ডিজিটাল ইবলিস’ শব্দটি কি অতিরঞ্জিত না বাস্তবতা? – যুক্তির আলোকে বিচার
সূচনা
আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (সোশ্যাল মিডিয়া) ছাড়া অনেকেরই একটি দিনও কাটে না। এই প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করে তুলেছে, তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও সামনে এনেছে। তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ রক্ষা, শিক্ষা, এমনকি ইসলামের দাওয়াহ প্রচারেও সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কেউ কুরআন পাঠ করছে, কেউ ইসলামী জ্ঞান শিখছে কিংবা প্রচার করছে।
তবে, এই ব্যবস্থার সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি আমরা প্রায়শই এমন কিছু কাজ করে ফেলি, যা আমাদের ঈমান ও নৈতিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমরা গাফেল হয়ে পড়ি, কখনো কখনো হারাম ও অশোভন বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট হই, যা আমাদের আত্মিক ও সামাজিকভাবে বিপদগ্রস্ত করতে পারে।
অনেক ইসলামি আলেম সোশ্যাল মিডিয়াকে “শয়তানের ডিজিটাল ফাঁদ” আখ্যা দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে প্রশ্ন হলো—এটা কি বাস্তবতা, না কি অতিরঞ্জন? যদি সত্যি হয়, তাহলে কীভাবে এটি আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে? এবং আমরা কিভাবে এই ফাঁদ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি? এই প্রশ্নগুলোর যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো।
সোশ্যাল মিডিয়া: শয়তানের ডিজিটাল ফাঁদ?
নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সোশ্যাল মিডিয়াকে “শয়তানের ডিজিটাল ফাঁদ” হিসেবে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে—
১. সময় অপচয় ও গাফেলতায় ডুবে যাওয়া
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত। কুরআনে আল্লাহ বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ ٱلْجِنَّ وَٱلْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।” (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)
শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু, এমন ঘোষণাও কুরআনে রয়েছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে শয়তান প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আমাদের ইবাদত থেকে দূরে রাখছে। আমরা বলি "শুধু ৫ মিনিট ব্যবহার করব", কিন্তু তাতে গাফেল হয়ে পড়ি। অপ্রয়োজনীয় কনটেন্ট, হারাম দৃশ্যাবলি, এবং অবাঞ্ছিত আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে আমাদের মূল্যবান সময় ও মনোযোগ নষ্ট হয়।
২. পর্দাহীনতা ও রিয়া (লোক দেখানো ইবাদত)
সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোতে (যেমন: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম) ছবি ও ভিডিও আপলোডের প্রবণতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। নারীরা পর্দাহীনভাবে ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করছে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য, যা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনার পরিপন্থী। তরুণ-তরুণীরা “কত লাইক পড়লো”, “কে কত ফলোয়ার পেল”—এই ধরনের প্রবৃত্তির মধ্যে নিমজ্জিত।
রিয়াও এই প্ল্যাটফর্মে এক বড় সমস্যা। কেউ দান-সদকা করলে বা ইবাদত করলে তা গোপন রাখার কথা ইসলামে বলা হয়েছে। হাদীসে এসেছে,
عن أبي هريرة قال سمعتُ رسولَ الله ﷺ يقول: "سبعةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يومَ لا ظِلَّ إلَّا ظِلُّهُ..." فذكر الحديث، وفيه:
"ورجلٌ تصدَّق بصدقةٍ فأخفاها، حتى لا تعلمَ شِمالُه ما تُنفقُ يمينُه." متفقٌ عليه
আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“সাত ব্যক্তি আছে, যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাঁর ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না…—“আর এমন একজন ব্যক্তি, যে এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা ব্যয় করে, তা বাম হাতও জানে না।” (বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক সহিহভাবে বর্ণিত)
৩. জিনা ও অশ্লীলতার প্রসার
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে অর্থ উপার্জনের জন্য নিজের অশালীন ভিডিও আপলোড করছে, যাকে আমরা “পর্নোগ্রাফি” নামে জানি। অনেক তরুণ চোখের জিনা (অশ্লীল দৃশ্য দেখা) এবং হাতের জিনায় (স্বমেহন) অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের আচরণ শুধু ব্যক্তির চারিত্রিক অধঃপতন নয়, বরং সামাজিক ব্যাধির জন্ম দিচ্ছে।
শয়তানের ডিজিটাল ফাঁদ থেকে বাঁচার উপায়
নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে একজন মুসলিম সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন—
১. নিয়ত বিশুদ্ধ করা
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার পূর্বে নিজেকে জিজ্ঞেস করা দরকার—আমার উদ্দেশ্য কী? এটি কি ইবাদতের পথে সহায়ক, না গুনাহর পথে নিয়ে যাচ্ছে? আল্লাহর ভয় এবং জাহান্নামের শাস্তির স্মরণ আমাদের সংযত রাখতে সাহায্য করবে।
২. সীমিত ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার
সময় নির্ধারণ করে ব্যবহার করা এবং শুধুমাত্র উপকারী, শিক্ষনীয় ও দাওয়াহমূলক কনটেন্ট দেখা উচিত। বিনোদনের নামে গাফেল হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. দ্বীনি আলেম ও ইসলামি কনটেন্ট অনুসরণ করা
বিশ্বস্ত আলেম ও ইসলামি চ্যানেলগুলো অনুসরণ করলে জ্ঞানে উন্নতি হবে এবং ঈমান রক্ষা পাবে। এ ধরনের কনটেন্ট মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনে।
৪. বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া
পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং সৎ বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। বই পড়া, সমাজসেবামূলক কাজ এবং দ্বীন শেখার মাধ্যমে অনলাইনের আসক্তি কমানো সম্ভব।
প্রতিফলন
সোশ্যাল মিডিয়া নিজে হারাম নয়, বরং আমাদের ব্যবহার যদি ইসলামি আদর্শের বিরোধী হয়, তবেই এটি হারাম রূপ ধারণ করে। ইবলিস আমাদেরকে আনন্দ ও বিনোদনের মাধ্যমে ধ্বংসের পথে পরিচালিত করছে—যেমন শিকার ধরার আগে মাছকে সুস্বাদু খাবার দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়।
তাই মুসলিমদের উচিত ইসলামি জ্ঞান অর্জন করে এই ডিজিটাল ফাঁদ থেকে বেঁচে থাকা এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে দ্বীনের প্রচার ও নেক কাজের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এই ফাঁদ থেকে রক্ষা করুন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যথাযথ ব্যবহার করার তাওফিক দান করুন। আমীন।