ওয়াক্ফ সম্পত্তি ও সাম্প্রতিক সংশোধনী বিল: মুসলমানদের ঈমান, অধিকার ও ভবিষ্যতের এক গভীর সংকট
প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা,
বর্তমানে আমাদের সামনে এক মারাত্মক ও গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের সংসদে ‘ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল’ নামে একটি নতুন আইন পাশ হয়েছে, যা মুসলিম সমাজের জন্য কেবল একটি আইনি পরিবর্তন নয়—বরং এটি আমাদের ঈমান, আমাদের দ্বীনি প্রতিষ্ঠান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এক বিপর্যয়কর আঘাত।
এই প্রবন্ধে আমরা বোঝার চেষ্টা করব, ওয়াক্ফ কী, এর গুরুত্ব কতটা, নতুন বিলে কী পরিবর্তন এসেছে, এবং এসব পরিবর্তনের পরিণতি আমাদের সমাজের ওপর কী হতে পারে।
ওয়াক্ফ কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
‘ওয়াক্ফ’ শব্দের অর্থ হলো কোনো ব্যক্তি তার সম্পদ বা সম্পত্তি আল্লাহর নামে দান করে দেয়—এই শর্তে যে তা কেবলমাত্র দ্বীনি কাজে ব্যবহার হবে এবং তা চিরস্থায়ীভাবে মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হবে।
উদাহরণস্বরূপ:
মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, পানির হাউস, গরীবদের জন্য হাসপাতাল, দরগা বা খানকা, ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ।
ওয়াক্ফের মূল বৈশিষ্ট্য হলো:
একবার কোনো কিছু ওয়াক্ফ হলে, সেটি আর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে না। সেটি হয়ে যায় আল্লাহর সম্পত্তি, যা কেবলমাত্র তাঁর রাস্তায় ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত।
ইসলামের ইতিহাসে, ওয়াক্ফ ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে যুগ যুগ ধরে মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষিত হয়েছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই হাজার হাজার আলেম, হাফেজ, মুফতি, ও দ্বীনি নেতা তৈরি হয়েছে, যারা মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনার বাতিঘর হিসেবে কাজ করছেন।
নতুন ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল কী পরিবর্তন এনেছে?
ভারতে সম্প্রতি পাস হওয়া নতুন ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল মুসলমানদের জন্য চরমভাবে উদ্বেগজনক। এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরা হলো:
১. অমুসলিমদের ওয়াক্ফ বোর্ডে নিয়োগ:
এটি সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা মানে হলো—যারা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানেন না বা মানেন না, তারা সিদ্ধান্ত নেবেন কোন মসজিদ থাকবে, কোন মাদরাসা ধ্বংস হবে! এটি ইসলামিক স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ।
২. সরকারের সম্পূর্ণ দখলাধিকার:
এই বিলে সরকারের এমন অধিকার দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেকোনো ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিজেদের ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করতে পারে। ফলে মাদরাসা, কবরস্থান বা দরগাহ ভেঙে সেখানে মার্কেট, অফিস, এমনকি এমন কিছু নির্মাণ হতে পারে যা ইসলামের পরিপন্থী।
৩. মুসলমানদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস:
ওয়াক্ফ বোর্ড কার্যত সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। মুসলিম সমাজ, আলেম সমাজ, বা দাতাগণের মতামত আর গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না। এটি মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নামান্তর।
৪. আয়ের গোপনতা:
ওয়াক্ফ সম্পত্তি থেকে কী পরিমাণ আয় হচ্ছে, কোথায় খরচ হচ্ছে—এই তথ্য মুসলমানদের থেকে গোপন রাখা যাবে। এটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই বিলের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি কী?
মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংসের মুখে পড়বে। হাফেজ, আলেম তৈরির ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গরীব মুসলমানদের জন্য থাকা সমাজসেবা বন্ধ হবে। মুসলিমদের দান করা সম্পদ অমুসলিম বা সরকারি মালিকানায় চলে যাবে। ইসলামিক চিহ্ন, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে।
এটি কেবল একটি আইন নয়, বরং মুসলিম সমাজের আত্মার ওপর এক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন!
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের দায়িত্ব :
এই সময়ে আমাদের ঈমানদার মুসলমান হিসেবে চুপ থাকা চলবে না। কুরআনের নির্দেশ খুব স্পষ্ট:
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু (ধর্ম) শক্ত করে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান – আয়াত: ১০৩)
وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ
“তোমরা যালিমদের প্রতি ঝুঁকিও না, নইলে আগুন তোমাদের ছুঁয়ে ফেলবে।”
(সূরা হুদ – আয়াত: ১১৩)
আমাদের করণীয় :
১. সচেতনতা ছড়ান:
নিজে জানুন, পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, বন্ধুদের জানান।
২. ঐক্য গড়ে তুলুন:
আলেম, শিক্ষক, ছাত্র, ইসলামিক সংগঠন, সমাজকর্মী—সবাই এক প্ল্যাটফর্মে আসুন।
৩. দোয়া করুন:
আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে দোয়া করুন—যেন তিনি আমাদের হেফাযত করেন।
৪. আইনি প্রতিবাদ শুরু করুন:
মুসলিম আইনজীবীদের নিয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় প্রতিবাদ করুন।
উপসংহার :
সম্মানিত মুসলিম ভাই ও বোনেরা,
এই সময় নীরব থাকার নয়। এটি জেগে ওঠার সময়। আমাদের দ্বীন, আমাদের মসজিদ, মাদরাসা, দরগাহ—সবই এখন হুমকির মুখে। যদি আমরা এখন চুপ থাকি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
ঐক্য গড়ুন। প্রতিবাদ করুন। দ্বীন ও ঈমান রক্ষার জন্য সামনে এগিয়ে আসুন।
আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন।