাকেই ধারণ করিতে পারে। জনসাধারণের নিকট নিজের বক্তব্যকে সহজবোধ্য বা শ্রুতিমধুর করিবার জন্য তিনি কখনও তাঁহার শব্দমালাকে কোমল বা মোলায়েম করিবার তোয়াক্কা করেন নাই।
ম্যালকম এক্স বলিয়াছিলেন: “আমেরিকা একীকরণের প্রচার করে, অথচ বিচ্ছিন্নকরণের অনুশীলন করে।”
“আমি মনুষ্যত্বের ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী, সকল মানুষের ভ্রাতৃত্বে, কিন্তু যে আমার সহিত ভ্রাতৃত্ব চাহে না, আমি তাহার সহিত ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী নহি। আমি মানুষের সহিত সদ্ব্যবহারে বিশ্বাসী, কিন্তু যে জানে না কী করিয়া সদ্ব্যবহারের প্রতিদান দিতে হয়, তাহার সহিত সদ্ব্যবহার করিবার বৃথা চেষ্টায় আমি আমার সময় অপচয় করিতে প্রস্তুত নই।”
আমি উপলব্ধি করিলাম যে, আমার সংগ্রাম ছিল আমার এই আবরণের অন্তরাল হইতে অতিরিক্ত বন্ধুসুলভ, মধুর ও দয়ালু হইবার এক ব্যর্থ প্রয়াস। আমি নিশ্চিত করিতাম যে আমার দৃষ্টি যেন উষ্ণ হয়, আমার কণ্ঠস্বর যেন আত্মবিশ্বাসে ভরিয়া থাকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আমি কেবল নিজের সহিত আত্ম-প্রতারণা করিতেছিলাম। আমি এক অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত ছিলাম—সেই সকল মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পাইবার জন্য, যাহাদের অন্তরে আমার জন্য বিন্দুমাত্র সম্মান ছিল না। তাহারা কখনও তাহাদের কণ্ঠস্বর নরম করিয়া আমাকে বুঝায় নাই যে, তাহারা শান্তির বার্তা লইয়া আসিয়াছে। তাহারা আমার জন্য স্থান সংকুচিত করে নাই, কিংবা কখনও আমার জন্য উষ্ণ বা স্বাগতপূর্ণ পরিবেশও রচনা করে নাই। তবে কেন আমি সেই সকল মানুষের নিকট স্বীকৃতি পাইবার জন্য এত মরিয়া হইয়া উঠিয়াছিলাম, যাহারা আমার দিকে তাকাইতেও পছন্দ করে না—যাহারা আমাকে সহ্য করিতেও কুণ্ঠাবোধ করে?
আমি বহু অমুসলিমের সাক্ষাৎ পাইয়াছি যাঁহারা আমার সহিত অত্যন্ত সদ্ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু তাহা আমার গড় অভিজ্ঞতা নহে। অধিকাংশ সময়ই, তাহারা আমার উপস্থিতি কেবল ‘সহ্য’ করিয়া লয়। এবং ইহার প্রত্যুত্তরে, আমি আর সেই অন্তর্নিহিত হীনম্মন্যতার বোঝা বহন করিব না। আমি তাহাদের গ্রহণযোগ্যতা বা করুণা কিছুই চাহি না। অন্য সকলের ন্যায় আমিও সম্মানের যোগ্য, এবং সেই সম্মানবোধ লইয়াই আমি যে কোনো পরিসরে প্রবেশ করিব। যদি তুমি আমার আবরণের ঊর্ধ্বে আমাকে দেখিতে না পাও, আমিও তোমার অজ্ঞতার ঊর্ধ্বে তোমাকে দেখিব না। আমি আর নিজেকে সংকুচিত করিব না। আমি আমার পূর্ণ সত্তায়, পরিপূর্ণভাবে বিরাজমান। আমি একজন গর্বিত ও আপোষহীন মুসলিম রমনী, এবং লোকে কী ভাবিল, তাহাতে আমার কিছুই যায় আসে না। মানুষকে বুঝাইয়া আমাকে দেখিতে বাধ্য করিবার ব্যবসায় আমি আর নাই। আমি এইখানে দণ্ডায়মান, আবৃতা এবং আত্মপ্রত্যয়ী—তাহারা আমাকে স্বীকার করুক বা না করুক।
মুসলিমদের মধ্যকার অদ্ভুত জটিলতা
কিছুদিন পূর্বে আমি এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হই। জন্মদিন উদযাপনের পৌত্তলিক উৎসের কারণে আমি ও আমার স্বামী বিনীতভাবে একটি জন্মদিনের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলাম। যখন অন্য একটি মুসলিম পরিবার সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করিল, এবং মদ্যপান ও হারাম ভোজ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকিতেও কোনো সমস্যা দেখিল না, তখন আমাদের এই সিদ্ধান্তকে “চরমপন্থা” ও “জটিলতা” বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইল। এই অনুভূতি আমার অতি পরিচিত।
বহুবার আমাকে বলা হইয়াছে যে, আমার ইসলামের প্রতিনিধিত্ব অতিমাত্রায় চরম এবং জটিল—কেবলমাত্র এই কারণে যে, আমি ধর্মের নির্দেশিকাগুলি অনুসরণ করিতে চেষ্টা করি। পর-পুরুষকে আলিঙ্গন না করা বা তাহাদের সহিত করমর্দন না করিবার জন্য অন্য মুসলিমরাই আমাকে কঠিন সময় দিয়াছে। আমি হিজাব পরিহিতা নারীদের নিকট হইতেও ঘৃণাভরা দৃষ্টি পাইয়াছি। অনেকে আমার সালামের প্রত্যুত্তর দেয় নাই। আমাকে বারংবার ইসলামিক মূল্যবোধ আঁকড়াইয়া ধরিবার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাইতে হইয়াছে—অন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধেই।
ইহা আমাকে ব্যথিত করে যে, কিছু মুসলিম সমাজের সহিত মিশিয়া যাইবার এবং বিবাদ সৃষ্টি না করিবার এমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন যে, তাঁহারা সেইসব মুসলিমদেরই তিরস্কার করেন যাহারা ভিন্ন স্রোতে চলিবার দুঃসাহস দেখায়। তাঁহারা এই মুসলিমদের “পশ্চাৎপদ” এবং “সমাজের সহিত তাল মিলাইতে অক্ষম” বলিয়া দাগিয়া দেন। কিন্তু আমরা, মুসলিম হিসাবে, কবে হইতে এই সিদ্ধান্ত লইলাম যে, অমুসলিম প্রথাকে ধারণ করা আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধকে আঁকড়াইয়া ধরিবার চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিল?
এই অভিজ্ঞতা নূতন নহে
আমার প্রায়শই এই হাদীসটির কথা মনে পড়ে:
بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ
“ইসলাম অপরিচিত (অদ্ভুত) অবস্থায় শুরু হয়েছিল এবং তা অচিরেই আবার শুরুর মতো অপরিচিত অবস্থায় ফিরে যাবে। সুতরাং সুসংবাদ সেই অপরিচিতদের (আল-গুরাবা) জন্য।” — (সুনান ইবন মাজাহ ৩৯৮৬)
নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবীগণ ইহার চাইতেও নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা নির্যাতিত, লাঞ্ছিত এবং অনাহারক্লিষ্ট হইয়াছেন। এমনকি স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রশংসিত, মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ)-কেও ক্ষুধা ও সামাজিক বর্জনের শিকার হইতে হইয়াছে। যাহারা একসময় তাঁহাকে ভালোবাসিত, এমনকি তাঁহার পরিবারের লোকেরাও তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান ও উপহাস করিয়াছিল।
উমর (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন:
لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَظَلُّ الْيَوْمَ يَلْتَوِي مَا يَجِدُ دَقَلاً يَمْلأُ بِهِ بَطْنَهُ
“আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে দেখিয়াছি যে, তিনি ক্ষুধার যন্ত্রণায় সারাদিন ছটফট করিতেন। তিনি উদর পূর্তি করিবার মতো সামান্য নিকৃষ্ট মানের খেজুরও পাইতেন না।” — (সহীহ মুসলিম ২৯৭৮)
যাঁহার নামে আমার নামকরণ, সেই সুমাইয়্যা বিনতে খায়্যাত (রাঃ), কেবলমাত্র একটি বাণীর কারণে ভয়াবহভাবে শহীদ হইয়াছিলেন:
لَا إِلٰهَ إِلَّا الله
“আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নাই।”
কত মুসলিম ইসলামের সুরক্ষা করিতে গিয়া অথবা নিজ বিশ্বাসের জন্য নির্যাতিত হইয়া জীবন বিসর্জন দিয়াছেন? ম্যালকম এক্স তাঁহার বাক্যের শক্তি এবং তাঁহার নেতৃত্বের প্রভাবে আততায়ীর হস্তে নিহত হইয়াছিলেন। আর আমি এখানে, আমার নিকাব পরিয়া সাহসের সহিত চলিতে সংগ্রাম করিতেছি, কারণ আমি ভীত ছিলাম যে লোকে আমার প্রতি রূঢ় আচরণ করিবে, আমাকে কটুদৃষ্টিতে দেখিবে, অথবা আমাকে দেখিয়া বিদ্রূপ করিবে।
যদি আল্লাহর প্রতি আমার বিশ্বাস সত্য হয়, যদি ইসলামই হয় সেই শ্বাশত ও ঋজু ধর্ম, তবে আমি কী করিয়া অবিশ্বাসীদের আমার অন্তরে লজ্জা সৃষ্টি করিতে দিতে পারি? যদি আল্লাহ স্বয়ং বিশ্বাসীদের ভালোবাসেন ও তাহাদের মর্যাদা দান করেন, তবে আমি কী করিয়া হীনম্মন্যতাকে আমার উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে দিতে পারি? আমার প্রকৃতই এক জাগরণ ঘটিয়াছে। আমার প্রকৃত সত্তায়, আমার সাধ্যমতো খাঁটিভাবে বিরাজ করা ব্যতীত আমার অন্য কোনো গত্যন্তর নাই। লোকে তাহা কীভাবে গ্রহণ করিল, সেই বিষয়ে আমি আর বিন্দুমাত্র চিন্তিত নহি।