আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কেন এত উদ্বিগ্ন সঙ্ঘ পরিবার?
বর্তমান ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় কিছু জটিল সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাম মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্টা অযোধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে 16 শতকে মুঘল সম্রাট বাবরের দ্বারা নির্মিত একটি মুসলিম মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সংঘ পরিবার সারা দেশে এটি উদযাপন করে। এর পরপরই জেলা আদালতের রায়ে জ্ঞানবাপী মসজিদের ভেতরে পুজোর অনুমতি দেওয়া হয়। কয়েকদিন পর উত্তরাখণ্ডে মাদ্রাসা ও মসজিদ ধ্বংস করা হয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথের বক্তব্য অনুসারে কাশী এবং মথুরা সহ দুই হাজারেরও বেশি মসজিদ তালিকায় রয়েছে। এই তালিকায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত মুসলিম ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং স্মৃতিস্তম্ভ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, এমনকি তাজমহলও এর ব্যতিক্রম নয়।
সকল সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার। তারা যে সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তার গভীরতা বাড়ছে। এটা কিভাবে মোকাবেলা করা যায়?
এদিকে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু মর্যাদা সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বিস্তারিত শুনানি শেষ করে রায় স্থগিত করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করলেও কেউ হতবাক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আলীগড়ের প্রাসঙ্গিকতা শুধুমাত্র উচ্চ শিক্ষার বর্ণালীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি নয়। স্বাধীনতার পর ভারতীয় মুসলমানদের বেঁচে থাকা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের করুণ অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য সমাজ নেতারা অনেক উপায় অন্বেষণ এবং প্রয়োগ করেছেন। তাদের মধ্যে, আলীগড় সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং সামগ্রিকভাবে ভারতীয় মুসলমানদের প্রভাবিত করেছে। আলীগড় এমন একটি পাঠ্যক্রম যা আজও সমাজ সেখান থেকে লাভবিত।
1857 সালে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমানরা সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছিল। ব্রিটিশরা তাদের বিরুদ্ধে বিরল প্রতিশোধ গ্রহণ করে। দিল্লি, কানপুর, লখনউতে মুসলিম নিধন সংঘটিত হয়। মুঘল সাম্রাজ্য, যা ভারতীয় মুসলমানদের শুধুমাত্র আত্মমর্যাদার প্রতীক ছিল, অপ্রতিরোধ্যভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। রাজপরিবারের প্রায় সকলেই ইংরেজদের বন্দুকের শিকার হয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত এই স্বাধীনতা বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী আলেমদের নির্বাসিত বা কারাগারে পাঠানো হয় যেহেতু তারা ব্রিটিশদের দৃষ্টিতে জনপ্রিয় ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনাকারী ও পরিচালনাকারী। 1875 সালের অভ্যুত্থানের পরে ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় ভবিষ্যতের অতল গহ্বরে নিপতিত হয়ে যায়। ধর্ম এবং সম্পর্কিত নীতিগুলি তাদের হাতে থাকে, কিন্তু চাষবাস বা শাসন প্রশাসন তাদের হাতে ছিল না।
এই অবসরে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং আলীগড় আন্দোলনের আলোচনা প্রযোজ্য হয়ে উঠে। তিনি এমন একজন নেতা যিনি ভারতীয় মুসলমানদের একত্রে বাঁধবার চেষ্টা করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানদের গতিপথে একটি অপরিচিত পথ প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নতুন ধারণা এবং কর্মের কারণে অনেকের দ্বারা সমালোচিত হয়। ভারতে মুসলমানদের আগমনের পর থেকেই তাদের জীবন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সামাজিক অগ্রগতির চর্চা করা হয়েছে।
মুসলিম শাসন এবং সুফি সম্প্রদায় যা নিরবচ্ছিন্ন সামাজিক-জনসেবা-প্রচার কার্যক্রমকে সম্ভব করে তুলেছিল। ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংস্কার কার্যক্রম এবং মুঘল শাসনের শেষ পর্যায়ে পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ ঔপনিবেশিক বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের বেঁচে থাকার উপায়।
কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং আলীগড় আন্দোলন একটি নতুন চিন্তাধারা নিয়ে আসে যা সে সময়ে মুসলিম নেতা ও পণ্ডিতদের চিন্তা বা বিবেচনার বাইরে ছিল।
আহমেদ খান ঔপনিবেশিকতার সাথে তীব্র দ্বিমত পোষণ করেন। ইসলাম ও মুসলমানদের সুরক্ষাই তাঁকে একজন চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক এবং শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের নায়ক করে তুলে। তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম পক্ষ থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন। 1857 সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তিনি ব্রিটেনসহ আধুনিক ইউরোপের সামরিক, বেসামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকেও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি ভাবেন, এমন এক পর্যায়ে ভারতীয় মুসলিম কীভাবে এগিয়ে যাবে। আলীগড় আন্দোলন এই কারণে গঠিত হয়েছিল।
তিনি এই পন্থা এমনভাবে গ্রহণ করেননি যে আজকের জন্য যা প্রয়োজন তাই যথেষ্ট এবং বাকিগুলি পরে চিন্তা করবেন। ভবিষ্যতের সকালকে উজ্জ্বল করার জন্য কী একত্রিত করা উচিত তা সম্পর্কে তিনি দূরদৃষ্টির মানুষ ছিলেন। তিনি ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির অভিপ্রায়ে ব্রিটিশদের দ্বারা বাস্তবায়িত নতুন শিক্ষামূলক পরিকল্পনার ফলাফল বুঝতে পেরেছিলেন। কলকাতা, মাদ্রাজ ও এলাহাবাদে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেক কলেজের অংশ থাকেন তিনি। এই সব প্রতিষ্ঠানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা পড়াশোনা করত। মুসলিম জনসংখ্যাকে নিরুৎসাহিত করা হত। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গঠন যা ক্ষমতা-সম্পদের জন্য দর কষাকষি করতে সক্ষম এবং প্রয়োজনে স্ট্রাইক করে ব্রিটিশদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। আহমদ খান বুঝতে পেরেছিলেন যে এই শিক্ষামূলক পরিকল্পনা থেকে সরে আসা মুসলমানদের উচ্চ হিন্দু মধ্যবিত্তের চোখে অকার্যকর করে তুলবে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতামূলক স্তর তৈরি করা। সৈয়দের পর্যবেক্ষণ ছিল সশস্ত্র সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি। বর্তমানে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয় রক্ষার জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রয়োজন যথেষ্ট।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলীগড় আন্দোলন এই ধারণার বাস্তবায়ন। বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য তিনি বহু বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ করেছেন। তিনি দেখেন যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে যে খ্রিস্টান চার্চ। এই দেখে তৈরি হয় আলীগড় ক্যাম্পাসের স্যার সৈয়দ মসজিদ। সৈয়দ বলেন, উর্দু ভাষা ভারতের বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই কংগ্রেস হিন্দি ভাষার সুরক্ষার দাবি জানালে তিনি জোর দিয়েছিলেন যে উর্দুকেও একই সুরক্ষা দেওয়া উচিত।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কিছু চরম অবস্থানও তাঁর মধ্যে দেখা যায়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাঁর মরিয়া প্রচেষ্টায় কিছু অতিরঞ্জন ঘটতে পারে, কিন্তু কিছু সময়ে তিনি যে সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তা পরবর্তী সম্প্রদায়কে উন্নত শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান প্রদান করে।
সম্প্রদায়ের প্রতি আলিগড়ের অবদান হল এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করা যা ভারতে মুসলিম পরিচয় বজায় রাখে। আলিগড়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণে শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আরএসএস টার্গেট করে আসছে। যেমনই হোক না কেন, আলিগড় এখনও ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা তাদের পরিচয়কে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত করে ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী করে তোলে।