ইসলামী পারিবারিক জীবন
নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে একটি পরিবার। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার হচ্ছে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট বা শাখা। পরিবারের জন্ম তথা উৎপত্তি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে সামাজিক জীবনের প্রাথমিক বুনিয়াদ বৈবাহিক সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই জন্য ইসলাম সমাজে বিবাহ প্রথাকে সহজতর করে দিয়েছে। কতিপয় নিকটাত্মীয় এবং পৌত্তলিক নারী ব্যতীত সকলের সাথে বিবাহ বন্ধনকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অতঃপর পারিবারিক জীবনে যদি কোন প্রকার বিঘ্নের সৃষ্টি হয়, যাতে কোন অবস্থাতে ঐক্যবিধান সম্ভব হয়ে না ওঠে, তাহলে পুরুষের জন্য তালাক এবং স্ত্রীর জন্য ‘খোলা’র (দেনমোহর মাফ করে দেয়া বা অন্য কোন অর্থ বা সম্পদ দানের মাধ্যমে স্বামীর নিকট তালাক গ্রহণ) অধিকার ইসলামে স্বীকৃত রয়েছে। এ ভাবেই ইসলাম নারী-পুরুষের অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। ইসলাম পবিত্র বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে সামাজিক পবিত্রতা রক্ষার যে সুন্দরতম বিধান দিয়েছে তার ব্যতিক্রমে সামাজিক পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তাই সে এ পন্থায় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে উদ্ভূত সমস্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছে এবং বিবাহ পদ্ধতিকেও সহজ করে দিয়েছে। এমনকি এক স্ত্রীতে যদি কারও বাস্তব অসুবিধা থাকে সেক্ষেত্রে তাকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণেরও অনুমতি দিয়েছে। তবুও যদি কেউ শরীয়তের নিয়ন্ত্রণসীমা অতিক্রম করে অবৈধ যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হয় তাহলে তার জন্য কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে। ইসলামী শরীয়ত এরূপ অপরাধীর জন্য কশাঘাত এবং প্রস্তর আঘাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়েছে।
পারিবারিক জীবন এবং নারী-পুরুষের দায়িত্ব
পারিবারিক জীবন এবং নারী-পুরুষের কর্মসীমা ও দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলাম বিশেষ কতগুলো পথনির্দেশ প্রদান করেছে। নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত দিকগুলো আলোচনা করা হলো:
ক. আল্লাহ্ পুরুষকে পরিবার তথা সংসারের অভিভাবক করে সৃষ্টি করেছে। শুধু তা-ই নয়, অর্থোপার্জন এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের গুরুদায়িত্বও অর্পিত হয়েছে পুরুষের ওপর। মহান আল্লাহ বলছেন:
﴿ٱلرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَآ أَنْفَقُواْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ﴾
"পুরুষরা নারীদের ওপর দায়িত্বশীল (কর্তৃত্বের অধিকারী) এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের কতককে (পুরুষকে) কতকের (নারীর) ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং যেহেতু তারা (নারীদের জন্য) তাদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে থাকে।” (নিসা: ৩৪)
আলোচ্য আয়াতে পরিবারের গণ্ডিতে নারীদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব যে পুরুষের তার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। আয়াতে পরিবারে নারীদের ওপর পুরুষদের কর্তৃত্ব ও অভিভাবকত্বের বিষয়টি নারী-পুরুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্বের দিককে পরিবারের গণ্ডির বাইরে সকল ক্ষেত্রে (জ্ঞান, চরিত্র, কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা) সার্বিক ভাবার কোন অবকাশ নেই এবং কখনই তা সার্বিকভাবে সকল নারীর ওপর সকল পুরুষের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলছে না। কারণ, পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে শ্রেষ্ঠত্বের যে ক্ষেত্রগুলো বর্ণিত হয়েছে তা নারী-পুরুষ সকলের জন্য অর্জনযোগ্য বলেছে এবং হযরত মারইয়াম (আ.), হযরত আছিয়ার মত নারীদের পুরুষদের জন্যও আদর্শ গণ্য করেছে (সূরা তাহরীম: ১১ ও ১২)। তাছাড়া অনেক নারীই প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে পুরুষদের ছাড়িয়ে যেতে পারে বা প্রকৃতিগতভাবেই অধিকতর যোগ্যতার অধিকারী হতে পারে। কিন্তু তার এ যোগ্যতা সত্ত্বেও পরিবারের দায়িত্বশীল পুরুষই থাকবে।
অপর পক্ষে নারীর ওপর অর্পিত হয়েছে ঘরকন্না, শিশুপালন, শিশুর শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাংসারিক দায়িত্ব। মহানবি (সা.) বলেছেন: নারী তার স্বামীর গৃহের কর্ত্রী হিসাবে তার স্বামী ও সন্তানদের দায়িত্বশীল (বুখারী, হাদিস নং ৭১৩৮ ও মুসলিম, হাদিস নং ১৮২৯) অপর এক হাদিসে এসেছে যে, এক নারী মহানবি (সা.) এর নিকট এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমার এমন একটি প্রশ্ন আছে যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল নারীর প্রশ্ন আর তা হল: কেন ইসলাম পুরুষ ও নারীর মধ্যে সওয়াবের ক্ষেত্রে পার্থক্য করেছে? কেননা অনেক কাজ আছে যাতে পুরুষরা সওয়াব লাভ করে কিন্তু নারীরা তা থেকে বঞ্চিত যেমন জিহাদ ও সীমান্তরক্ষা…।’ মহানবি (সা.) বললেন: নারীর জন্য জিহাদ ও সংগ্রাম হল উত্তম পরিবার ব্যবস্থাপনা।
হযরত আলীও বলেছেন: আল্লাহ পুরুষ ও নারী উভয়ের ওপরই জিহাদ ফরয করেছেন। তবে পুরুষের জন্য জিহাদ হল জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা ও নিহত হওয়া; কিন্তু নারীর জন্য জিহাদ হল উত্তমরূপে সংসার পরিচালনা করা। (ওয়াসায়িলুশ শিয়া, ১১তম খণ্ড, পৃ.১৫)
হযরত আলী নারীদের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন: নারীদের ওপর তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দিও না। কেননা, তারা বসন্তের ফুলের ন্যায়, বলবান বীর নয়। (নাহজুল বালাগা, ৩১ নং পত্র)
ইসলাম নারীর ওপর পর্দার নির্দেশ জারি করেছে এবং তাকে সংসারের অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব
লনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ ছাড়া ইসলাম স্বাভাবিক অবস্থায় নারীকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে, নিষেধ করেছে তার অলংকার ও রূপ সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করতে। হ্যাঁ, বিশেষ প্রয়োজনবশত বাইরে যেতে হলেও পর্দা রক্ষা করে যেতে বলা হয়েছে:
﴿وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُولَىٰ﴾
‘নিজ নিজ ঘরে অবস্থান কর। অন্ধকার যুগের নারীরা যেভাবে সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বাইরে ঘোরাফেরা করত তদ্রূপ কর না।’ (আহযাব: ৩৩)
খ. নারী-পুরুষ তথা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ককে অত্যন্ত পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর এই পারস্পরিক সম্পর্ককে উন্নত ও নিবিড় করার জন্য কুরআন মানব-মানবীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। উভয়কে উভয়ের প্রতি আন্তরিকতা এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনের ভাষায়:
﴿...هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ...﴾
‘তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরাও তাদের পরিচ্ছদস্বরূপ...।’ (বাকারা: ১৮৭)
﴿وَمِنْ آيَاتِهِ اَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ اَنفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا اِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً﴾
‘আল্লাহর বহুবিধ নিদর্শনের মধ্যে এও একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য নারী (স্ত্রী) সৃষ্টি করেছেন। উদ্দেশ্য, তোমরা তাদের দ্বারা আনন্দ ও শান্তি লাভ করবে। বস্তুত আল্লাহ্ তোমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম ও সহানুভূতির উদ্রেক করেছেন।’ (রূম: ২১)
বলাবাহুল্য স্বামী-স্ত্রী উভয় উভয়ের জন্য শান্তির আধার।
গ. নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্কের উদ্দেশ্য শুধু আনন্দ উপভোগ, যৌন সম্ভোগ এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করাই নয়, স্বয়ং একে ইসলামী শরীয়া একটি তামাদ্দুনিক/সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলেই গণ্য করেছে। এর মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের বংশধারা সংরক্ষণ। এই উদ্দেশ্য ঠিক তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে, যখন নারীসমাজ একমাত্র সন্তান জন্ম দেওয়াকেই যথেষ্ট মনে না করে; বরং সন্তান জন্ম দেওয়ার সাথে সাথে তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং প্রতিপালনের সুষ্ঠু দায়িত্বও নারীকে পালন করতে হবে। এ কারণেই কুরআনে নারীকে (মানব বংশ উৎপাদনের) ‘ক্ষেত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বিশেষ প্রক্রিয়া ও কর্মপ্রণালীর মাধ্যমে ক্ষেত থেকে যেমন ফসল উৎপন্ন হয়, তেমনিভাবে নারী জাতির ক্রোড় থেকেও আদম সন্তানকে উপযুক্তভাবে তৈরি হয়ে সমাজে পদার্পণ করা উচিত।
ঘ. ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের ওপর নির্ভরশীল। একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে যাবতীয় দিক দিয়ে সমভাবে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলাম পুরুষদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিশেষ কারও প্রতি ঝুঁকে পড়তে নিষেধ করেছে। আদেশ করা হয়েছে ভারসাম্য রক্ষার জন্য।
﴿...فَلاَ تَمِيلُواْ كُلَّ ٱلْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَٱلْمُعَلَّقَةِ...﴾
‘...তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড় না এবং অপরকে ঝুলানো অবস্থায় রেখ না।...’ (নিসা: ১২৯)
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি এটা এক পর্যায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদেরও কারণ হয়ে যেতে পারে। যদি এই রূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তবে তা ভব্যজনোচিত এবং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই হতে হবে। এমনকি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে যা ইতঃপূর্বে দেওয়া হয়েছিল তা ফিরিয়ে নিতে নিষেধ করা হয়েছে।
﴿وَإِنْ أَرَدْتُّمُ ٱسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَّكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَاراً فَلاَ تَأْخُذُواْ مِنْهُ شَيْئاً أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَاناً وَإِثْماً مُّبِيناً﴾
‘যদি তোমরা এক স্ত্রীর (তালাক দিয়ে তার) স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও এবং তাদের (স্ত্রীদের) একজনকে অনেক ধন-সম্পদও দিয়ে থাক, তা থেকে কিছুই ফেরত নিও না।’ (নিসা: ২১) বরং আরও অতিরিক্ত দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে:
﴿...فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّحُوهُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا﴾
‘...তাদেরকে আরও কিছু মালসামগ্রী প্রদান করে সুন্দর তথা ভদ্রভাবে বিদায় দাও।’ (আহযাব: ৪৯)
পরিবারে মাতা-পিতা ও সন্তানদের পারস্পরিক সম্পর্ক
স্বামী-স্ত্রীর কর্মক্ষেত্র ও কর্মসীমা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের সুষ্ঠু পদ্ধতিসমূহ বর্ণনা করার পর মাতা-পিতা ও ছেলে-মেয়েদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। পিতা-মাতার সাথে ছেলে-মেয়েদের কীরূপ সম্পর্ক এবং ব্যবহার হওয়া উচিত এ ব্যাপারে কুরআনের সুস্পষ্ট এবং ব্যাপক শিক্ষা রয়েছে। বলা হয়েছে যে, তাদের (মাতাপিতাকে) ‘উহ্’ করার মতো কষ্টদায়ক কথাও যেন বল না। অর্থাৎ তোমাদের কথা এবং কাজে এমন কিছু কর না যা তাদের জন্য মনোকষ্টের কারণ হতে পারে। কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে:
﴿وَٱخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِى صَغِيراً﴾
‘তাদের সামনে ভালবাসার সাথে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (বনি ইসরাঈল: ২৪)
এ ছাড়া পিতা-মাতা যতক্ষণ
ন্ত ইসলামী শিক্ষা ও মূলনীতির স্পষ্ট বিরোধী কোন নির্দেশ না দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের আদেশ অমান্য করা যাবে না। অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা ও মূলনীতির স্পষ্ট পরিপন্থী কোন নির্দেশ পিতা-মাতা কর্তৃক ছেলে-মেয়েদের ওপর আরোপিত হলে তা পরিত্যাজ্য। অপর পক্ষে ছেলে-মেয়েদের সৎ ও উপযুক্ত নাগরিকরূপে গড়ে তোলার জন্য পিতা-মাতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলাম অন্ধকার যুগের অনুসরণে খাদ্যাভাব এবং দারিদ্র্যের ভয়ে শিশু তথা সন্তান-সন্ততিকে হত্যা করতে নিষেধ করেছে। এরূপ কর্মকে অমার্জনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পিতা-মাতার অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল কাজের নির্দেশ দেওয়া এবং অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখা।
হযরত ইসমাইল (আ.)-এর আলোচনা প্রসঙ্গে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি (ইসমাইল) তাঁর পরিবারবর্গকে নামায প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদান করার নির্দেশ দিতেন। (মারইয়াম: ৫৫)
এছাড়া কুরআন মুমিনদেরকে তাদের পরিবারের উদ্দেশ্যে একটি সুন্দরতম দো‘আ শিক্ষা দিয়েছে। দো‘আটি এই:
﴿وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ اَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ اِمَامًا﴾
‘...হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রীবর্গ ও সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে আমাদের চক্ষুসমূহের উজ্জ্বলতা দান কর এবং আমাদের মুত্তাকী তথা খোদাপরায়ণ লোকদের ইমাম নিযুক্ত কর।’ (ফুরকান: ৭৪)
আলোচ্য আয়াতে ‘মুত্তাকী’ অর্থে তাফসীরকারগণ পরিবারভুক্ত লোকদের বোঝাতে চেয়েছেন।
পরিবার সংগঠনের পর ইসলাম আত্মীয়বর্গের সাথে সৌহার্দ্র্য প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে কোন তারতম্য করা হয়নি; বরং সকলই এর মধ্যে শামিল রয়েছে। ইসলামের উপস্থাপিত এই মূলনীতি ও নির্দেশ অনুযায়ী রক্ত অথবা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে একটি দৃঢ়বন্ধন এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে। একই পরিবারভুক্ত লোকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য পরস্পরকে সহানুভূতিশীল এবং দয়াদ্রচিত্ত হওয়ার তাকিদ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে নিকট আত্মীয়ের হক অধিক। তাই নিকটাত্মীয়ের সাথে সমধিক সৌহার্দ্র্য রক্ষা করার জন্য কুরআনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
﴿...وَبِٱلْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً وَذِى ٱلْقُرْبَىٰ...﴾
‘...পিতা-মাতা এবং নিকট আত্মীয়দের সাথে ইহসান কর...।’ (বাকারা: ৮৩)
সন্তানদের শিষ্টাচার শিক্ষা
﴿وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ٭وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ﴾
‘যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল: হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক কর না, কেননা শিরক হল মহা অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, অবশেষে আমারই দিকে ফিরে আসতে হবে। আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (লুকমান: ১৩-১৪)
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অধিকার সম্পর্কে বলেছেন:
‘আর তোমার সন্তানের অধিকার হলো এটা জানবে যে, সে তোমার থেকেই এবং এই দুনিয়ায় তোমার সাথেই সম্পর্কযুক্ত, ভালো হোক আর চাই মন্দ হোক। তোমার উপরই তার পৃষ্ঠপোষকতার ভার। তাকে ভালভাবে প্রতিপালন এবং তার মহাপ্রতিপালকের প্রতি নির্দেশনা দানের মাধ্যমে এবং তাকে তোমার ব্যাপারে ও তাঁর নিজের ব্যাপারে আনুগত্যের ক্ষেত্রে সাহায্য করার মাধ্যমে তুমি সওয়াব লাভ করবে। আর অবহেলা করলে শাস্তি পাবে। কাজেই তার জন্য এমন কোন কাজ করো যাতে অস্থায়ী এ দুনিয়ায় তার সুফল পায়, আর তোমার ও তার মধ্যে সম্পর্ককে শোভামণ্ডিত কর, যাতে প্রতিপালকের কাছে তাকে উত্তমরূপে পৃষ্ঠপোষকতা এবং তার থেকে যে খোদায়ী ফল লাভ করেছ তার কারণে ক্ষমার পাত্র হতে পারো।’
সুতরাং ইসলাম পরিবারকে উত্তম সমাজের ভিত্তি বলে গণ্য করেছে এবং একে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বিধানও বর্ণনা করেছে। সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পারিবারিক জীবনে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রগুলোকে আলাদা করেছে। ইসলামের পরিবার ব্যবস্থায় নারী-পুরুষ উভয়কে তার আত্মিক অবস্থানুযায়ী দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তারা একে অপরের পরিপূরক। তারা স্ব স্ব স্থানে তাদের দায়িত্ব পালন করলেই কেবল একটি পরিপূর্ণ ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব